বেবি চক্রবর্তী, সাংবাদিক ও লেখিকা, কলকাতা:
পথের ধারে অজস্র রক্তপাত বয়ে ছিল মৃত্যুর ঢল উঠেছিল স্লোগান, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায় - লাখো ইনসান্ ভুখা হ্যায়।
মাতৃভূমির বুকে বেজে ছিল শঙ্খ ধ্বনি - উড়েছিল পতাকা মধ্যরাতের অন্ধকারে রাত্রি বারোটায় অখন্ড ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা।
সূর্যালোকে আসেনি ভারতের স্বাধীনতা। আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম মধ্যরাতের অন্ধকারে। ঘড়িতে তখন রাত বারোটা| অখন্ড ভারতের বারোটা বাজিয়ে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছিল| মাঝরাতে দু’টুকরো হয়ে গেল দেশ| কিন্তু ভারত ভেঙে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নেয়নি| জন্মেছিল দু’টি পৃথক ডোমিনিয়ন| ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসের ঠিক মাঝামাঝি ১৪ – ১৫ ই আগষ্ট বাস্তবে কি ঘটেছিল তাঁর ছোট একটা বিবরণ ইংরেজিতে তুলে দিলাম —
New Delhi, Aug 15 :- Two new Dominions , India and Pakistan , were born at zero hour today, ushering in political freedom to 400 million people constituting one – fifth of the human race. At a special session of the Indian Constituent Assembly, the House assumed full powers for the administration of the Indian Dominion.
সূর্যডোবা সেই রাতে এসেছিল ভারতের বুক চিরে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান নামে আলাদা দুই ডোমিনিয়নের জন্ম| সেইসঙ্গে ক্ষমতার হস্তান্তর|
মুক্তিযুদ্ধে দুই প্রধান নায়কই ছিলেন ওই দৃশ্যে অনুপস্থিত| ১. মহাত্মা গান্ধী, যিনি কলকাতার বেলেঘাটায় বস্তি এলাকায় মুখ লুকিয়ে ওই রাতটি কাটিয়েছিলেন| ২. নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (নেতাজি স্বয়ং থাকলে বোধ হয় এটি হত না)|
স্বাধীনতা দেশভাগ একসঙ্গে জড়িয়ে গেল। কিন্তু দেশভাগ ছিল যতটা নিরেট সত্য, স্বাধীনতা ততটা নয়| দেশভাগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল কোটি কোটি মানুষের চোখের জল| রক্তের স্রোত বয়েছিল| জাতির চেয়ে বড় হয়েছিল সম্প্রদায়| যেখানে সম্প্রদায় বিশেষ জেহাদ ছাপিয়ে গিয়েছিল জাতীয় সংগ্রামকে। শুরুতেই গড়ার চেয়ে ভাঙাই পেল মর্যাদা| দেশপ্রেমকে বিদায় জানিয়ে মান্যতা দেওয়া হল ক্ষমতার কাড়াকাড়িকে|
কে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হবেন!
সেইরাতে গান্ধিজিও নাকি নিরবে কেঁদেছেন। পরে স্বীকার করছিলেন ১৫ ই আগষ্ট ছিল তাঁর পরাজয়ের দিন| গ্লানিভারে নুয়ে পড়েছিলেন তিনি| গান্ধিজি বলেন –“জওহরলাল, সর্দার প্যাটেল, মৌলানা আজাদ সবাই তাঁর দূরের মানুষ| এরা এতকাল আমাকে মই হিসেবে ব্যবহার করেছে| কাজ ফুরোলে ছুঁড়ে ফেলেও দিয়েছে| গান্ধিজি পরে স্বীকার করেন যে “যদি সুভাষ ফিরত তবে দেশভাগ হত না|”
স্বাধীনতা ও দেশভাগ একই সময়ে ব্রিটিশ আইনের আওতায়| আইনের নাম The Indian Independence Act, 1947 …
কিন্তু ৫নং ধারায় এসে থলির বেড়াল বেড়িয়ে পড়েছিল|
For each of the new Dominions, there shall be a Governor General who shall be appointed by His Majesty and shall represent His Majesty for the purposes of the Govenment of the Dominion.
ব্রিটিশ যে ভারত থেকে বিদায় নেবে সুভাষচন্দ্র তা জানতেন। যাবার আগে তারা যে অখন্ড ভারতকে খন্ডিত করে দিয়ে যাবে তা তিনি যুদ্ধ শুরু হবার আগেই বুঝেছিলেন| কংগ্রেস সভাপতির ভাষণে সে বিষয়ে তিনি জনসাধারণ ও শিক্ষামন্ডলীকে হুঁশিয়ার করেও দিয়েছিলেন| তারপর যখন তিনি দেশের বাইরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় স্বাধীনতার যুদ্ধ চলা কালীন তখন বেতার ভাষণে গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল প্রমুখ নেতৃমন্ডলীর কাছে বারবার তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন, মাতৃভূমিকে দ্বিখন্ডিত হতে দেবেন না| কেউ শোনেনি তাঁর কথা। তাই আজ সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনীতি যেন জাতির অন্ধ বিবেচিত নির্বাচিত প্রার্থী কূটনীতিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে দুর্নীতির দিকে ক্রমশ অগ্রসর হয়েছে| অর্থনীতি সাম্যতা কমে দিনে দিনে বেকারত্বের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে| স্বাধীনতার নতুন সূর্য কখনও দেখতে চায়নি ক্ষুধার্ত অসহায় শিশুর কান্না আর বেকারত্বের অবহেলিত নীরব নোনাজল!
ব্রিটিশ ভারতকে দীর্ঘদিনের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের পর ১৯৪৭ এর ১৫ ই আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ভারত (India) - পাকিস্তান (Pakistan) নামে দুটি স্বাধীন অধিরাজ্যে বিভক্ত হয়| সারা দেশ যখন মুক্তির আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছে, তখন দেশে একটি নতুন শ্লোগান ওঠে ---- "ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় | ভুলো মাৎ ভুলো মাৎ" এই স্বাধীনতা মিথ্যা, ভুলো না, ভুলো না। বলা বাহুল্য, এ অভিযোগ যথার্থ নয়, বরং বলা য়ায় ---- অর্ধ - সত্য | ড. অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন, "এ আজাদি একেবারে ঝুটা না হলেও জন্মসূত্রে প্রতিবন্ধী|" আসলে স্বাধীনতা লাভের ফলে ভারত দু- টুকরো হয়ে যায়| ভারতের দুটি সমৃদ্ধিশালী প্রদেশ ---- বাংলা ও পাঞ্জাব দ্বিখন্ডিত হয়| দেশজুড়ে শুরু হয় ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা, লুন্ঠন, নারী নির্যাতন, ধর্মান্তর এবং লাখ লাখ ছিন্নমূল মানুষের দেশান্তর গমন| ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়ায় পাকিস্তান ভারত - ভুক্ত পাঞ্জাব থেকে লাখ লাখ মানুষ ভারতে চলে আসতে থাকে| এইসব দেশত্যাগী মানুষদের জন্য বাসস্থান, খাদ্য ও কাজের ব্যবস্থা করা কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়| দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিও বিভক্ত হয়ে যায়| ভারতে দেখা যায় চরম বেকার সমস্যা| ১৯৪৭ এর অখন্ড ভারত ভাগ নতুন দেশের গৃহহীন ও বাস্তুুচ্যুত| ১৯৪৭ সালের এপ্রিলেও বোঝা যায়নি আগষ্টে দেশভাগ হবে| এপারের মানুষ ওপারে যাবে। ওপারে মানুষ এপারে| মুর্শিদাবাদ, খুলনার মানুষ বিভ্রান্ত হবে তাদের অংশে ভারত না পাকিস্তানের পতাকা উড়বে। সিলেটের করিমগঞ্জে পাকিস্তানের পতাকা উড়েও নেমে যাবে| প্রাক্তন এক ইংরেজ বিচারক স্যার সেরিল র্যার্ডক্লিফ যিনি আগে কোনদিন ভারতবর্ষে আসেনি, ভালো করে ম্যাপ পড়ার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা (Cartographic Knowledge) যার নেই, প্রত্যক্ষ কোনও অভিজ্ঞতা নেই এ অঞ্চলের মানুষের জীবন সংস্কৃতি, ভাষা ও আনন্দ - বেদনার তাকে কিনা দায়িত্ব দেওয়া হল বাংলাকে বিভক্ত করার বাউন্ডারি কমিশনের| স্যার লর্ড মাউন্টব্যাটেন দেশভাগের জন্য তাড়াতাড়ি করে ধরে এনেছিল তখনকার রাজনৈতিক চাপের পরিস্থিতি সামাল দিতে তার আঁকিবুকি ও নানা কূটকৌশলের রাজনৈতিক সমীকরণে কোটি কোটি মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা আর বিপর্যয় নেমে আসবে| অনেকের নতুন পরিচয় হবে উদ্বাস্তু| ছেড়ে যেতে হবে সাত পুরুষের বসতি, স্মৃতি ও সংগ্রামের ভূমি, নদী -মাঠ- ঘাট, আশৈশব, হেঁটে যাওয়া চেনা পথ, প্রান্তর। পেছনে পড়ে থাকবে ধূ-ধূ স্মৃতির ভূমি, স্বজনের কবর আর শশ্মান| অসহায় অজস্র মানুষের স্থান হবে রিফিউজি ক্যাম্প| কেউ যাবে দূর পৌরাণিক কাহিনীর অনুর্বর দেশ -দণ্ডকারণ্যে। তাদের সংগ্রাম ও গভীর বেদনা ফুরাবে না একজীবনে। আজ যেন সব স্মৃতির পাতা।
(www.theoffnews.com fractured freedom India)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours