দেবর্ষি মজুমদার, সিনিয়র জার্নালিস্ট, বীরভূম:
আজ বুধবার শান্তিনিকেতনে হেরিটেজ ওয়াকিং শুরু হল। কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক গনেরা আজকে টুরিস্টের ভূমিকা পালন করেন। গাইড এর ভূমিকা পালন করেন প্রশিক্ষিত ভলেন্টিয়ার্সরা।
বিশ্বভারতীর কর্ম সচিব অমিত হাজরা সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, বুধবার হেরিটেজ ওয়াকিং এর ট্রায়াল শুরু হলো। চারজন ছেলে এবং চারজন মেয়েকে গাইডের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। একজন ছেলে ও একজন মেয়ে মোট চারটি টিমে বিভাজিত হয়ে গাইডের কাজ করবেন। জানা গেছে হেরিটেজ ওয়াকিং এর জন্য ৩০০ টাকা টিকিট হবে। রবীন্দ্র ভবনের জন্য আড়াইশো টাকা টিকিট কাটতে হবে। সমস্ত টিকিট রবীন্দ্র ভবন থেকে কাটা যাবে। কলা ভবন, রবীন্দ্র ভবন এবং হেরিটেজ ওয়াকিং এই তিনটি ক্যাটেগরিতে টিকিট বুকিং করা যাবে। পড়ুয়াদের জন্য ব্যাচে ৫০ টাকা এবং ব্যক্তিগতভাবে ঘুরলে দেড়শ টাকা টিকিট কাটতে হবে। একটি ব্যাচে মোট ২৫ জন পর্যটক থাকতে পারবে। এছাড়াও সমস্ত কিছু ঘুরতে চাইলে কন্সেশন রেটে একটি কম্ব টিকিট এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক পর্যটক শনি রবিবার দুদিনই ঘুরতে চান। সেক্ষেত্রে তারা লাভবান হবেন। বিদেশি পর্যটকদের জন্য হাজার টাকা টিকিট ধার্য হয়েছে। বুধবার হেরিটেজ ওয়াকিং এর ট্রায়ালের শেষে প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষিত গাইডদের কোন ভুল থাকলে সংশোধন করে দেবেন। মোট তিনটি ভাষায় এই গাইড কথা বলবেন। সেগুলি হলো বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি। মার্চ মাস থেকে এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়। জুলাইয়ে বৃষ্টি হওয়ার কারণে এই হেরিটেজ ওয়াকিং এর কাজ বিলম্বিত হয় বলে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সূত্রে বলা হয়েছে। নভেম্বর থেকে অনলাইন টিকিট বুকিং করা যাবে। কেউ গাড়ি ছাড়াও ঘুরতে পারে তার জন্য টিকিটের মূল্য আলাদা ধার্য আছে। এছাড়াও দেড় ঘন্টা ভ্রমণের পর এক্সিট পয়েন্টে বিশ্বভারতী পড়ুয়ারা তাদের নিজস্ব সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে দু তিনটে স্টল নিয়ে হাজির থাকবে। ভবিষ্যতের জন্য এমন পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশ্বভারতী তার নেতিবাচক প্রভাব থেকে বেরিয়ে হেরিটেজ সাইটকে সকলের জন্য উন্মোচিত করে এক ইতিবাচক সময়ের সূচনা করতে চলেছে। হেরিটেজ ওয়াকিং এর পর স্মৃতি হিসেবে সকলের হাতে স্মরণিকা তুলে দেওয়া হবে, বলে বিশ্বভারতী সুত্রে খবর। বুধবার এই স্মরণিকা এবং টিকিটের উদ্বোধন করা হয়। এই ঘটনায় শান্তিনিকেতনবাসী ও প্রবীণ আশ্রমিকরা খুবই খুশি। বিশ্বভারতীর এই সদর্থক পদক্ষেপ কে সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত প্রবীন আশ্রমিকরা সাধুবাদ জানিয়েছেন।
আসুন এক ঝলকে জেনে নেওয়া যাক, সেই স্মরণিকায় কী কী আছে...
হাটিমাঙ্গলা
মহার্শি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধ্যানের বেদি। আনুমানিক ১৮৬৮ সালের মার্চ মাসে শান্তিনিকেতন আশ্রমের প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়। কিছুকাল পরেই সেখানে একটি পাকা মন্দির নির্মিত হয়।শান্তিনিকেতনের-গৃহ
শান্তিনিকেতনের প্রাচীনতম বাড়ি। ১৮৬৩ সালে এই বাড়িটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রথমে এটি মহর্ষির গ্রীষ্মকালীন বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৭ সালে এই বাড়িতেই ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস রচনা করেন। পরে এটি অতিথি-গৃহ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯১৯ সালে গেস্ট হাউস রূপে ব্যবহৃত হওয়ার পর এখানে থাকার জন্য আসতেন দেশের ও বিদেশের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি। এই ঘরে এক সময় শান্তিনিকেতনের পুরনো জাদুঘরও ছিল। এখানকার বেশির ভাগ আসবাবপত্র কলকাতার সবরকার এসেছে।
দিনলিপিকা
শান্তিনিকেতন চাতুর্মাস্য মধ্যভাগে দিগন্তবিস্তৃত চত্বরে ‘উপাসনা’ নামে ১৯০১ সালে একটি প্রার্থনাগৃহ নির্মিত হয়। এই প্রার্থনাগৃহে মেঝেতে বসে উপাসনা হয়। কোন মূর্তি বা প্রতীক নেই। এখানে রবিবারে ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়া হয় এবং পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করা হয়।
চীন ভবন
১৯৩৭ সালের চীন ভবনের প্রতিষ্ঠা হয়। চীন এবং ভারতীয় সংস্কৃতি-সভ্যতা চর্চা ও প্রসারের উদ্দেশ্যে এই ভবন নির্মাণ করা হয়। চীন ভবনে রয়েছে একটি সংগ্রহশালা, লাইব্রেরি, দালান ও হলঘর, যেখানে চিনা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করা হয়। ভবনটি stucco শিল্পরীতিতে নির্মিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষর
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ হেরিটেজ সেবা কেন্দ্র প্রকাশিত।
স্বত্বাধিকারঃ হেরিটেজ সেবা কেন্দ্র।
উপাসনা-গৃহ
বিশ্বভারতীর এই উপাসনা-গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭ ডিসেম্বর ১৮৯৮ সালে। এই স্থানে ব্রাহ্মসমাজের আদর্শে শান্তিনিকেতনের সকল আবাসিক ও অতিথিদের নিয়ে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হত। ১৯০১ সালে ২৩ ডিসেম্বর বিদ্যালয় স্থাপনের পর ‘উপাসনা’ শান্তিনিকেতনের একটি গুরত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে।
বিশ্বভারতীর উপাসনা গৃহটি চারদিকে খোলা, কোন দেয়াল নেই। এর মেঝেতে বসেই উপাসনা হয়। এখানে কোন প্রতিমা নেই, উপাসনা সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। রবিবার সকালে ও বিশেষ উৎসবে এখানে উপাসনার আয়োজন করা হয়।
নতুন বাড়ি
রবীন্দ্রনাথ সংসারের নবনির্মাণের জন্য ১৯০২ সালে এই বাড়ি নির্মাণ করেন। নির্মাণকালে তার মাতামহীর স্মৃতিমগ্নতা এবং স্বজন হারা রবীন্দ্রনাথের নিঃসঙ্গতা, বিশেষভাবে কাজ করেছিল।
এই বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। বিভিন্ন সভা, বৈঠক ও আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনার নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘নতুন বাড়ি’ ব্যবহৃত হয়েছে
তালদেহ
একটি তালগাছকে ঘিরে এই ঘর তৈরি, hence তালদেহ। এটি বর্তমানে শান্তিনিকেতন বিদ্যাভবনের অধ্যাপক শিক্ষকদের বাসগৃহ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি একতলা একটি ভবন, যার অভ্যন্তরে একসময় অধ্যাপক সেলিম মুরাদ বাস করতেন।
দেবেন্দ্রভবন
১৯০৪ সালে ‘দেবেন্দ্রভবন’ নির্মাণের কাজ শুরু। ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ এই বাড়িটিতে বসবাস করেন। বাড়ির নির্মাণের সময় কবির মতামত মেনে কাজ হয়েছে।
এই বাড়িতে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি এসেছেন এবং বসবাস করেছেন।
এই বাড়িতেই প্রথম শান্তিনিকেতন পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল।
সত্যমঙ্গল
রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্যতম পর্যায়ে এই বাড়িটি নির্মিত হয়। সত্যমঙ্গল বাড়িটি তার স্ত্রীর স্মৃতিবিজড়িত। তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর এই বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১৯০৪ সালে এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাধনা’, ‘শিক্ষা’, ‘আত্মশক্তি’ প্রভৃতি প্রবন্ধ রচনা করেন। বর্তমানে এটি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ঘণ্টাতলা
১৯০৫ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের শাশুড়ি বেলি দেবীর উদ্যোগে এই বাড়িটি নির্মিত হয়।
ঘণ্টাতলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো - মূল প্রবেশপথের সামনে একটি ঘণ্টা ঝোলানো থাকে। বাড়িটি শিক্ষকদের আবাসিক ভবন হিসেবে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানসূচী ও স্মারক নির্দিষ্টকরণে ব্যবহৃত হয়।
পূর্ব-ভবন ও পশ্চিম-ভবন
বিদ্যালয়-এলাকার প্রথম ভবনগুলোর মধ্যে দুটি ভবন পূর্ব-ভবন ও পশ্চিম-ভবন হিসেবে পরিচিত। বাড়ি দুটি সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের শাশুড়ি বেলি দেবীর অনুদানে নির্মিত। বিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসন ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সিংহসদন
রায়বাহাদুর জীবনচন্দ্র সান্যালের অনুদানে এই ভবন নির্মিত হয়। ১৯৪২ সালে এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। ১৯৪৫ সালে নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়।
এই ভবনটি নির্মিত হয় শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস হিসেবে। ভবনটি আজও বিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিন তলা বিশিষ্ট ভবনটির সম্মুখে সিংহের মূর্তি থাকায় এর নামকরণ হয়েছে সিংহসদন।
পাঠভবন
শান্তিনিকেতনের প্রাচীনতম বাড়িগুলোর অন্যতম পাঠভবন বিদ্যালয় ভবন।
প্রথমে এটি শিক্ষকদের আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯১৯ সালে পাঠভবন নামকরণ হয়।
শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম শিক্ষার্থী অন্নপূর্ণা তুরু ১৯০১ সালে ভর্তি হন। বিদ্যালয়ের স্থাপনার সময় পাঠভবন ছিল কেন্দ্রস্থলে।
১৯০৪ সালে কবিগুরু লিখেছেন –
“শিক্ষার প্রথম ক্রমে যেটি সবচেয়ে বড়ো সম্পদ তা হলো গৃহ। গৃহশিক্ষা আমাদের দেশের প্রাচীন আদর্শ। এই সময় পাঠভবন সেই আদর্শকে বাস্তব রূপ দিয়েছিল।”
(www.theoffnews.com Shantiniketan)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours