সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
সিল্কের সুতোর সাহায্যে বিপদের হাত থেকে বেঁচে যাবার ঘটনা খুব বেশি বীরের জীবনে শোনা যায় না, কিন্তু থিসিয়াস'এর জীবনে এটা সত্যি সত্যি ঘটেছিল। এই গ্রীক বীর বিখ্যাত তাঁর শৌর্যবীর্যের জন্য। কিন্তু তাঁকে এখনও মানুষ মনে রেখেছে তাঁর ঐশ্বরিক জ্ঞান আর বুদ্ধির জন্য। যৌবনে তিনি বহু যুদ্ধের সফল নায়ক কিন্তু তাঁর শেষ পরিণতি এক হৃদয়বিদারক মৃত্যু - অন্তরীণ অবস্থায় একজন হতোদ্যম রাজা হিসেবে।
জীবন যুদ্ধের শুরু:
ট্রেজেন'এর রাজা পিথ্যুস'র মেয়ে অ্যাথরা হলেন থিসিয়াসের মা যিনি তাকে একা হাতে বড় করেন যদিও তার বাবা আবার দু’জন। একজন হলেন অ্যাথেন্সের রাজা এজিয়াস যিনি ডেলফির আকাশবাণীর পরামর্শ অনুযায়ী তাঁর উত্তরাধিকারী খুঁজবার জন্য ট্রেজেন'এ যান। অ্যাথরা'কে বিয়ে করে তাকে ছেড়ে চলে যাবার আগে তিনি বলে যান যদি তাঁর ছেলে হয় আর সেই ছেলে যদি একটা বিশেষ পাথর সরাতে পারে আর তার তলা থেকে তাঁর রেখে যাওয়া তরবারি আর স্যান্ডাল জুতো পুনরুদ্ধার করতে পারে, তাহলে অ্যাথরা যেন তাকে অ্যাথেন্সে পাঠিয়ে দেন। থিসিয়াসের অন্য বাবা ছিলেন পাতালের রাজা পসিদন যিনি বিয়ের রাত্রে সমুদ্র তীরে হাঁটার সময় অ্যাথরা'কে সঙ্গ দান করেছিলেন।
থিসিয়াস বড় হয়ে খুব সহজেই ভারী পাথরটা সরিয়ে তার বাবার গচ্ছিত সামগ্রী বের করে আনলেন। ফলে তার মা তাকে অ্যাথেন্সে যাবার পথ নির্দেশ দিতে বাধ্য হলেন। অপেক্ষাকৃত নিরাপদ সমুদ্রযাত্রার বদলে থিসিয়াস স্থলপথে ভ্রমণ বেছে নিলেন। যদিও তার অজানা ছিল না যে পথে বহু বিপদ তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। পথিমধ্যে তাকে ছ’টি ভয়ঙ্কর লড়াই করতে হয়েছিল। চারজন ডাকাত, একটি রাক্ষুসে বনবরাহ এবং একজন দৈত্য, এই ছ’জনকে তিনি স্বীয় শারীরিক ক্ষমতা আর ক্ষুরধার বুদ্ধি দিয়ে পরাস্ত করলেন।
অ্যাথেন্সে পৌঁছে থিসিয়াস বাবার কাছে আত্মপ্রকাশ করলেন না। এজিয়াস ততদিনে জাদুকরী মেডিয়াকে বিয়ে করেছেন। সে থিসিয়াসকে চিনে ফেলে। প্রথমেই সে থিসিয়াসকে ম্যারাথনের ষাঁড়কে ধরার মত ভয়ানক বিপজ্জনক এক কাজ দেয়। এতেও যখন তিনি সফল হলেন মেডিয়া তখন তাকে বিষ মেশানো মদিরা পান করতে দিল। এজিয়াস ষড়যন্ত্রটা জানতেন কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি লক্ষ্য করলেন থিসিয়াস তাঁর স্যান্ডালটা পরে আছে আর তাঁর তরবারিটাও তার কাছে। তৎক্ষণাৎ তিনি তার হাত থেকে পানপাত্রটা ফেলে দিলেন। মেডিয়া এশিয়ায় পালিয়ে গেল। এজিয়াস থিসিয়াসকে স্বাগত জানিয়ে তাকে তাঁর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করলেন।
মিনেটুরের সঙ্গে লড়াই:
কিছুদিন পর থিসিয়াসের জীবনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হলো। প্রতি সাত বছর অন্তর ক্রীট দ্বীপের রাজা মাইনস অ্যাথেন্সকে বাধ্য করতো সাতজন সাহসী যুবক এবং সাতজন সুন্দরী যুবতীকে মিনেটুরের কাছে উৎসর্গ করার জন্য পাঠাতে। মিনেটুর, একটি অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ষাঁড়, বাস করত মাইনসের দুর্গে জটিল একটি গোলকধাঁধায়। এই উৎসর্গের রীতি চালু হয়েছিল মাইনসের ছেলে অ্যান্ড্রোজেনাস অলিম্পিক খেলা চলাকালীন অ্যাথেন্সে অজ্ঞাত আততায়ীর নিহত হওয়ার পর মাইনস যাতে অ্যাথেন্সকে আক্রমণ না করে। থিসিয়াস, মিনেটুরকে হত্যা করে এই নিষ্ঠুর রীতি বন্ধ করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় সাতজনের একজন হিসেবে রওনা হয়। এতে এজিয়াস হতমান হয়ে পড়লেও থিসিয়াসকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করান যে সে যদি সফল হয় তাহলে ফিরতি পথে সে জাহাজের কালো নিশানগুলোর বদলে সাদা পতাকা ওড়াবে।
ক্রীটে পৌঁছবার পর রাজা মাইনসের মেয়ে অ্যারিয়াডনী থিসিয়াসের প্রেমে পড়ে তাকে কথা দেয় যে যদি সে তাকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাথেন্সে ফিরে গিয়ে বিয়ে করবে তাহলে সে ওই ভুলভুলাইয়া থেকে বেরতে সাহায্য করবে। থিসিয়াস রাজী হয়ে যায়। অ্যারিয়াডনী তাকে একটা সিল্কের সুতোর গোলা, একটা তরবারি আর ওই ভুলভুলাইয়ার স্থপতি ডেডালাসের কাছ থেকে ওটা থেকে বেরবার পথনির্দেশ এনে দেয় – ভুলভুলাইয়ায় ঢুকে সোজা নিচের দিকে এগিয়ে যেতে হবে, ডাইনে বাঁয়ে কোনদিকে বাঁকলে চলবে না।
থিসিয়াস আর অ্যাথেনিয়ান্সরা ভুলভুলাইয়ায় ঢুকে দরজার কাছে সুতোটার একপ্রান্ত বেঁধে দিয়ে বাকী অংশটা ছাড়তে ছাড়তে তারা রওনা হ’ল। নাক বরাবর হাঁটতে হাঁটতে তারা গোলকধাঁধার কেন্দ্রস্থলে পৌঁছল যেখানে মিনেটুর ঘুমিয়েছিল। থিসিয়াস তাকে আক্রমণ করলে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধ চলল মিনেটুর না মরা পর্যন্ত। তারপর তারা সুতো ধরে ধরে দরজার কাছে ফিরে এলো আর অপেক্ষমাণ অ্যারিয়াডনীকে নিয়ে জাহাজে উঠে পড়ল – কী ঘটেছে মাইনস বুঝে ওঠবার আগেই।
সে রাত্রে থিসিয়াস সম্ভবত দেবতা ডাইওনাইসাসের পাঠানো একটা স্বপ্ন দেখল যাতে সে আদেশ পায় তাকে অ্যারিয়াডনীকে পরিত্যাগ করতে হবে কারণ তার ভাগ্যে অন্য কথা লেখা আছে। সকালে ন্যাক্সজ দ্বীপে ক্রন্দনরতা অ্যারিয়াডনীকে ফেলে রেখে থিসিয়াস অ্যাথেন্সের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ভগ্নহৃদয়ে, সম্ভবত অ্যারিয়াডনীর অভিশাপের ফলে, থিসিয়াস জাহাজের কালো পতাকাগুলো পাল্টে সাদা পতাকা ওঠাতে ভুলে গেল। আগুয়ান জাহাজে কালো পতাকা দেখে থিসিয়াসের বাবা মনে করলেন যে ছেলে নিহত হয়েছে। এজিয়াস খাড়া বাঁধ থেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেহত্যাগ করলেন। গ্রীসের পূর্বদিকের সমুদ্রকে এখনও ‘এজিয়াস সী’ বলা হয়। অ্যারিয়াডনী পরে ডাইওনাইসাসকে বিয়ে করে।
অ্যাথেন্সের রাজা:
এজিয়াস মারা যাওয়ার পর থিসিয়াস অ্যাথেন্সের রাজা হলেন। তাঁর সুশাসনে প্রজারা শান্তি ও সমৃদ্ধিতে বাস করত। তিনি সবাইকে একত্রিত করে অ্যাথেন্সকে একটি মজবুত রাষ্ট্রে পরিণত করেন। যেহেতু তাঁর কিছু ক্ষমতা ‘অ্যাসেম্বলী’-কে দিয়েছিলেন তাই তাঁকে গণতন্ত্রের রূপকার বলা হয়। রাজা হওয়ার পরও তাঁর অসীম সাহসী অভিযান অব্যাহত ছিল।
এই রকম একটি অভিযানে থিসিয়াস তাঁর বন্ধু পিউরিথাস'র সঙ্গে পাতাল প্রবেশ করেন কারণ সে পারসেফনিকে অনুসরণ করছিল। দুই বন্ধু পাথরের ওপর বিশ্রাম নিতে বসেছিলেন কিন্তু পরে দেখলেন যে তাঁরা ওই পাথর থেকে নড়তে পারছেন না। এইভাবে তিনি বহু মাস আটক হয়ে থাকলেন যতক্ষণ না তাঁর খুড়তুতো ভাই হেরাক্লিস তাঁকে উদ্ধার করল যে পাতালে তার দ্বাদশ কর্মভার সম্পন্ন করতে এসেছিল। ইতিমধ্যে ফিউরিজরা পিউরিথাসকে ধরে নিয়ে চলে গিয়েছিল বলে তাকে আর উদ্ধার করা সম্ভব হ্য়নি।
অ্যামাজনের রানি ইপ্পোইতার (হিপ্পোলিটা) কোমরবন্ধনী উদ্ধারের জন্য থিসিয়াস আরও একবার হেরাক্লিসের সঙ্গে অভিযান করেছিলেন। সফল অনুসন্ধানের পর থিসিয়াস রাণিকে বিয়ে করেন আর তাঁদের ছেলের নাম ইপ্পোলিতস্।
(www.theoffnews.com Theseus)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours