দেবাত্রেয়ী গুহ, লেখিকা, বারাসাত, কলকাতা:

বাঙালির পুরী ভ্রমণ নিয়ে গল্প লেখার কি আছে?সবাই সব চেনে সব জানে! 

কিন্তু তাও এক অচেনা অজানা পুরী সেদিন দেখেছিলাম তাই হয়তো কলম ধরলাম।

প্রতিবছর একটা জায়গায় বছরে তিন থেকে চারবার যাই। সেটা পুরী। এরমধ্যে ভালোবাসা থাকে। মনের আনন্দ থাকে। কিন্তু সব হিসাব মিলতে নেই।

২০২৩ সালের ৭ই নভেম্বর শিয়ালদহ দুরন্ত'তে পুরী গেলাম আমি মা আর ছেলে আর আমার এক মাসি। ভোর চারটে দশ নাগাদ ট্রেন পুরী স্টেশনে ঢোকালো।

কিন্তু ওই কাকভোরে চুড়ান্ত অসুবিধায় পড়লাম যখন অটো স্ট্যান্ডে হোটেল সুইমিং'এ পৌঁছানোর ভাড়া চাইলো ১৫০০ টাকা। তাও মেইন রোড মানে মেরিন ড্রাইভ রোড দিয়ে যাওয়া যাবে না ভিতর দিয়ে যাবে এবং হোটেল এর অনেক আগেই নেমে যেতে হবে কারণ...আজ কার্তিক পূর্ণিমা, ওড়িশার এক অন্যতম প্রধান দিন, আজ সমুদ্রে প্রথম সওদাগর নৌকা ছেড়ে ছিল, সেই থেকে ওড়িশার মানুষের সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই আজ ভোর তিনটে থেকে সমগ্র ওড়িশার মানুষ স্নান সেরে সমুদ্র বা নিকটবর্তী জলাশয়ে কলার ডোঙ্গাতে প্রদীপ ভাসাবে আর ফানুশ ওড়াবে।

সেই কারণে সমস্ত রাস্তা বন্ধ। খুব বিরক্তি নিয়েই দর কষাকষি করে ১২০০ টাকাতে অটোচালককে রাজি করিয়ে হোটেল থেকে বেশ খানিক দূরে লাগেজ নিয়ে নেমে পড়তে বাধ্য হলাম। লাগেজ টানবো না ছেলেকে সামলিয়ে হাটবো, বুঝে উঠতে পারছি না।নভেম্বরের ওই সকালেও আমি ঘেমে অস্থির। একরাশ অসন্তোষ নিয়ে অনেক হেঁটে কোনক্রমে হোটেলে পৌঁছে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম।

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই হোটেল এর রিসেপশনিস্ট থেকে শুরু করে বাকি স্টাফ এমনকি হোটেলে থাকা পর্যট রাও সবাই দেখলাম হোটেল থেকে প্রবল উৎসাহ নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন। আমাদেরও বললেন এ দৃশ্য বছরে একবারই দেখা যায় চলুন চলুন।

হেঁটে ঘেমে ক্লান্ত আমরা কিছুটা অনিচ্ছা নিয়েই বেরলাম। ছেলেও রাজি হচ্ছিলো না। জোর করে বুঝিয়ে হোটেল এর বাইরে বেরিয়ে চোখ স্থির হয়ে গেল।

অপূর্ব এক দৃশ্য, অগুণিত মানুষ ...কিন্তু সমস্ত মানুষকে অতিক্রম করে গাঢ় অন্ধকার সমুদ্রে ভেসে চলেছে হাজার হাজার প্রদীপ, আকাশ জুড়ে অজস্র ফানুস, সমুদ্রের তীরে জ্বলছে হাজার হাজার প্রদীপ, ঢেও এসে কোনওটাকে নিভিয়ে দিচ্ছে কোনওটাকে বা সঙ্গে নিয়ে চলেছে...সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল এই দৃশ্য দেখে। কিছু সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না সত্যি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।

দেখলাম এক অন্য ভারত ভূমিকে তাঁর পরেরদিন।পরেরদিন ছিল চন্দ্র গ্রহণ। আমি আর ছেলে বসে আছি সমুদ্রের খুব সামনে দুটো চেয়ার ভাড়া করে। মদনমোহন ...সলতে, মুক্তোর মালা হেঁকে যাচ্ছে! 

মা আর মাসি বলেছে, গ্রহণ না ছাড়লে কিচ্ছু খেতে নেই,ওরা দূরে বাজারে কেনাকাটা করছে! 

গ্রহণ ছাড়ার সময় প্রায় আগত! চন্দ্রদেব প্রকাশ্য আসছেন ধীরে ধীরে....প্রচুর দেহাতি মহিলা কপাল থেকে নাক অবধি কমলা সিঁদুর হাতে কাচের চুড়ি ঝকমকে সস্তার সিনথেটিক শাড়ি পড়ে হাতে প্রদীপ নিয়ে জড়ো হচ্ছে সমুদ্রের তীরে। বহু সন্ন্যাসী এসেছেন, বিদেশীরাও ক্যামেরা নিয়ে যেন কিসের প্রতীক্ষায়...

গ্রহণ ছাড়লো,আকাশে পূর্ণ চন্দ্র, একসাথে শত শঙ্খ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো চারিদিক। মহিলারা সমুদ্রকে প্রদীপ দিয়ে আরতি করে, সেখানেই শাড়ি ছেড়ে জলে নেমে পড়লো। আমি অবাক হয়ে গেলাম...এতো পুরুষের মাঝে এতো মহিলা শুধু পেটিকোট আর ব্লাউজ পড়ে স্নান করছে কিন্তু অবাক হওয়ার বাকি ছিল যখন জল থেকে উঠে আসা মহিলাদের চরণ স্পর্শ করছে বহু মানুষ...কেনও কিছুই বুঝতে পারলাম না...এমনকি বিদেশীরাও তাদেরকে নমস্কার করছে হাত জোর করে...হঠাৎ এরকম দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

তারা পুনরায় শাড়ি পড়ে একে অপরকে নাক থেকে কপাল পর্যন্ত সিদুর লেপে দিচ্ছে বহু পুরুষও আসছে। তাদেরও টিকা পড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি আর ছেলে অবাক হয়ে দেখছি।

এক দেহাতি মহিলা আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো "সুহাগন আছো তো মাঙ্গ ভরনি কেন!" এই বলে নাক থেকে কপাল অব্দি সিঁদুর লেপে দিল, হাতে শুধু ঘড়ি দেখে নিজের হাত থেকে চার জোড়া লাল কাচের চুড়ি পরিয়ে দিল...জানি না ভক্তি কিনা!

আমি আর ছেলে প্রণাম করলাম তাঁকে..."হামেশা খুশ রাহ দিকরি" বলে ভিড়ে হারিয়ে গেল! এক বিদেশি ফটোগ্রাফার এই দৃশ্য বেশ কিছু ফ্রেম বন্দী করেছিলেন...আমায় দেখালো! ভালো লাগার এক অদ্ভুত অনুভূতি ছিল সেদিন। দূরে মদনমোহন হেঁকে যাচ্ছে! গ্রহণ ছেড়ে গেছে এবার তো একটু মিষ্টি খাওয়াই যায়।

দেখলাম জানলাম এক নতুন পুরীকে। সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরলাম। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।

জয় জগন্নাথ...

(www.theoffnews.com Puri Jay Jagannath)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours