বেবি চক্রবর্তী, সাংবাদিক ও লেখিকা, কলকাতা:
ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শত শত বিপ্লবীদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ। কোটি মানুষের রক্তের ওপর দেশভাগ। কথায় আছে গোড়ায় গলদ স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন নিয়েও দলাদলি ছিল খোদ কংগ্রেসের অন্দরমহলে, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং জওহরলাল নেহরুর মধ্যে। যখন কংগ্রেসের ওয়াকিং কমিটির ১৫ জন সদস্যের মধ্যে ১২ টা ভোট পেয়েছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আর বাকি তিনটে ভোট ঝুলিতে ছিল জহরলাল নেহরুর। সেই দিন গান্ধীজি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে আসার জন্য বাধ্য করেন। এবং গান্ধীজি নিজে প্যাটেল এর পদত্যাগপত্র লিখে তাতে স্বাক্ষর করার জন্য প্যাটেলকে বললে তিনি বলেন, "স্বাধীনতার শুরুতেই গণতান্ত্রের গলা টিপে তাঁকে হ্রাস করা হল।" সেই সময় এটি একটি তৎকালীন ইংরেজি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির অনুমোদন ছাড়া প্রধানমন্ত্রী পদ নির্বাচন করা যায় না কিন্তু সেখানে গান্ধীজি সবকিছু উপেক্ষা করে খোদ স্বয়ং ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নাম ঘোষণা করেন পন্ডিত জহরলাল নেহরু'কে। আজও তাঁর জন্মদিন শিশু দিবস হিসাবে পালিত হয়।
ভারতের রাজনীতির মঞ্চ যেন এক চিরকালীন নাট্যগৃহ। যেখানে সিংহাসন নিয়ে চলে চরম কৌশল দ্বন্দ এবং প্রতিযোগিতা। আজও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার কেবল একটি প্রশাসনিক পদ নয় বরং হয়ে উঠেছে শক্তির প্রভাব ও আর্দশের প্রতীক। স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ছিলেন গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তা। তাঁর শাসনে ভারতের পরিকল্পিত উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হয়। সিংহাসন ছিল তাঁর কাছে দায়িত্ব, দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার মঞ্চ।পন্ডিত জহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর ভারতের রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটে ইন্দিরা গান্ধীর। তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা স্পষ্ট ভাষী একরকম স্বৈরাচারী। তাঁর আমলে ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ছিল এক ভয়াবহ অধ্যায় যেখানে দেশীয় গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক কন্ঠরোধ ঘটেছিল। এরপর রাজীব গান্ধী - সোনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধীর হাত ধরে গান্ধী পরিবার রাজনৈতিক সিংহাসনের মূল দাবিদার হয়ে ওঠে। কংগ্রেস এই ধারাকে "ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার" হিসাবে দেখতে চেয়েছে অথচ বিরোধীরা একে পরিবার তন্ত্রীয় রাজনীতি বলে কটাক্ষ করে।
ভারতের রাজনীতিতে সিংহাসন কেবল পদ নয়। এ যেন এক নীতিগত প্রতিশ্রুতি ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। এরপর নব্বইয়ের দশকে ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে যায়। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ক্ষমতায়নের অলিন্দে ঢোকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তৈরি হয় জোট সরকার। এখানে একে একে ক্ষমতায় আসেন ভিপি সিং, চন্দ্রশেখর, দেবগৌড়া, আই কে গুজরাল এবং পরবর্তীতে একই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। এই সময় সিংহাসনের খেলা হয়ে দাঁড়ায় বিরামহীন বোঝাপড়া ও সামঝোতার চর্চা। যেখানে স্থায়ী নীতি ও পরিকল্পনা থেকে রাজনৈতিক সুবিধাইত অবস্থানটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। তাঁর শাসনাধীন সরকার আত্মবিশ্বাসী আক্রমনাত্মক ও এক ধরনের ব্যক্তি কেন্দ্রিক প্রতিচ্ছবি। তিনি জনসংযোগকে মূল হাতিয়ার বানিয়ে এক নিরঙ্কুশ শাসনের মডেল গড়ে তোলেন। যদিও অনেকে এই সময়কে গণতন্ত্রের সংকোচন হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। আবার অনেকেই একে বলেন উন্নয়নের যুগান্তকারী ধারা। ভারতের রাজনীতি আজও একটি চিরন্তন দ্বন্দ্ব আদর্শ বনাম ক্ষমতা নেতৃত্ব বনাম দম্ভ। জনসেবা বনাম ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা। প্রথম প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আজকের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এই সিংহাসন ভিন্ন সময় ভিন্ন চেহারার রূপ নিয়েছে কিন্তু একটা বিষয় সব সময় স্পষ্ট থেকেছে ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় বরং সাধারণ মানুষের আস্থা এবং গণতন্ত্রের ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল। ভারতের রাজনীতির এই সিংহাসন শুধু একটা পদ নয়। এটা একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে যারা এই সিংহাসনকে প্রকৃত জনসেবার হাতিয়ার বানিয়েছেন তাঁরাই মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। পাশাপাশি ভোট প্রচারের আগে বাড়ি বাড়ি ঘুরে যে জনপ্রতিনিধিরা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট ভিক্ষা করেন পরে তাঁদের কাছে কোনও প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ গেলে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করিয়ে জুতোর সোল খুইয়েছেন। তাঁরাই আবার পরে ক্ষমতাকে নিজস্ব হাতিয়ার করে। সময় তাঁদের সরিয়ে দিয়েছে ইতিহাসের প্রান্তে। তাই আজকের প্রজন্মের উচিত রাজনীতিকে কেবল ক্ষমতার খেলা না ভেবে সমাজে পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে দেখা তবেই সত্যিকারের গণতন্ত্রের নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। বর্তমান ভারতের প্রয়োজন আর্দশবান নেতৃত্ব গণতান্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজনীতির আঙিনায় এই সিংহাসনের খেলা আজও চলছে। সময়ের ধারা পরিবর্তনশীল কিন্তু এখানে মানুষের আশা নেতৃত্ববোধ জনকেন্দ্রিক মানবিক এবং নৈতিকতায় ঋদ্ধ।
(www.theoffnews.com Prime Minister India)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours