সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
পরীক্ষার সময়, একজন অধ্যাপক একটি ভূতের মুখোশ পরেছিলেন এবং জাল দিয়ে সাতটি কাককে ধরেছিলেন। আলেকজান্দ্রে দুমা’র লেস ফ্রেস কর্সেস বা “দ্য কর্সিকান ব্রাদার্স” নিশ্চয়ই মনে আছে! নেপোলিয়নের জন্মস্থান বলে নয় আমাদের মনে কর্সিকা ছোটবেলা থেকে স্থান করে নিয়েছে ‘প্রতিহিংসার দ্বীপ’ বলে। ‘৪১ নং গেছোবাজার, কাগেয়াপটির শ্রীকাক্কেশ্বর কুচকুচে’কে তো কেউ ভুলতেই পারবে না! ‘দ্য বার্ডস’ ফিল্মে ক্যালিফোর্নিয়ার বোদিগা বে শহরের অধিবাসীদের আক্রমণে হিচকক ১০০টি শিক্ষিত কাক ব্যবহার করেছিলেন যেটি বিশ্বের হরর ফিল্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। ২০০৬ সালে নির্মিত ‘দ্য ক্রোজ’ হরর মুভিতে ল্যাব থেকে পালানো একদল কাক মানুষকে আক্রমণ করতে শুরু করে। আসল ঘটনাটা জানা এক ভেট বার্লিন শহর এবং শহরবাসীদের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। অধুনা এক অধ্যাপক বিজ্ঞানী আবার এই দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন।
যারা কাকের বাচ্চা পুষতে চেয়েছিলেন বা যে গাছে কাকার বাসা আছে এমন গাছে উঠতে চেয়ে মাথায় ঠোক্কর খাননি বা বাইরে বেরোলেই কাকেরা মাথার চারপাশে কা কা করতে করতে গোল হয়ে উড়ে ভয় দেখায়নি এমন মানুষ খুব কমই আছেন কিন্তু এই অধ্যাপক আবিষ্কার করেছেন যে কর্সিকার দ্বীপবাসীদের মতো কাকেরাও দীর্ঘদিন জিঘাংসা পুষে রাখতে পারে এবং সেটা এক আধ বছর নয় – পাক্কা সতেরটি বছর – রামের বনবাস আর পাণ্ডবদের বনবাস-অজ্ঞাত বাসের থেকেও বেশি।
যদিও মনুষ্য জাতির মধ্যে প্রতিশোধ নেওয়া একটি অতি সাধারণ বৈশিষ্ট্য, আপনি কি কখনও পাখি বা পশুদের প্রতিশোধ নিতে শুনেছেন? আমাদের দেশের গল্পে বা সিনেমায় এবং সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে, লোককথায় এসবের অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে তার হদিশ পাওয়া শক্ত। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে যে সাপের জোড়ার একটাকে মেরে ফেললে অন্যটা এসে হত্যাকারীর ওপর প্রতিশোধ নেয়, যদিও এর কোনও প্রামাণ্য নথি নেই। শঙ্খচূড় সাপ ছাড়া আর কোন সাপের মানুষকে চেনার ক্ষমতা নেই বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কিন্তু পাখি বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন যে কাক সত্যিই বিদ্বেষ পোষণ করে। একটি সমীক্ষা অনুসারে, কাকেদের যদি কোনও মানুষের সাথে শত্রুতা হয় তবে তারা সেটা ১৭ বছর পর্যন্ত মনে রাখতে পারে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর জন মার্জলফের গবেষণা থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ২০০৬ সালে, কাকের প্রতিশোধস্পৃহা আছে কিনা তা বোঝার জন্য তিনি একটি পরীক্ষা করেছিলেন। পরীক্ষার সময়, তিনি একটি ভূতের মুখোশ পরেছিলেন এবং জাল দিয়ে সাতটি কাককে ধরেছিলেন। শনাক্ত করার জন্য তিনি তাদের ডানায় চিহ্ন দিয়ে রাখেন এবং তারপর তাদের অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেন। তবে তাদের মুক্তির পরও কাকগুলো তাঁকে অনুসরণ করতে থাকে। ক্যাম্পাসে যতবার তিনি মুখোশটা পরেছিলেন, ততবার তারা তাঁকে আক্রমণ করেছিল।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, অন্যান্য কাকও এই বিক্ষোভে যোগদান করে এবং এই আক্রমণগুলি সাত বছর ধরে চলতে থাকে। ২০১৩ সালের পর ধীরে ধীরে কাকের আগ্রাসন কমতে থাকে। তারপরে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে, পরীক্ষার ১৭ বছর পরে, প্রফেসর মারজলফ মুখোশ পরে বাইরে হাঁটছিলেন এবং প্রথমবারের মতো, কাকগুলি তাঁকে আক্রমণ করেনি বা চীৎকার করেনি। প্রফেসর মার্জলফ এখন এই চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার উপর তার গবেষণা প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেছেন।
প্রফেসর মার্জলফ তাঁর গবেষণার মাধ্যমে দেখতে পান যে কাকের মধ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো অ্যামিগডালা (মস্তিষ্কের একটি অঞ্চল যা প্রাথমিকভাবে আবেগগত প্রক্রিয়াগুলি বিশেষ করে ভয় এবং উদ্বেগের সঙ্গে যুক্ত) বা লিম্বিক তন্ত্র আছে। তিনি অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছিলেন যে কাকগুলি কেবল মানুষের আচরণই ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করে না, এমনকি মুখগুলিও চিনতে পারে।
যেসব কাক কারও কাছ থেকে বিপদের আশঙ্কা করে তাকে তারা মনে রাখতে পারে এবং মনের মধ্যে একটি ক্ষোভ পুষে রাখতে পারে, কখনও কখনও এটির বার্তা গোষ্ঠীর অন্যান্য কাকের কাছে পৌঁছে দেয়। রাগান্বিত কাকের সাথে মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা ‘দ্য বার্ডস’ বা ‘দ্য ক্রোজ’ হরর সিনেমার দৃশ্যের মতো মনে হতে পারে। সিয়াটেলের একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ জিন কার্টার, হাতেনাতে এটি শিক্ষা পেয়েছিলেন, যখন কাকরা তাঁকে তাঁর জানালার বাইরে থেকে প্রায় এক বছর ধরে নজরদারি চালিয়েছিল।
প্রফেসর শঙ্কুর ‘কর্ভাস’ সত্যিই অনন্য কাক ছিল কারণ মন্দ ম্যাজিসিয়ান আর্গাসের হাতে কিডন্যাপড হয়েও সে ‘ভেনডেটা’ বা প্রতিহিংসা নেয়নি – “উপরে চেয়ে দেখলাম— সত্যিই তো—আমার বন্ধু, আমার শিষ্য, আমার প্রিয় কর্ভাস গাছটার সবচেয়ে উঁচু ডালে বসে নিশ্চিন্তভাবে আমাদের দিকে ঘাড় নিচু করে দেখছে।
তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতেই সে অক্লেশে গোঁত খাওয়া ঘুড়ির মতো গাছের মাথা থেকে নেমে এসে বসল আমাদের মারসেডিসের ছাদের উপর। তারপর অতি সন্তর্পণে—যেন জিনিসটার মূল্য সে ভালোভাবেই জানে—তার ঠোঁট থেকে তার সামনেই নামিয়ে রাখল আর্গাসের মাইনাস বিশ পাওয়ারের সোনার চশমাটা।” সাবাস প্রোফেসর শঙ্কু – সত্যজিৎ রায় কর্ভাস (প্রোফেসর শঙ্কু)
(www.theoffnews.com crow revenge)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours