সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূম জেলা থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বেণীসাগর গ্রাম থেকে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার (এএসআই) উৎখননে প্রাপ্ত শতাধিক প্রত্নবস্তু থেকে বোঝা গেছে যে এখানে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে ১৬-১৭ শতাব্দী পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে মানুষের বসবাস ছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখানে পাওয়া ভাস্কর্য এবং পাথরের মূর্তিগুলি নিয়ে ক্রমাগত গবেষণা করছেন। কৌতূহলোদ্দীপক এমন অনেক প্রত্নবস্তুও এখানে পাওয়া গেছে যেগুলির রহস্য আগামী দিনে উন্মোচিত হতে পারে।
এএসআই ভারতের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ১০০টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের তালিকায় বেণীসাগরকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ৩০০ x ৩৫০ মিটার আয়তনের একটি বিশাল পুকুরের কারণে এর নামকরণ করা হয়েছিল বেণীসাগর, যা নিয়ে স্থানীয় এলাকায় জনশ্রুতি প্রচলিত আছে যে এটি বেণী বা বেণু নামে একজন রাজা নির্মাণ করেছিলেন।
১৮৪০ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্নেল টিকেল এই স্থানটি প্রথম আবিষ্কার করেন এবং ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক জে.ডি. বেগলার বেণীসাগর পরিদর্শন করেন এবং এখানে কিছু ভাস্কর্য দেখতে পান। এই মূর্তির উপর ভিত্তি করে তিনি এই প্রত্নস্থলটিকে খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীর বলে নিরূপণ করেন। ইতিহাসবিদ কে সি পানিগ্রাহী এখানের প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে ১৯৫৬ সালে একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেছিলেন।
এএসআই ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো এখানে খনন করে। এই দীঘির দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্বের বাঁধের দিকে খননের ফলে দুটি পঞ্চায়তন মন্দির চত্বর এবং সূর্য, ভৈরব, লকুলিশ, অগ্নি, কুবের প্রভৃতি দেবতার অনেক ভাস্কর্যের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গেছে।
এগুলি ছাড়াও ওখানে একটি পাথরের শিলালিপিও পাওয়া গেছে, যেটিতে "প্রিয়াঙ্গু ধেয়াম চাতুবিদ্যা (চাতুরবিদ্যা)" খোদাই করা রয়েছে, যার অর্থ ‘প্রিয়ঙ্গু নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি চারটি বেদে সুপণ্ডিত ছিলেন।' শিলালিপির লিপি ব্রাহ্মী এবং ভাষা সংস্কৃত। কিছু গবেষকের ধারণা, যে বেণীসাগর থেকে উদ্ধারকৃত শিলালিপি থেকে বোঝা যায় যে এটি একটি শিক্ষাকেন্দ্র ছিল, যেখানে চারটি বেদ পড়ানো হত। তার ওপর কাম এবং সঙ্গমের শিলামূর্তিগুলি দেখে বোঝা যায় যে সেই সময়ে যৌন শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল না।
ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন যে বেণীসাগর অবশ্যই তান্ত্রিক ও শৈবধর্মের প্রভাবাধীন এলাকা ছিল।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইট অনুসারে, এটিকে এপিগ্রাফিক বা শিলালিপির অধ্যয়ন থেকে ৫ম শতাব্দীর বলে মনে করা যেতে পারে। এযাবৎ কালের আবিষ্কারের ভিত্তিতে বলা যায় যে এখানে ৫ম থেকে ১৬-১৭ শতাব্দী পর্যন্ত জনবসতি ছিল।
বেণীসাগর ওডিশার ময়ূরভঞ্জ জেলার সীমান্তের কাছে অবস্থিত। ময়ূরভঞ্জের এপি কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক অজয় রাওয়াত বলেছেন যে ওড়িশা সংলগ্ন অঞ্চলে বহু রাজা বহু শতাব্দী ধরে রাজত্ব করেছেন। বেণীসাগরে খননকার্য ও ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করে যে এটি অবশ্যই ওডিশার রাজার অধীনে ছিল। এখানকার মন্দির স্থাপত্যকে ওডিশায় প্রচলিত রেখ দেউল ধরনের স্থাপত্যের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
২০০৯ এবং ২০১৯-২০২০ সালে এখানে পরিচালিত বৈজ্ঞানিক খননের সময় অগ্নি, গণেশ, মহিষাসুরমর্দিনী, সূর্য, ব্রহ্মা, শিরোচেদক, ভৈরব, লকুলিশ, যমুনা, শিবলিঙ্গের মূর্তি খোদাই করা পাথরের প্যানেলগুলি পাওয়া গেছে। এছাড়াও, মন্দিরের স্থাপত্যের অনেকগুলি অংশ যেমন দরজার চৌকাঠের বাজু, শাখা এবং খাড়া পিলার আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব নিদর্শন বেণীসাগরে নির্মিত একটি জাদুঘরে রাখা হয়েছে। এই জাদুঘর থেকে কিছু দূরত্বে প্রাচীন সভ্যতার কিছু ঘরের ধ্বংসাবশেষও রয়েছে। তাদের বাঁকা গঠন দেখে মনে হয় সেখানে প্রাচীন যুগে স্নানের জায়গা ছিল।
এছাড়াও ৫০ একর জায়গা জুড়ে মন্দির চত্বরের ধ্বংসাবশেষও এখানে পাওয়া গেছে। মন্দিরের কাছে একটি বিশাল পাথর, যা অন্য একটি পাথর দিয়ে আঘাত করলে ঘণ্টার শব্দ নির্গত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রক্ষীরা বলেন যে রাতে এক কিলোমিটার দূরেও এই শব্দ শোনা যায়।
৩০০ x ৩৫০ মিটারের বিশাল পুকুরটি এই জায়গার অন্যতম আকর্ষণ, যেটি গ্রামবাসীদের মতে কখনও পুরোপুরি শুকিয়ে যায় না। যদিও এই এলাকার অন্যান্য পুকুরগুলির প্রায়শই সেই দশা হয়। পর্যটকদের সুবিধার্থে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুকুরের চারপাশে একটি ভিউপয়েন্ট তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে তারা বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
(www.theoffnews.com archeology Jharkhand Benisagar)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours