সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

(বাংলার ঐতিহ্য রক্ষা, সুসমন্বিত পর্যটন ও গ্রামীণ অর্থনীতির সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন)

সবার কানে মধুর না শোনালেও এই প্রসঙ্গে দু’একটি কথা গ্রাম বাংলার অস্তমিত ঐতিহ্যের অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে অবশ্যই বলা উচিত। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলার অধিকাংশ গ্রামে প্রত্নস্থল বা/এবং পুরাসৌধের উজ্জ্বল (অধুনা অনেকাংশে নিষ্প্রভ) উপস্থিতি, কিন্তু বাঁকুড়া জেলা বোধ হয় যক্ষের বরপুত্র। প্রায় প্রতিটি গ্রামে, নদীর পাড়ে অথবা খাতে, বনে জঙ্গলে সমৃদ্ধ প্রত্নস্থল এবং সুষমামন্ডিত পুরাসৌধের দেখা মিলবে। স্বাভাবিক কারণেই হয়তো বিষ্ণুপুর বহুল প্রচারিত, সর্বাধিক পরিচিত ও সর্বাপেক্ষা আলোকিত। কিন্তু বিষ্ণুপুরের কয়েকটি ভাগ্যবান মন্দির এতে লাভবান হলেও বিষ্ণুপুরের অন্যান্য ভাগ্যহীন পুরাস্থাপত্য ও সামগ্রিক বাঁকুড়া জেলার অধিকাংশ প্রত্নস্থল এবং পুরাসম্পদ অবহেলিত, অনালোকিত, অসংস্কৃত অবস্থায় কালের গর্ভে বিলীয়মান হয়ে গেছে বা হতে চলেছে। এই অবস্থা থেকে কি কোন নিস্তার নেই? আমরা ছায়াযুদ্ধের জুজু দেখিয়ে প্রতি বছর লক্ষ কোটি টাকার সমরাস্ত্র সংগ্রহ করি কিন্তু স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ প্রতি বছর কমে যাচ্ছে কিন্তু এই টাকা জনগণের অথচ তাদের কোনও অধিকার নেই এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার। জনগণের করের টাকায় কোটি কোটি টাকার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্য সাধিত হয় কিন্তু অধিকাংশ খননের কোন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় না। জনগণের কেন অধিকার থাকবে না আমাদের দেশের প্রাচীন ইতিহাস জানার?

একথা সত্য, ভারতীয়রা বিশেষ করে বাঙ্গালী জাতি ইতিহাস বিমুখ। আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বহু প্রাচীন ও সমৃদ্ধশালী। সম্ভবত প্রাচুর্যের কারণে প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র অনুরাগ নেই, সব খরচের খাতায়। কিন্তু যে সব দেশের ইতিহাস অর্বাচীন কালের এবং হাতেগোনা পুরা বা প্রত্নসম্পদের মালিক তারা নিজেদের ইতিহাস সম্বন্ধে অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল এবং ঐতিহ্য রক্ষায় ততটাই যত্নবান। জনসংখ্যা, জমির ক্রমবর্ধমান চাহিদা, দূষণ, দারিদ্র, জলবায়ু – এগুলিও অবশ্যই আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষার পরিপন্থী কিন্তু আমাদের সামাজিক শিক্ষার মধ্যে ‘শ্রদ্ধা’ আত্মস্থ করার স্থান না থাকার ফলে আমরা কোনও কিছুর প্রতিই শ্রদ্ধাশীল হতে পারিনি। ১৮৫৬ সালে জন এবং উইলিয়াম ব্রান্টন, ব্রিটিশ এঞ্জিনীয়ার, করাচি থেকে লাহোর রেললাইনের ট্র্যাকে ব্যালাস্টের জন্য হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর প্রাচীন ইঁট ব্যবহার করেছিল, ২০১৮ সালে বর্ধমান জেলার খানো গ্রামে প্রত্নঢিবি কেটে গ্রাম সড়ক যোজনা প্রকল্পে তৈরি রাস্তায় ফিলার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে – এটাই জাতীয় ট্র্যাজেডি।

ঐতিহ্য রক্ষায় শুধু সরকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে হাত ধুয়ে বসে থাকলে চলবে না, প্রত্যেক গ্রাম ও শহরবাসীকে উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। পুরা বা প্রত্নসৌধ সংরক্ষণে প্রথমেই সরকারী অধিগ্রহণের শিলমোহরের প্রয়োজন, তবেই অভিজ্ঞ স্থপতি, দক্ষ রেস্টোরার (পুনরূদ্ধারকারক)ও শ্রমিক, অপর্যাপ্ত অর্থের যোগান মিলবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে। এই সরকারী শিলমোহর পাওয়া সবথেকে কঠিন, এর জন্য প্রচুর কাঠখড় পোড়ালেও সেটা যে পাওয়া যাবেই এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। অধিগ্রহণ করলেও লটারি লেগেছে মনে করবেন না, কারণ এখন সরকার অনেক সময় স্থানীয় ঠিকাদারদের দিয়ে কাজ করায় যাতে ভালর থেকে মন্দ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অধিগ্রহণ করাতে ও সঠিক পদ্ধতিতে পুরা বা প্রত্নসৌধ সংরক্ষণ করাতে সর্বক্ষেত্রে, সর্বসময় মাস মুভমেন্ট বা গণ আন্দোলন এবং সর্বক্ষণের নজরদারি দরকার। 

আঞ্চলিক ইতিহাসকে জানা শুধু মুষ্টিমেয় লোকের শখ বা পাগলের খেয়াল নয় আর পুরাসম্পদ সংরক্ষণ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গ্রামীণ এবং শহুরে অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর নির্মাণ (সেতু, রাস্তাঘাট, রাস্তার ওপর খাবার- থাকার পরিচ্ছন্ন ন্যায্যমূল্যের হোটেল, পরিশ্রুত জল, শৌচাগার ইত্যাদি) ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আঞ্চলিক পর্যটন ব্যবস্থা ও পর্যটকের দাক্ষিণ্যের ওপর। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মত ক্ষুদ্রাকার দেশ এবং আমাদের দেশের হরিদ্বার, দার্জিলিং, কাশ্মীর যদি সম্পূর্ণভাবে পর্যটন নির্ভর হতে পারে তাহলে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের ধর্মীয় এবং অসামান্য স্থাপত্যশৈলীর পুরাসম্পদ সমৃদ্ধ গ্রাম ও শহরগুলি পর্যটকের অবশ্য গন্তব্যস্থল হয়ে উঠতে পারবে না কেন? বাঙালীরা নিজেরা কেন দীপুদা- মানসিকতার বাইরে বেরতে পারবে না? এখন কিন্তু বহু মানুষ শহরের কোলাহল থেকে দূরে কিন্তু বহুদূরে নয় এমন নিরিবিলি জায়গায় দু’চারদিন নিশ্চিন্তে সময় অতিবাহিত করতে আকুল হয়ে ওঠেন – তাঁদের জন্য পাহাড়ের ‘হোম স্টে’ দু’হাত বাড়িয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাচ্ছে কিন্তু আমরা সমতলে ‘পিজি’ বা ‘পেয়িং গেস্ট’ সিস্টেমে অভ্যস্ত হলেও ‘হোম স্টে’ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না। অথচ এটির সম্ভাবনা বিপুল। বিষ্ণুপুরের কথাই ধরা যাক। পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন বিভাগের নিরন্তর প্রচারে বিষ্ণুপুরের খ্যাতি রাজ্য ছাড়িয়ে, দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে – তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুফল ভোগ করছেন বিষ্ণুপুরবাসী। বিষ্ণুপুর শহরের রাস্তাঘাটের পরিকাঠামো যদি আরও উন্নত হতো, বিষ্ণুপুরবাসী ও পর্যটকরা আরও উপকৃত হতেন। কিন্তু বিষ্ণুপুর শহরের সন্নিকটে এবং অনতিদূরে অসাধারণ পুরাসম্পদে সমৃদ্ধ সুপ্রাচীন গ্রামগুলি চোখের আড়ালেই থেকে গেছে অথচ সামান্য একটু প্রচার পেলে গ্রামগুলির অধিবাসীবৃন্দ এবং পর্যটকরা উভয়েই লাভবান হতেন। দুর্গাপুর স্টেশন বা দুর্গাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বিষ্ণুপুরের দিকে আসতে এক্তেশ্বর – সোনাতপল – এল্যাটি – বহুলাড়া – অযোধ্যা – ধরাপাট – জয়কৃষ্ণপুর – অবন্তিকা – ডিহর প্রভৃতি গ্রামগুলি নিয়ে একটি ‘ট্র্যাভেল প্যাকেজ’ করা যায়, পাশাপাশি গ্রামগুলিতে ‘হোম স্টে’র ব্যবস্থা করা যায়। আবার একইভাবে বিষ্ণুপুরের দিক থেকেও দুর্গাপুরের দিকে এই সফরের ব্যবস্থা করা যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য ঝিলিমিলি- মুকুটমণিপুর, শুশুনিয়া পাহাড়, বিহারীনাথ পাহাড় যেভাবে বহুল বিজ্ঞাপিত ও প্রচারিত তেমনি এই গ্রামগুলি এবং বাঁকুড়ার আরও অসংখ্য গ্রাম নিয়েও প্রচার করা যেতে পারে।

কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটন মন্ত্রক অতি সম্প্রতি (অক্টোবর ২০১৮) দূরশিক্ষার মাধ্যমে ‘গ্রামীণ ঐতিহ্য প্রদর্শক’ পাঠক্রমের ব্যবস্থা করেছে। আঞ্চলিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে আগ্রহী ছেলেমেয়েরা এই শিক্ষা সম্পূর্ণ করে স্থানীয় পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বনির্ভর হতে পারে। 

অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি” বইয়ে অযোধ্যা গ্রামের “বন্দ্যোপাধ্যায় উপাধিধারী স্থানীয় জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠিত পুরাকীর্তিগুলি গ্রামের প্রধান দ্রষ্টব্য” বলে উল্লেখ করেছেন এবং পুরাকীর্তিগুলির বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন যেগুলি কমবেশি দুশো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই পরিবারের রথটি নির্মিত হয়েছিল “১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে”। কিন্তু গ্রামের সবচাইতে প্রাচীন (স্থাপিত ৯৫৮ মল্লাব্দ + ৬৯৬ = ১৬৫৪ খ্রিস্টাব্দ) ও আকর্ষণীয় পাথরের মন্দিরটি সম্বন্ধে তাঁর এক লাইনের মন্তব্য – “গ্রামের অন্যত্র পাথরের এক চারচালা মন্দির আছে বলে শুনেছি।” সম্প্রতি (২রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮) অযোধ্যা গ্রাম পরিদর্শনের সময় জিজ্ঞাসা করে ওই মন্দিরটির সন্ধান পাওয়া গেল। মন্দিরটির অবস্থা শোচনীয়, মন্দিরের গায়ে বেড়ে উঠেছে বড় বড় গাছ এবং লতার নিষ্পেষণে মন্দিরটির প্রাণ ওষ্ঠাগত আর মন্দিরটির পিছনের দিকটি প্রায় ধ্বংসের মুখে। মন্দিরটির সামনেটা পুরো আড়াল করে একটি কালীমন্দির বানানো হয়েছে। মন্দিরটির সামনে ভীমরুলের একটি বিশাল চাক আর পেছনের দিকে দুটি বিশাল মৌচাক। মন্দিরটির প্রতিষ্ঠালিপি কিন্তু অক্ষত অবস্থায় আছে। সেটিতে উৎকীর্ণ আছে - বসুবাণাঙ্ক গে শাকে/ রাধাকৃষ্ণ পদান্তিকে/ দারাঘবদাসেন/ সৌধমন্দিরমর্পিতং।

দুর্গাপুরের গোপালমাঠে অবস্থিত “তারাপদ সাঁতরা স্মারক নিধি”-র সদস্যবৃন্দ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে গ্রামবাসীদের কাছে মন্দিরটির সংস্কার করার অনুমতি চাওয়া হবে এবং তাঁদের আপত্তি না থাকলে “নিধি” নিজ ব্যয়ে মন্দিরটির সংস্কার সাধন করবে। সৌভাগ্যক্রমে গ্রামবাসীদের সাগ্রহ সম্মতি পাওয়া যায় এবং ৭ই অক্টোবর সকাল সাড়ে দশটায় অযোধ্যা গ্রামের প্রাক্তন গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান (১৯৬২-৭৬) নবতিবর্ষীয় শঙ্করীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রামবাসীবৃন্দ ও মাননীয় সাংবাদিকবর্গের উপস্থিতিতে রাধাদামোদর মন্দির সংস্কার কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। অযোধ্যা গ্রামের উৎসাহী যুবক তাপস গাঙ্গুলির সহায়তায় স্থানীয় পাঁচজন গ্রামবাসীকে সংস্কারের কাজে নিযুক্ত করা হয়। প্রাথমিক ভাবে মন্দিরের কাঠামোর কোনও ক্ষতি না করে অত্যন্ত সাবধানে এবং ধীর গতিতে মন্দিরের গায়ের আংশিক গাছপালা কর্তন করা হয়। মোটা শিকড়গুলিতে বিদ্যুতচালিত ড্রিল মেশিন দিয়ে গর্ত করে রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়। ততটাই সংস্কার করা হয় যতটা মন্দিরটির কাঠামোর পক্ষে ক্ষতিকারক নয়। এরপর এই সংস্কার মুলতুবি রাখা হয়। এরপর গ্রামবাসীর গণস্বাক্ষরিত আবেদনপত্র যথোপযুক্ত সরকারী দফতরে প্রেরিত হবে। কাজটি দেশে বিদেশে প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে – ইনটাকের কমল বন্দ্যোপাধ্যায়, ইংল্যান্ড থেকে অমিত গুহ, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং শতাধিক শুভার্থী এই শুভকাজে অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন যা প্রমাণ করে ভালো কাজের কদর ছিল, আছে, থাকবে। 

এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী। ((সমাপ্ত)

সহায়তা: শুভ মজুমদার [ডেপুটি সুপারইনটেনডিং আর্কিয়োলজিস্ট, আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়া, গভ. অভ ইন্ডিয়া, মিনিস্ট্রি অভ কালচার], কমল বন্দ্যোপাধ্যায় (ইনটাক), শুভদীপ সান্যাল, শুভম মুখোপাধ্যায়, তাপস গাঙ্গুলি, সোমা গাঙ্গুলি, রুদ্রনাথ গোস্বামী, রিম্পা মুখার্জী, অভিষেক মুখার্জী  হীরক মুখার্জী (জি ২৪ ঘন্টা), দেবাশীষ মুখার্জী (পাঁচাল),বুধন কর্মকার (ওঙ্কার নিউজ), শুভ্র মিত্র (আনন্দবাজার পত্রিকা), দীপান্বিতা রায়, অভিজিত অধিকারী (ইটিভি ভারত, যুগশংখ), তুহিন অধিকারী (এবিপি আনন্দ), জয়ন্ত বিশ্বাস (News 18 বাংলা), রামদেব (ড্রাইভার), সুমন কুমার দে, মিলন কর্মকার ও অযোধ্যা গ্রামের অধিবাসীবৃন্দ।

(www.theoffnews.com Bankura)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours