সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

ব্লবফিশ দেখতে কেমন? এমন একটা মাছ কল্পনা করো যেটা মাছের থেকে বরং খোলা থেকে বেরিয়ে আসা থলথলে ঝিনুকের মত দেখতে। তার ওপর আবার মুখের ওপর ঝুলে থাকে বিশাল একটা থ্যাবড়া নাক! এই অদ্ভুতদর্শন মাছ অল্পদিনের মধ্যেই “বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত মাছ” তকমা পেয়ে গেছে কিন্তু আবার সমুদ্র সংরক্ষণের জন্য ‘পোস্টার চাইল্ড’ হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের তলায় থাকা এই নতুন আবিষ্কৃত মাছটি খুব অল্পদিনের মধ্যেই নেটিজেনদের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছে আর মিম, সফট টয়েজ আর ইমোজিতে অমর হয়ে গেছে।

ব্লবফিশের বিজ্ঞানসম্মত নাম হল সাইক্রোলুটিস মাইক্রোপোরোস, যা মাছের সাইক্রোলুটিডে ফ্যামিলির অন্তর্গত। যাইহোক, 'ব্লবফিশ' শব্দটি কখনও কখনও সাইক্রোলুটিডি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বর্ণনা করার জন্য আরও বিস্তৃতভাবে ব্যবহৃত হয় যেমন পি. মার্সিডাস।

পি. মাইক্রোপোরোসের প্রথম নমুনাটি নিউজিল্যান্ডের তটভূমির কাছে ১৯৮৩ সালে একটি গবেষণা জাহাজ খুঁজে পায় কিন্তু তারও একযুগ পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে এটির বর্ণনা এবং বিজ্ঞানসম্মত নাম দেওয়া হয়। যদিও এরমধ্যে মাছধরা ট্রলারের জালে আরও কিছু ব্লবফিশ উঠে এসেছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই রহস্যময় সামুদ্রিক প্রাণীটির সম্বন্ধে আমাদের জানার মধ্যে বিশাল বিশাল ফাঁক থেকে গেছে। 

ব্লবফিশ সম্বন্ধে অনেক কিছু অজানা থাকা সত্ত্বেও ২০০৩ সালে আরেকটি নমুনা ছবি তোলার পর ব্লবফিশ ব্যাপকভাবে কুখ্যাতি পেয়েছে। এই লেখার প্রথমেই যে ছবি দেওয়া আছে সেটা এতই বিখ্যাত যে সর্বত্র তোমরা এটা দেখতে পাবে।

এর থলথলে জেলির মত চেহারা প্রথম দিকের ইন্টারনেট কালচারের জন্য একটা দারুণ মওকা ছিল। কাদাকাদা, হড়হড়ে এই প্রাণীটিকে যে কোনও আকারে কল্পনা করা খুব সহজ। এই মাছটিকে কিছুদিন পরে ‘আগলি অ্যানিমাল প্রিজারভেশন সোসাইটি’ দ্বারা পরিচালিত একটি ভোটে বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত প্রাণী হিসাবে ঘোষণা করা হয়, যারা যুক্তি দেখায় যে কেবল সুন্দর প্রাণীদেরই সুরক্ষার প্রয়োজন।

ব্রিটিশ টিভির একটি চরিত্রের নামানুসারে ২০০৩ সালে এই মাছের নমুনাটির ডাকনাম ছিল মিস্টার ব্লবি।

ব্লবফিশ কী?

ইন্টারনেট মিম হিসাবে খ্যাতিমান হওয়ার আগে ব্লবফিশ বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে একটি কৌতূহলের বিষয় ছিল। সাইক্রোলুটিডি পরিবারের এই সদস্যটিকে কখনও কখনও একটি স্কাল্পিন বা ফ্যাটহেড (কারণ স্পষ্ট) বলে উল্লেখ করা হয়। গভীর সমুদ্রের এই প্রাণীটিকে ইন্টারনেটে যেরকম থলথলে বোরোগোবে টাইপের দেখা যায়, বাস্তবে ব্লবফিশ আদপেই সেরকম দেখতে নয়। এর  প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সরিয়ে জলের ওপরে নিয়ে এলে আশির দশকের ডেজার্টের মত দেখায়।

ব্লবফিশের চেহারা অমন কেন? 

ব্লবফিশ প্রজাতি সমুদ্রের গভীরতম গহ্বরে ৬০০ থেকে ১,২০০ মিটার গভীরতায় বাস করে। আমরা এই মুহূর্তে ডাঙ্গায় যে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ অনুভব করছি ওই গভীরতায় সেটার থেকে ১০০ গুণ বেশি হতে পারে। এই উচ্চ চাপের পরিমণ্ডলে বাস করার ফলে ব্লবফিশের বিভিন্ন ধরণের অভিযোজন হয়েছে যেমন নরম থলথলে, খুব কম পেশীযুক্ত শরীর আর নরম হাড়। 

যখন কোনও ব্লবফিশকে জল থেকে তোলা হয়, চাপ কমে যাওয়ার ফলে এটা আকারে বেড়ে যেতে পারে আর এর চামড়া শিথিল হয়ে গিয়ে এর স্বাভাবিক আকার পালটে গিয়ে একটা বড় নাকের মত দেখায়। ডাঙ্গাতে বা নৌকার পাটাতনে ব্লবফিশের জেলাটিনাস টিস্যু তার আসল গঠন ধরে রাখতে পারে না আর তাকে দেখে একটা ভেসে আসা জেলিফিশ মনে হয়।

জীববিজ্ঞানী, কৌতুকাভিনেতা ও ‘আগলি অ্যানিমাল প্রিজারভেশন সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা সাইমন ওয়াট বলেছেন ব্লবফিশের যে চেহারাটা সবাই জানেন সেটি সত্যিই খুব জঘন্য কারণ সেটি একটি মরা ব্লবফিশের ছবি। প্রকৃতিতে তারা অবশ্যই সৌন্দর্যের রাজা বা রানী নয় তবে তাদেরকে দেখতে এতটা মন খারাপ করার মতোও নয়”।

মানুষের সঙ্গে এটা সেইরকমই ঘটত যদি এর উল্টোটা করা হতো অর্থাৎ কোনও সুরক্ষা সামগ্রী বা শ্বাস যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই আমাদেরকে হঠাৎ ১২০০ মিটার জলের নীচে টেনে নিয়ে যাওয়া হত। আমাদেরকেও তাহলে খুব জঘন্য দেখাত! ব্লবফিশকে জলের নীচে অন্যরকম দেখায় কেন না তাদের ডাঙ্গায় থাকার কথা নয়। 

ব্লবফিশকে জলের নীচে কেমন দেখায়?

গভীর জলে একটা ব্লবফিশকে দেখতে একটা মাছের মতই। তাদের ঢিপ মাথা, ড্যাবড্যাবে কালো চোখ আর বুকের কাছে পালকের মত পাখনা। তাদের গায়ের রঙ গোলাপী-ধূসর রঙের, ব্যাঙাচির মত লেজের দিকটা সরু হয়ে গেছে। ব্লবফিশ সাধারণত লম্বায় ৩০ সেমির থেকে কম আর ওজনে ২ কেজির কম।

ব্লবফিশ কি বিপজ্জনক?

মোটেই না। ব্লবফিশ ৩০ সেন্টিমিটারের কম লম্বা, নরম শরীর এবং দাঁত নেই। 

কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কখনই ব্লবফিশের মুখোমুখি হবে না, যদি না কেউ একটি জাদুঘরে বা মাছ ধরার জালে মৃত নমুনা দেখতে পাওয়ার মত যথেষ্ট ভাগ্যবান হয়। এই প্রাণীগুলি সমুদ্রের গভীরে বাস করে, তাই তাদের জীবন্ত দেখতে তোমার একটি সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজের প্রয়োজন।

২০১৯ সালে ডেইলি মেইল অস্ট্রেলিয়ায় একটা খবর বেরোয় যে সিডনি ফিশ মার্কেটের একজন কর্মচারী একটি ব্লবফিশ খেয়েছিল কিন্তু তার কোনরকম বিষক্রিয়া হয়নি। কিন্তু এটা খাওয়া নিরাপদ হলেও এই মাছ বাণিজ্যিকভাবে লভ্য প্রায় কখনই হবে না। তবে ভুল করে যে এদের মাঝে মাঝে ধরে ফেলা হচ্ছে তাতে এদের কতটা ক্ষতি হচ্ছে সেটা এখনও অজানা।

ব্লবফিশ কিভাবে সাঁতার কাটে?

যতটা সম্ভব কম গা ঘামিয়ে! অধিকাংশ গভীর সমুদ্রের মাছের মতো ব্লবফিশের সাঁতারের ব্লাডার নেই যেটা মাছেদেরকে জলের ওপর দিকে উঠতে সাহায্য করে। এর বদলে ব্লবফিশের চর্বিতে ভরা শরীর তাদের সাঁতার কাটতে সাহায্য করে। তারা যে জলে বাস করে তার থেকে এই চর্বির ঘনত্ব কম। তেল যেভাবে জলে ভাসে এরাও চর্বির সাহায্যে সেভাবে জলের ভেসে থাকে। ব্লবফিশ জলের মধ্যে বা সমুদ্রের তলায় গোঁত্তা দিয়ে দিয়ে সাঁতরায়, তবে জীবনী শক্তি বাঁচাবার জন্য বেশিরভাগ সময় এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। ওয়াট বলেছেন - “এটা পরিশ্রম করা থেকে বাঁচায়। অলস হওয়া বেঁচে থাকার একটা কৌশল। আর অলস হওয়ার জন্য মোটা হওয়া বেঁচে থাকার আর একটা কৌশল।” আমরা অল্পবিস্তর সবাই এটা জানি, তাই না?

ব্লবফিশ কি খায়?

তাদের চিরন্তন কুঁড়েমির জন্য মনে করা হয় যে ব্লবফিশ মুখের সামনে যা পায় তাই গলাধঃকরণ করে। স্বাভাবিক ভেসে থাকা মানে জল তাদেরকে বয়ে নিয়ে যায়। খোল যুক্ত প্রাণী, সামুদ্রিক শামুক বা অন্যান্য ভোজ্য খুব কাছে চলে এলে ব্লবফিশের খাদ্যে পরিণত হয়। গভীর সমুদ্রের শিকারীদের মধ্যে এই অপেক্ষা করে শিকার খুব সাধারণ কৌশল।    

ব্লবফিশ কোথায় বাস করে?

সাইক্রোলুটিডি পরিবারের প্রজাতিরা আটলান্টিক, প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরে বিস্তৃত ভাবে ছড়িয়ে আছে। তবে ব্লবফিশের কয়েকটি প্রজাতি, যার মধ্যে মিস্টার ব্লবি ডাকনামের মাছটিও আছে, যা অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়। পি. মাইক্রোপোরোস এবং তার তুতো পি. মার্সিডাস অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মাঝে ও চারপাশের সমুদ্রে সব সময় ৫০০ মিটারের বেশী গভীরতায় বাস করে। 

ব্লবফিশের বংশবিস্তার!

ব্লবফিশের বংশবিস্তার সম্বন্ধে খুব কমই জানা গেছে গভীর সমুদ্রের অন্ধকারে বসবাসকারী প্রাণীকে পর্যবেক্ষণ খুব কঠিন। কিছু সাইক্রোলুটিডি প্রজাতিকে প্রায়শই পাথরের ওপর হাজার হাজার ডিম পাড়তে দেখা গেছে যেগুলোর কাছাকাছি থেকে তারা পাহারা দেয়।

একটি ব্লবফিশ কতদিন বাঁচতে পারে?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন কেন না এই অদ্ভুত মাছ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান খুব সীমিত। তবে এটা জানি যে গভীর জলের সামুদ্রিক মাছেরা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, পরিপক্ক হতে অনেক সময় নেয় এবং এদের দীর্ঘ আয়ু হয়। যেমন রকফিশ, যারা ১৫০ থেকে ৪৫০ মিটার গভীরতায় বাস করে। ২০০ বছরেরও বেশি তাদের পরমায়ু হতে পারে।

ব্লবফিশ এবং সংরক্ষণ!

ব্লবফিশ সত্যিই আসলে বিপন্ন কিনা সেটাই স্পষ্ট নয় কারণ এরা গভীর সমুদ্রের অদ্ভুত অজানা জগতে বাস করে আর এরা আমাদের কাছে প্রায় সম্পূর্ণ অজানা। যেমন, আমরা জানি না মোট ব্লবফিশের সংখ্যা এই মুহূর্তে কত, তাদের প্রাকৃতিক খাদক কেউ আছে কিনা, সমুদ্রের দূষণের ফলে তাদের কোনও ক্ষতি হচ্ছে কিনা বা তাদের গড় আয়ুই বা কত? ওয়াট বলেছেন - “ব্লবফিশ সত্যিই আসলে বিপন্ন কিনা সেটা জানা না থাকলেও যে কোনও সামুদ্রিক প্রাণীর ক্ষেত্রেই এটা সত্যি। কারণ গভীর সমুদ্রের ট্রলার থেকে এদের বিপদ হতেই পারে।”

(www.theoffnews.com Blobfish)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours