দেবর্ষি মজুমদার, সিনিয়র জার্নালিস্ট, বীরভূম:

কাজল কিসিসে কম নেহি। মিলন মেলায় মাথায় রাজ মুকুট পরে কাজলের শরীরী ভাষা এমনটাই বলে মনে হতে পারে। পাক্কা পাঁচ কেজি রূপোর তৈরি। কাজল ভাইয়ের অভিষেক দেখে দেখে যাদের চোখ টাটায়, তারা ঠারে ঠারে বুঝলেও মানতে চাইছেন না, কাজল শেখ এখন জেলার বেতাজ বাদশা। একটা সময়ে কেষ্ট যখন বীরভূমের বেতাজ বাদশা, তখন বহু মামলায় জর্জরিত কাজল আণ্ডার গ্ৰাউণ্ডে। "তব এ ডর কিসকো আচ্ছা লাগা, এ কোন কোন মে মালুম থা।" এই উক্তি কট্টর কাজল অনুগামীদের। তাই যেন কাজলের ভাব -- "হাম কিসিসে কম নেহি।" অনুব্রত মণ্ডল কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর কপাল খুলে যায় কাজল ওরফে ফায়েজুল শেখের। একপ্রকার জেলার তখত্ দখল করে নেন তিনি। তিনি হয়ে ওঠেন জেলার অবিংশবাদী নেতা। তাই অনুব্রত জামিনে মুক্ত হলে তার বাড়া ভাতে ছাই ফেলতে দেবেন না, এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। অনুব্রত জেলে যাওয়ার পর, অনেক দলীয় স্তরের নেতা কর্মীরা বলেন, বাঘকে বেশি দিন খাঁচায় রাখা যায় না। তখনও যথারীতি কাজলের ফেসবুক পোষ্ট আলোড়ন ফেলেছিল। কাজল অনুব্রতকে বাঘ মানতেই চান নি। নাম না করে অনুব্রতকে তার তির্যক আক্রমণ বজায় ছিল। অনুব্রতর অনুপস্থিতিতে তার ঘনিষ্টদের সাইজ ও সাইড করে দিয়েছিলেন কাজল। তার সাম্প্রতিক সংযোজন কঙ্কালীতলা পঞ্চায়েতের অঞ্চল সভাপতি শেখ মামনকে অপসারণ। এই অনুব্রত ঘনিষ্টকে পঞ্চায়েতে প্রাণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে না, এমন অভিযোগও প্রশাসনের কাছে করা হয়েছে। অনুব্রত জেল থেকে ফিরে তার মেয়ের প্রভাবে দেখা না করায় কাজল ফ্রন্টফুটে খেলতে জায়গা পায়। নিজের ভুল তড়িঘড়ি সংশোধন করে নেওয়ায় ফের অনুব্রতর পুরানো চাল ভাতে বাড়ে। 

কাজল জেলায় একমাত্র এবং অবশ্যই দ্বিতীয় অনুব্রত। আর অন্য অনুব্রত কাউকে চাইছে না। এমনটি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে, বলে অনেকের ধারণা। 

আগে অনুব্রত মণ্ডলকে রূপোর মুকুট, রূপোর তরোয়াল, রূপোর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূর্তি প্রভৃতি উপহার দেওয়ার নজির আছে। সাধারণত মিলন মেলা ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই প্রথা চালু হয়৷ এবার অবশ্য চালু হলো নয়া টুইস্ট! 

বুধবার নানুরের মিলন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রায় ৫ কেজি ওজনের রূপোর মুকুট পরানো হল বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখকে৷ যা নিয়ে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছে। কিন্তু অনুব্রত মণ্ডলকে দেওয়া রূপোর মুকুট, রূপোর তরোয়াল, রূপোর তলোয়ার আজ কোথায়? কাজল সেই পথেই হাঁটছে। তৃণমূলের অনুগামীরা অভিযোগ তুলছে, মামা ভাগ্নে - ভাইপো রসায়ন চলছে জেলায়। দু-একটি মিডিয়া কুক্ষিগত করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রয়াস অব্যাহত আছে। শুধু নানুর যে দলের কাছে তুরুপের তাস নয়, গোটা জেলা ধরে রাখতে অনুব্রত ফ্যাক্টর অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই দলের কাছে। আর সেকারনেই কাজল কেষ্ট হতে চাইছেন। অনেক কিছুর মতোই মেলার দখল নিয়েছে কাজল শিবির। তাই এই মেলার নেপথ্যে বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি ফায়জুল হক ওরফে কাজল শেখ। উল্লেখ্য, মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ ছিল দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের। কিন্তু, তিনি অনুপস্থিত ছিলেন৷ এবার মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্বোধককে প্রায় ৫ কেজি রূপোর রাজ মুকুট পরানো হল অনুব্রতর যুযুধান হিসাবে পরিচিত কাজল শেখকে৷ রুপোর ওই মুকুট থুপসরা গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল কর্মী সমর্থকরা কাজল শেখের মাথায় পরিয়ে দেন। কিন্তু এই বছর প্রথম থেকেই কে এই উপহার পাবেন তা নিয়ে কৌতুহল ছিল। অবশেষে কাজল শেখের মাথায় রুপোর মুকুট যেতেই সেই জল্পনার অবসান ঘটলো। যা নিয়ে রীতিমতো শোরগোল জেলার রাজনৈতিক মহলে৷ কারন, এর আগে একাধিকবার এই মিলন মেলার উদ্বোধনে অনুব্রত মণ্ডলকে কখনো রূপোর মুকুট, কখনও রূপোর তরোয়াল উপহার হিসাবে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, এবার অনুব্রত বীরভূম জেলায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও রূপোর রাজ মুকুট পরলেন কাজল শেখ৷ 

বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখ বলেন, "মিলন মেলা মিলন ক্ষেত্র৷ ৭ দিন ধরে সবাই আনন্দ উপভোগ করবে৷ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে। দলের ছেলেরা ভালোবেসে কিছু উপহার দিয়েছে।" 

২০২১ সালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনুব্রতকে মেলা কমিটির তরফে একটি রুপোর মুকুট উপহার দেওয়া হয়েছে। সেটি জেলা সভাপতির মাথায় পরিয়ে দেন পঞ্চায়েত কর্মাধ্যক্ষ করিম খান। 

২০২২ সালে রূপোর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিকৃতি দেওয়া হয় অনুব্রতকে। কিন্তু তারপরেই দীর্ঘ আড়াই বছর অনুব্রত জেল বন্দি থেকেছেন। ওই মেলার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় কাজল শেখের হাতে। এখন অনুব্রত দলের জেলা সভাপতি। কোর কমিটির চেয়ারম্যান। তবুও অনুব্রত গড়ে রূপোর রাজ মুকুট উঠল কাজল শেখের মাথায়। ফলত এই নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। যদিও এই নিয়ে কেউ মুখ খুলতে নারাজ।

২০২৫'এ তৃণমূল-কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে নানুরের বাসাপাড়া মিলন মেলায় অনুপস্থিত ছিলেন অনুব্রত৷ মেলার সূচনা করলেন কাজল শেখ। প্রসঙ্গত, নানুরের বাসাপাড়ায় মিলন মেলার মাঠ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। একাধিক মানুষের জমি দখল করে গড়ে উঠেছে এই মেলার মাঠ৷ তাই অন্য মাঠে বসানো হয়েছে মিলন মেলার আসর৷ 

১ জানুয়ারি তৃণমূল-কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা দিবস৷ প্রতিও বছর এই দিন নানুরের বাসাপাড়ায় একটি মেলার আয়োজন করা হয়৷ সেই মতো এদিন থেকে শুরু হল মিলন মেলা৷ ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে মেলাটি৷ তবে প্রতি বছর মেলার আয়োজন করে এসেছে তৎকালীন বীরভূম জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ আব্দুল করিম খান৷ যিনি অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত। প্রসঙ্গত, এই মিলন মেলার মাঠ৷ অর্থাৎ বাসাপাড়ার মেলার মাঠটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অভিযোগ, মেলার মাঠটি কার্যত স্থানীয় লোকজনের থেকে বলপূর্বক লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই মর্মে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে লিখিত অভিযোগ হয়েছিল৷ অনেকে বলেন, এই অভিযোগ ধূমায়িত করার পিছনে নাকি ছিল কাজল। যদিও কাজল এই অভিযোগ উড়িয়ে দেন। তথাপি এই বিষয়টি প্রশাসনিক তদন্তের মধ্যে আছে৷ আর এই অভিযোগের ফলে অনুব্রত ঘনিষ্ঠ আব্দুল করিম খানকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে টিকিট দেয়নি দল৷ এ যেন অদ্ভুত প্রেম! হয় তুমি আমার, নয়তো কারও নয়।

(www.theoffnews.com Birbhum TMC Anubrata Mondal Kajal Shekh silver cap)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours