বেবি চক্রবর্তী, সাংবাদিক ও লেখিকা, কলকাতা:

সৃষ্টির অনন্ত পথে সত্যের সাধনা। অসীম ধৈর্য নিয়ে তাকিয়ে ---- সময়! মরদেহ সমাধি নিয়ে চলেছিল বিবাদ চরমে। তৎকালীন ডেভিড হেয়ারের সমাধি নিয়ে একের পর এক বিবাদের ঝড় উঠেছিল।মৃতদেহ পচে নাকি দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে লালদীঘির জল নাকি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মামলাও রুজু হয়েছিল কোর্টে। এত সন্ধিক্ষণের পর জয়ের মুকুট পেল ডেভিড হেয়ার। প্রবল ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হেয়ারের শবযাত্রা। ওদিন কলকাতার রাজপথ ছিল জনসমাগম। বউবাজারের চৌরাস্তা থেকে মাধব দত্তের বাজার পর্যন্ত। হাজার হাজার মানুষ সেই যাত্রায় পা মিলিয়েছেন। কেউ গাড়িতে কেউ পায়ে হেঁটে সঙ্গ দিয়েছিল প্রিয় হেয়ার সাহেবকে।  

সেদিন সমাধি নিয়ে উঠেছিল ঝড়। কোথায় শায়িত হবেন মহারতি হেয়ার...? খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী তিনি ছিলেন না তাই কবরস্থানে তাঁর জায়গা হল না! অবশেষে হিন্দু কলেজের কাছে তাঁরই কেনা জমিতে লালদীঘির ধারে আজও তিনি শায়িত রয়েছেন।

ডেভিড হেয়ার ছিলেন একজন স্কটিশ ঘড়ি ব্যবসায়ী। যিনি কলকাতায় এসে মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। কলকাতায় আসার পর তিনি ডালহৌসি এলাকায় বসবাস করতেন। সেখানে তার বন্ধু গ্রে সাহেবের সাথে একটি বাড়িতে থাকতেন। তিনি ১৮০০ সালে ভারতে এসেছিলেন ঘড়ি তৈরির কাজে অর্থ উপার্জনের জন্য। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে কলকাতায় তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রামমোহন প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় সভার সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। জনহিতকর কাজ শিক্ষার উন্নতির জন্যে প্রচেষ্টা কর‍তে থাকেন। তাঁর নিজের ঘড়ির ব্যবসার ক্ষতি করেও অর্থ, সময় এবং নিরলস শ্রম দান করতে থাকেন শিক্ষার উন্নতিকল্পে। 'আত্মীয় সভা'য় কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এডওয়ার্ড হাইড ইস্টকে তার এই উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য অনুরোধ করেন। এ ব্যাপারে হাইড ইস্ট ও কতিপয় ভদ্রলোকের সক্রিয় সহযোগিতায় ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই বছরই তিনি ইংরেজি এবং বাংলা পুস্তক মুদ্রণ ও প্রকাশনার জন্য ‘কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজসেবায় সার্বক্ষণিকভাবে আত্মনিয়োগের জন্য ডেভিড হেয়ার ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে তার ব্যবসার দায়িত্ব ন্যস্ত করেন তার বন্ধু গ্রে সাহেব-এর ওপর। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তারা দুজন হেয়ার স্ট্রিটের একটি বাড়িতে একসঙ্গে অবস্থান করতেন। ইতোপূর্বে তিনি ব্যবসা করে কলকাতায় বিপুল পরিমাণ ভূ-সম্পত্তি ক্রয় করেছিলেন। ওই সম্পত্তির কিছু অংশ তিনি হিন্দু কলেজকে দান করেন বাকিটা সংস্কৃত কলেজের নিকট নামমাত্র দামে বিক্রি করেন। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়োর সঙ্গে ডেভিড হেয়ারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়। ইয়ং বেঙ্গলের একজন হিতৈষী হিসেবে হেয়ারের তাদের সংগঠন ‘সোসাইটি ফর দ্য প্রোমোশন অব জেনারেল নলেজ ১৮৩৮ সালে সংস্থার পৃষ্ঠপোষক হন। নিষ্ঠুর শ্রম আইনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। ওই আইনের আওতায় সে সময়ে ভারতীয় শ্রমিকদের দাস হিসেবে ইউরোপের উপনিবেশ গুলোতে পাঠানো হত। ঔপনিবেশিক আমলের উৎপীড়নমূলক, অমানবিক আইনের সংস্কার সাধনের জন্য তিনি জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। দেশীয় সংবাদপত্রের ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের জন্যও সংগ্রাম করেন। নতুন স্কুল এবং অন্যান্য জ্ঞানচর্চামূলক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ দানের কারণে হেয়ার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কলকাতার শেরিফ পদের জন্য মনোনীত করে। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে মাসিক ১০০০ রুপি বেতনে উক্ত পদে নিয়োগ দিয়ে তাঁর ঋণমুক্তির ব্যবস্থা করেছিল।

হেয়ার ১৭৭৫ সালে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন ।তিনি যখন তার ব্যবসায় উন্নতি করছিলেন। তখন স্থানীয় জনগণের শোচনীয় পরিস্থিতি তাঁর মনকে বিক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। অন্যান্য বেশিরভাগ লোকের মতো নয় যারা শান্তি ও সমৃদ্ধিতে জীবনযাপনের জন্য সম্পদ অর্জন করে তাঁদের জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন। তিনি এই দেশেই থেকে যাওয়া এবং এর উন্নয়নের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। 

এরপর জীবনে তিনি তাঁর ঘড়ির ব্যবসা দেখার মতো সময় দিতে পারছিলেন না। সেই জন্যে ওটা গ্রে নামে তাঁর এক বন্ধুর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে কিছু অর্থ দিয়ে তাঁর নিজের জন্যে একটা ছোট বাড়ি কিনেছিলেন এবং বাকি অর্থ স্কুলের উন্নয়নের জন্যে খরচ করেছিলন। দীর্ঘ কর্মজীবনের পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলন। ৩১ শে মে রাত্রি একটায় কলেরার জীবাণু মেলে হেয়ারের শরীরে। তিনি কলেরায় আক্রান্ত হন। ভয়ঙ্কর বমি‌ শুরু হয়ে যায়। ডেভিড হেয়ার বুঝতে পেরেছিলেন ধীরে ধীরে মৃত্যু গ্রাস করছে তাঁকে। বন্ধু গ্রে'কে বলেছিলেন কফিনের ব্যবস্থা করতে। পরের দিন সকালে ডেভিড হেয়ারের প্রিয় ছাত্র কলকাতা মেডিকেল কলেজ উত্তীর্ণ ডাক্তার প্রসন্ন কুমার মিত্র তাঁকে আরোগ্য করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেও বিফল হন। সেদিনটা ছিল পয়লা জুন। সন্ধ্যা বেলায় হেয়ারের মৃত্যু হয়। গোটা কলকাতা জুড়ে এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই। ছোট থেকে বড় প্রায় সবাই ভিড় করতে থাকে ডেভিড সাহেবের বাড়িতে তাঁর অন্তিম মরদেহ দেখার জন্য। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে ১ জুন ডেভিড হেয়ার জীবনাবসান হয়। ভুলে গেছি আমরা পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে ডেভিড হেয়ারের অবদানের কথা। আজও স্মৃতির ফলকে কলকাতার রাজপথে গোলদীঘির ধারে কফিন বক্সে শায়িত ডেভিড সাহেব...!

(www.theoffnews.com David Hare Kolkata)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours