মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:
"কষ্ট ভঞ্জন " নামটা শুনেই মনটা শান্ত হয়ে যায়, মনে হয় সত্যিই যদি কেউ পারেন সব কষ্ট তা সে শরীরেই হোক আর মনের যদি দূর হয় তবে আর কিছু কি চাওয়ার থাকতে পারে। আহমেদাবাদ থেকে ১৮৬ কিলোমিটার দূরে সারণপুরে রয়েছে খুবই জাগ্রত হনুমানজির মন্দির। আমরা ৬ জন বন্ধু মিলে একটা গাড়ি বুক করে "মঙ্গলে ঊষা বুধে পা" মাথায় রেখে ভোর সাড়ে ৬ টায় যাত্রা শুরু করলাম। মন্দির বেলা ১২ টার মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়, তাই এই সাত তাড়াতাড়ি বেরোনো।
পথে একবার তেল ভড়তে দাঁড়ানো ছাড়া আর থামিনি আমরা, ফ্লাস্কে চা বানিয়ে এনেছিল এক বান্ধবী, সাথে ছিল বিস্কিট, তাই সাড়ে ১০ টা নাগাদ পৌঁছে গেছিলাম।
বিশাল প্রাঙ্গণ জুড়ে মন্দির,পরিষ্কার ঝকঝকে। পুজো টাকা দিয়েই দিতে হয়ে, আর প্রসাদ মন্দিরের তরফ থেকেই বাইরে বিক্রি হচ্ছে, ২৫ টাকারও নিতে পারো, ৫০০ টাকারও।
মন্দিরে শনি, মঙ্গলবার ভিড় হয় বেশি, আমরা ফাঁকায় ফাঁকায় দর্শন করলাম। অপূর্ব কারুকার্য, সিংহাসনের বাইরে চারপাশ এমন কাঠে বানানো যা সহজে নষ্ট হয় না। এছাড়াও সিংহাসন সোনায় মোড়া, হনুমনজির শৃঙ্গার নাকি এক এক দিন এক এক রকম। কখনও ফলের, কখনও সব্জির, আমরা দেখলাম প্রচুর শুকরি (প্রচুর শুকনো আটা আর গুর ড্রাই ফ্রুটস দিয়ে ঘি মিশিয়ে বানানো) ভোগ লাগানো হয়েছে, সেগুলোই ছিল প্রসাদে। যে যা ইচ্ছে প্রনামী দিয়ে প্রণাম করে চলে যাচ্ছে। এখানে হাস্যমুখে হনুমানজি, পাশেই ভারী সুন্দর বিষ্ণু মন্দির। এছাড়াও দূরে বিশাল হনুমানজীর লোহার মূর্তি দেখা যাচ্ছিল। মনে হল রাতে থাকার সুব্যবস্থা আছে। কারণ দূর দূরান্ত থেকে লোকে আসে এই কষ্ট ভঞ্জন হনুমানজীর দর্শন করতে, মানত করতে।
প্রণাম সেরে সবাই গেলাম ক্যান্টিনে। লাইন দিয়ে একদিকে পুরুষ একদিকে মহিলারা থালা বাটি নিয়ে দাঁড়ালেই হাতে গড়া দুটো রুটি, জিরা রাইস, বাটিতে ডাল, দু রকম সব্জি হালুয়া দিয়ে দিচ্ছেন সেবায়েতরা। দ্বিতীয়বার সব কিছুই পাবেন তবে একটু পাশে তাদের কাউন্টার, স্টিলের টেবিল চেয়ার বসে খাও, ওপরে ফ্যান আছে, সুন্দর মুখ ধোয়ার জায়গা থালা নামানোর ব্যবস্থা-- সব কিছুই কি সুন্দর পরিষ্কার, শৃঙ্খলাবদ্ধ আর সুচারু। পুরো খাওয়া বিনামূল্যে _--এক পাশে ডোনেশন বক্স আছে চাইলে দিতে পারেন কেউ। প্রত্যন্ত গ্রামে এমন সুন্দর বন্দোবস্ত আমরা কেউ ভাবতেই পারিনি।
দূর দূরান্ত থেকে মানসিক রোগীদের আনানো হয় এখানে ঈশ্বরের কৃপায় যাতে সুস্থ হয়ে ওঠেন, ভূত পিশাচ তাড়ানোর পূজো হয় শনি মঙ্গলবারে। এসব হয়তো যার যেমন বিশ্বাস, মানো ইয়া না মানো কিন্তু প্রচুর মানুষের এই যে ভরসা, আশায় বুক বেঁধে আসা, সব সারিয়ে দেবেন 'তিনি' ---এই ভেবে যে আত্মসমর্পন! সেও তো এক ধরনের পজিটিভ এনার্জি।
ধর্ম কি আমি খুব ভালো বুঝি না। এই যে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষগুলোকে বিনামূল্যে খাওয়ানোর ব্যবস্থা রেখেছে, শারীরিক ভাবে, মানসিক ভাবে অসুস্থ কাতারে কাতারে মানুষ আসছেন এক টুকরো আশায় বুক বেঁধে "সব ঠিক হয়ে যাবে!" আমার কাছে এখানেই ধর্মের সার্থকতা । সব ধর্মে কিন্তু অসুস্থ, আতুরের সেবার কথাই বলে থাকে, তাকে নিয়ে ব্যবসা করে কিছু অশুভ বুদ্ধির মানুষ। লোকে বলে মন্দির নাকি এক ধরনের ব্যবসা। কিন্তু এভাবেই যদি কালো টাকা সাদা হয়ে কিছু গরীব মানুষ দু মুঠো খেতে পান এক বেলা সেও তো ধরনের পূজাই!
এখানে এক জায়গায় পিতলের বড় হনুমানজীর মূর্তি আছে যেখানে এক হাতে নারকেল দিলে সেটা দু টুকরো হয়ে অন্য হাত দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
এছাড়া ছিল খাদির শোরুম, হনুমানজীর মুর্তি স্যুভেনির বিক্রির দোকান। টুকটাক কেনাকাটা সেরে আমরা ৬ মুর্তি ফেরার রাস্তা ধরলাম। পথে নেমে গাঁয়ের লোকেদের কাছ থেকে সব্জি কেনাকাটাও হলো, সব মিলিয়ে এক দিন ভারী সুন্দর দেব দর্শন সাথে নতুন জায়গা ভ্রমণও হয়ে গেল।
(www.theoffnews.com Saranpur Hunumanji Temple)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours