রণজিৎ গুহ, লেখক ও সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:
(লেখক একজন গর্বিত প্রাক্তন ইস্পাত কর্মী)
৩৯৫টি ধারা এবং ৮টি তপশিল সম্বলিত ভারতীয় সংবিধান সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ সংবিধান। ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর, এই তিন বছরের মধ্যে তা রচিত হয়। যা কার্য্যকরী হয় ১৯৫০ সালে ২৬শে জানুয়ারি। রচনা পর্বে এর বিভিন্ন মুসাবিদাগুলির প্রত্যেকটি ধারা ভারতের গণপরিষদে আলোচিত হয়। সব মিলিয়ে গণ পরিষদের ১১টি অধিবেশন বসেছিলো। মোট সময় লেগেছিলো ১৬৫ দিন। এইসব অধিবেশনের মাঝেই বিভিন্ন কমিটি ও উপকমিটির মুসাবিদাগুলির সংশোধন আর পরিমার্জনের কাজ চলতো। গণপরিষদে তিনশোর বেশী সদস্য ছিলেন।
উইনষ্টন চার্চিল বিষ-ঢালা ব্যঙ্গের সুরে বলেছিলেন -"এই গণপরিষদ কেবলমাত্র একটি প্রধান সম্প্রদায়ের (হিন্দু সম্প্রদায়ের) ক্ষমতা দখলের কমিটি ...।" কিন্তু গণপরিষদ সংবিধান রচনার এই প্রক্রিয়াটিকে আরও বেশী করে অংশগ্রহণমূলক করে তোলার জন্য সাধারন মানুষের কাছ থেকেও মতামত চাওয়া হয়েছিল, সেই আবেদনে সারাও মিলেছিল ভালোই ¦
কেউ কেউ "গান্ধীবাদী আদর্শে" সংবিধান রচনার পরামর্শ দিয়েছিলেন... আবার কলকাতা থেকে "নিখিল ভারত বর্ণাশ্রম স্বরাজ্য সমিতি"- প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রীয় মত ভিত্তিক সংবিধান রচনার পরামর্শ দেয়... নিন্মবর্ণের গোষ্ঠীগুলোর দাবি ছিল, "উচ্চবর্ণের অত্যাচার বন্ধ করতে তাদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হোক,... ভাষা সংখ্যালঘু , ধর্মীয় সংখ্যালঘু, মহিলা সমাজ, শিক্ষক সঙ্ঘ, আদিবাসী সঙ্ঘ থেকে "কেন্দ্রীয় ইহুদি পরিষদ" শত শত সংগঠন এবং ব্যক্তি বিশেষের প্রস্তাব দেখলেই বোঝা যায় সংবিধান রচয়িতাদের কতো রকম স্বার্থের কথা মাথায় রাখতে হয়েছিল।
গণপরিষদের প্রতিবেদনগুলি ১১টি মোটা মোটা খন্ডে ছাপা হয়। এইসব খন্ডগুলি পড়লে - যার কতকগুলোর পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০০০ বেশী ও ভারতীয়দের বচন পটুত্বের নমুনা ছাড়াও তাঁদের অন্তদৃষ্টি, বুদ্ধি, আবেগ আর রসবোধেরও নমুনা পাওয়া যায়। এই খন্ডগুলো একেকটি সোনার খনি, কিন্তু অল্প লোকই তার খবর রাখে। ইতিহাসবিদের কাছে এর মূল্য অসীম এবং আগ্রহী নাগরিকদের কাছে জ্ঞানলাভের সাম্ভাব্য এক উৎস।
১৯৪৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বর জহরলাল নেহেরু গণপরিষদের লক্ষ্য সংক্রান্ত বিষয়ে প্রথম ভাষণে -ভারতকে "স্বাধীন, সার্বভৌম, প্রজাতন্ত্র" বোলে ঘোষনা করেন, নাগরিকদের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক সমমর্যাদা, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ, সংখ্যালঘু এবং পিছিয়ে পরা উপজাতিদের রক্ষাকবচের ব্যবস্থা সংবিধানে রাখার কথা ঘোষনা করেন ...।"
১৯৪৯ সালের ২৫শে নভেম্বর অর্থাৎ গণপরিষদের কাজের শেষ দিন ডা. আম্বেদকর এক মর্মস্পর্শী ভাষণে - প্রথমে ধন্যবাদ জানান গণপরিষদের মুসাবিদা কমিটির সব সদস্যদের। ধন্যবাদ জানালেন সাহায্যকারী কর্মীদের এবং ধন্যবাদ জানালেন সেই পার্টিকে, তিনি সারা জীবন ধরে যার বিরোধিতা করেছেন। পরিষদ কক্ষের ভিতরে ও বাইরে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব সহযোগিতা না করলে তাঁর পক্ষে এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে সুশৃঙ্খলভাবে সংবিধান রচনা সম্ভব ছিল না, কংগ্রেস পার্টির এই শৃংখলার সুবাদেই মুসাবিদা কমিটির পক্ষে প্রতিটি ধারা ও প্রত্যেকটি সংশোধনীর পরিণতি সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হয়ে সংবিধানকে পরিষদে ঠিকমত চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে...।"
১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে যখন গণপরিষদের অধিবেশনগুলো বসে, চারদিকে তখন ছেয়ে রয়েছে খাদ্যের অভাব, ধর্মীয় দাঙ্গা, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, শ্রেনী যুদ্ধ, সীমান্তে যুদ্ধ এবং সামন্ততান্ত্রিক বিরুদ্ধতার এক পরিবেশ। এক ইতিহাসবিদের ভাষায়, "মৌলিক অধিকারগুলি রচনা করতে হলো মৌলিক অনধিকারের ভয়াবহ এক বাতাবরণে!"
(www.theoffnews.com Baba Ambedkar Indian Constitution)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours