সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

আমরা জানি না, মেসোপটেমিয়ার লারসা শহরের (বর্তমান ইরাকের উরুকের প্রায় ১৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে) বসবাসকারী জিনু নাম্নী মহিলা প্রায় ৪,০০০ বছর আগে তাঁর ছেলে ইদ্দিন-সিনের কাছ থেকে চিঠিটি পেয়ে কী ভেবেছিলেন। যেমন আমরা জানি না অপুর কলকাতা থেকে পাঠানো পোস্টকার্ড পেয়ে মনসাপোতায় একা থাকা সর্বজয়ার মনের অবস্থা কী হয়েছিল। মা যখন ছেলের সান্নিধ্যের জন্য তড়পে তড়পে মরছেন, আক্ষরিক অর্থেই মারা যাচ্ছেন, তখন অপুর চিঠি এসে পৌঁছায়, চিঠিটা পড়ার পর সর্বজয়ার হাত থেকে ঝুপ্পুস করে পড়ে যায়, অপু লিখেছে পরীক্ষা আছে, আসতে পারবে না। যেমন আমরা জানি না অপুর পাঠানো দু’টাকার মানিঅর্ডার পেয়ে সর্বজয়ার মনে কী আলোড়ন হয়েছিল। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে আধশোয়া অপুকে অনিল জিজ্ঞেস করে “মনসাপোতা গেলি না? তোর মা রাগ করবেন না?” অপু বলে, “উঁহু, ওটা ম্যানেজ করে নিয়েছি। মাকে আজ মানিঅর্ডারে দুটো টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি।” 

ইদ্দিন-সিন ছোকরা সম্ভবত বিখ্যাত হামুরাবির রাজ্যের একটি ইস্কুলে পাঠরত ছিল এবং সে অত্যন্ত রাগান্বিত এবং অসন্তুষ্ট ভাবে অভিযোগ করেছিল যে তার মা তাকে যে জামাকাপড় পাঠিয়েছিলেন তা "খ্রিস্টপূর্ব ১৯ শতকের" ছিল, যখন তার বন্ধুরা সবাই ১৭৯০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের স্টাইলে ফ্যাশনেবল পোশাকে সুসজ্জিত ছিল।

রসিকতা থাক, লারসার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া প্রথম ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের সময় (১৭৯২ এবং ১৭৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের মধ্যে) লেখা একটি মাটির ট্যাবলেটে এই চিঠিটি পড়া যায়।

এটি কখন আবিষ্কৃত হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়, তবে ১৯২২ সালের মধ্যে ট্যাবলেটটি ল্যুভর মিউজিয়াম অধিগ্রহণ করেছিল এবং সেখানেই এটি বর্তমানে রাখা আছে। এটিতে খোদাই করা চিঠিটি বেলজিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক জর্জেস ডসিন ১৯৩৪ সালে  প্রথম প্রকাশ করেন, তখনই ইদ্দিন-সিন তার মা জিনুকে উদ্দেশ্য করে যে তিক্ত শব্দগুলি প্রয়োগ করেছিল সেগুলি জানা যায়।

ইদ্দিন-সিন লারসার অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিল, কারণ তার বাবা শামাশ-হাজির প্রশাসনের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। প্রথা অনুসারে, তাকে একটি মন্দিরে কিউনিফর্মে পড়তে এবং লিখতে শেখার জন্য এবং একজন আমলা, পুরোহিত বা লেখক হিসাবে কর্মজীবনের জন্য তৈরি হতে আবাসিক হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। চিঠিটিতে প্রাসঙ্গিক কোনও তথ্য না থাকলেও  গবেষকরা অনুমান করেছেন যে এই কারণেই ইদ্দিন-সিন বাড়ি থেকে দূরে থাকত।

১৯৬৭ সালে অ্যাসিরিওলজিস্ট অ্যাডলফ লিও ওপেনহেইম চিঠিটি অনুবাদ করেছিলেন যেখানে ইদ্দিন-সিন তার মাকে নতুন পোশাক না পাঠানোর জন্য অপরাধী বোধ করাবার চেষ্টা করেছে:

“শ্রীমতী জিনুকে বলুন যে ইদ্দিন-সিন নিম্নলিখিত বার্তা পাঠিয়েছে: দেবতা শামাশ, মারদুক এবং ইলাব্রত আমার জন্য আপনাকে সর্বদা ভাল রাখুন। বছরের পর বছর, এখানকার ভদ্র যুবকদের পোশাকের উন্নতি হয়, কিন্তু তুমি বছরের পর বছর আমার পোশাকের অবস্থা খারাপ হতে দিয়েছ। আসলে, তুমি আমার জামাকাপড়কে আরও ছেঁড়াখোড়া এবং গুটিকয়েকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করে যাচ্ছ। যে সময়ে আমাদের ঘরে রুটির মতো (যথেচ্ছ) উলের ব্যবহার করা হয়, (সেই সময়ে) তুমি আমাকে হতদরিদ্র পোশাক বানিয়ে দিয়েছ। আদাদ-ইদ্দিনামের ছেলে, যার বাবা আমার বাবার একজন সহকারী মাত্র, তার কাছেও দু’সেট নতুন জামাকাপড় রয়েছে, আর আমাকে এক সেট (নতুন পোশাক) দিতেও তোমার ইচ্ছে করে না। যদিও তুমি আমার জন্ম দিয়েছিলে এবং তার মা তাকে দত্তক নিয়েছিল, (তবু) তার মা তাকে ভালবাসে আর তুমি আমাকে ভালবাস না!”

প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার দৈনন্দিন জীবন বোঝার জন্য এই চিঠিটি একটি অসাধারণ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভাণ্ডার। এর থেকে বোঝা যায় যে জিনু তাঁর ভেড়ার পালের লোম থেকে তৈরি উল বা বাজারে কেনা উল দিয়ে তাঁর পরিবারের পোশাক তৈরি করতেন। তিনি সেগুলি কাটতেন, বুনতেন, রং করতেন এবং সেলাই করতেন যা কাপড়ের মানের ওপর নির্ভর করে প্রায় তিন মাস বা এমনকি পুরো এক বছর সময় নিতে পারত।

খুব সম্ভবত, জিনু হয়তো পড়তে জানতেন না, কারণ চিঠির শুরুতে "শ্রীমতী জিনুকে বলুন" থেকে বোঝা যায় এটি একজন অক্ষরজীবীর জোরে জোরে পড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল।

আমরা জানি না ইদ্দিন-সিন চিঠিটি নিজে লিখেছিল নাকি কোন লিপিকারকে দিয়ে শ্রুতিলিখন করিয়েছিলেন। "ইদ্দিন-সিন নিম্নোক্ত বার্তা পাঠায়" মেসোপটেমিয়ার চিঠিগুলিতে একটি স্ট্যান্ডার্ড ধাঁচা, যার থেকে বোঝা যায় এটি ডিক্টেশন দিয়ে লেখান হয়েছিল। অবশ্য, অ্যাসিরিওলজিস্টরা যেসব ত্রুটিগুলি চিহ্নিত করেছেন আর কিছুটা আনাড়ি লেখনী থেকে ধারণা করা হয় যে শ্রুতিলেখক অনভিজ্ঞ ছিলেন, সম্ভবত ইদ্দীন-সিনের মতোই একজন ছাত্র।

তার ওপর, যেহেতু ব্যবহৃত ট্যাবলেটের সামনে এবং পেছনের জায়গা ভরাট করার পরেও চিঠিটি শেষ হয়নি, তাই লেখক মার্জিনে লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তবে সে জায়গাও পূর্ণ হয়ে গেলে ট্যাবলেটের একেবারে নীচের দিকে শেষ করতে হয়েছিল।

ইদ্দিন-সিন তার সমবয়সীদের তুলনায় তার পোশাকের উৎকৃষ্টতা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিল, কারণ তার সামাজিক মর্যাদা ধনী দেখানোর ওপর বেশ খানিকটা  নির্ভর করত। এই কারণেই সে তার মাকে বিভিন্ন উপায়ে চালিত করার চেষ্টা করেছিল যার মধ্যে একটা তার দুর্ভাগ্যের জন্য মাকে দোষী বোধ করান ।

ঘটনা হল যে ৩,৮০০ বছরের পুরনো এই চিঠিটি থেকে বোঝা যায় যে কিছু জিনিসের কখনই পরিবর্তন হয় না।

(www.theoffnews.com letter Iddin Sin Louvre Museum)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours