সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
(ডিহরের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বিকাশধারা)
বাঁকুড়া জেলার ডিহর অঞ্চলটি পণ্ডিতদের কাছে বা়ংলার প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নস্থল হিসাবে পরিচিত। বিষ্ণুপুর শহর থেকে প্রায় ৮ কিমি উত্তরে গিয়ে ধারাপাট নামের গ্রামটির কাছেই এই ডিহর অবস্থিত। ডিহরে বাংলার অন্যতম প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নস্থলটি আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রায় ১২০০-১০০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে ক্যালকোলিথিক জনগোষ্ঠী এইখানে দ্বারকেশ্বরের উত্তর তীরে বসতি স্থাপন করে। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে ডিহর শৈব ধর্মের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। ডিহরের দক্ষিণে রয়েছে দ্বারকেশ্বর নদী। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে দ্বারকেশ্বর নদীর উত্তর পারের এই স্থানটিতে ১২০০ থেকে ১০০০ খ্রিঃপূঃ সময় থেকেই প্রাচীন জনগোষ্ঠী বসবাস করত। এই স্থানটি সমস্ত বাংলার প্রাচীন জনবসতিপূর্ণ স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলের প্রত্নসামগ্রী সংগ্রহ করেছেন। বিংশ শতাব্দীর আটের এবং নয়ের দশকে এবং পরে একবিংশ শতকের প্রথম দশকেও এই খনন কাজ চালানো হয়। সব শেষে ২০১২-১৩'তেও এই প্রত্নক্ষেত্রে খনন কাজ চালান হয়। রূপেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় ও তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন থেকে এই ডিহরের খনন সম্বন্ধে আমরা বিস্তারিত জানতে পারি। এই প্রতিবেদন থেকে একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ তথ্য হল এই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত পাঁচটি কাঠকয়লার নমুনার সি১৪ তারিখ। এতে দেখা যাচ্ছে সব থেকে প্রাচীন নমুনাটির তারিখ ২৭১২ খ্রিঃপূঃ ±৪৪ অর্থাৎ এই সময়কালটি সিন্ধু সভ্যতার সময়কালের মধ্যে। আরও দুইটি নমুনার সময়কাল ২২৮১ খ্রিঃপূঃ ±১৬০ এবং ২০৩০ খ্রিঃপূঃ ±১০৭, অর্থাৎ, এই দুইটি তারিখও সিন্ধু সভ্যতার সময়কালের মধ্যেই পড়ে।
অপর একটি নমুনার তারিখ ১৩০০ খ্রিঃপূঃ ±২৬৮, যা কিনা সিন্ধু সভ্যতার অন্তিম কাল। আর একটি নমুনার ১১০ খ্রিঃপূঃ ±১৮১, অর্থাৎ বুদ্ধ পরবর্তী কাল।
এই সময়কালগুলো থেকে এটা স্পষ্ট যে পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন নগর সভ্যতা – সিন্ধু সভ্যতার পূর্ণ বিকাশের সময়কাল থেকেই ডিহর অঞ্চলের জনবসতি গড়ে উঠেছিল। আর সেই থেকে পরবর্তী যুগের বৈদিক কাল পর্যন্ত এর বিকাশ ধারা অব্যাহত ছিল। চট্টোপাধ্যায় ও বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিবেদন থেকে এই অঞ্চলের খনন কাজের ফলে বিভিন্ন ধরণের সামগ্রী পাওয়া গিয়েছে বলে জানা যায়। এগুলোর মধ্যে যেমন রয়েছে মৃৎপাত্রের নমুনা, পুঁতি, হাতিয়ার, ধাতব অলঙ্কার, ধাতুমল, খেলাধূলার সরঞ্জাম তেমনি রয়েছে ধাতব কর্মশালার চিহ্ন আর তার সাথে রয়েছে তামা, লোহা ও মৃৎপাত্র তৈরির নিশানা, অস্থি আয়ুধ, উপরত্ন পুঁতি, পোড়ামাটির গোলক ও চুল্লির নিশানা ইত্যাদি। এছাড়া সেই প্রতিবেদন অনুসারে ‘১৩০ সেমি গভীরতায় মৃৎপাত্রের সর্বাঙ্গীণ হ্রাস সমসাময়িক বসতির পরিবর্তন সূচীত করে’। পুরালোকবার্তা – জানুয়ারী, ২০১৬; পৃষ্ঠা ৪।
২০০৮-০৯'এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগ যে খনন কাজ চালিয়ে ছিলেন তার ফলে প্রায় ১৮টি পালিশ করা প্রস্তরায়ুধ সংগ্রহ করা হয়েছিল। এগুলো বিষ্ণুপুরের বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সংগ্রহশালায় রাখা আছে। রূপেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সংগ্রহেও এ ধরণের আয়ুধ ছিল। এ থেকেও বোঝা যায় যে ডিহরের আশেপাশের অঞ্চলে নবপ্রস্তর যুগের জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। আবার মৃৎপাত্রের মধ্যে কালো এবং লাল পাত্রের প্রাধান্য ছিল। তবে ধূসর অমসৃণ মৃৎপাত্র, ফিকে হলুদ মৃৎপাত্র, কালো মসৃণ মৃৎপাত্রও পাওয়া গিয়েছে। সেই সঙ্গে ছিল খোদাই করা এবং জ্যামিতিক আকার যুক্ত চিত্রিত মৃৎপাত্র। আকৃতির দিক থেকেও মৃৎপাত্রগুলো ছিল নানা আকারের। নানা ধরণের বাটি, স্ট্যান্ড যুক্ত থালা, ছড়ানো কাঁধার বাটি, বাঁকা কাঁধার পাত্র আবার কোনও পাত্রের তলাটা চ্যাপটা। অন্য দিকে ক্ষুদ্রপ্রস্তরায়ুধের মধ্যে রয়েছে চাঁছনি, ব্লেড আর হাড়ের অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে সুচ এবং ড্রিল। আর আস্তানা তৈরির নিশানা স্বরূপ দেখা গেছে পেটানো মাটির উপর নিকোনো মেঝে আর খুঁটি পোতার গর্ত। কৃষিকাজের সরাসরি কোনও নিদর্শণ না পাওয়া গেলেও বিভিন্ন ধরণের মৃৎপাত্রের অবস্থান দেখে বোঝা যায় যে চাষবাস না জানা থাকলে নানা ধরণের পাত্রের প্রয়োজন হতো না।
আবিষ্কৃত মৃৎপাত্রের নমুনায় লাল, ধূসর, কালো ও কালো-লাল ধরণের মৃৎপাত্র রয়েছে। আর একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ আবিষ্কার হল রঞ্জক পদার্থের নিশানা ও আর তা তৈরিতে লৌহ ধাতুমলের ব্যবহার। বিভিন্ন ধরণের মৃৎপাত্রের অবস্থান থেকে বোঝা যায় যে প্রাচীনতম জনগোষ্ঠীর বসবাসকাল থেকে তাদের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। কুম্ভচক্রের ব্যবহার করে ক্রমশ উন্নত ধরণের মৃৎপাত্রের বিকাশ ঘটিয়েছে। সামাজিক প্রয়োজনে নানা ধরণের মৃৎপাত্র তৈরি করেছে, ক্রমবিকাশের একটি ধারা বজায় রেখেছে। যদিও সিন্ধু সভ্যতার সমযেও এখানকার জনজাতির বিকাশ ঘটেছিল, তবে এখানকার সভ্যতা কোনও ভাবেই নগর সভ্যতা ছিল না। এটা ছিল গ্রামীন সভ্যতার এক বিকাশ ধারা। হোমো সেপিয়ানসরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের বিকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন ধারায়। কোনও অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ইত্যাদির মতো নানা কারণে বিকাশ ধারাও ভিন্ন হয়ে থাকে। এ থেকে একটা বিষয় অনুমান করা যায় যে প্রাচীন ভারতে পশ্চিম থেকে পুব পর্যন্ত এক ধরণের গ্রামীণ সভ্যতার বিকাশ সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল থেকেই গড়ে উঠেছিল।
ডিহরে মাঝের কিছুটা সময়কালের নিদর্শন না পাওয়া গেলেও পরবর্তীকালের নিদর্শন এখনও বর্তমান। শৈলেশ্বর শিবমন্দির এখনও ডিহরের বিশেষ আকর্ষণ। সেই সাথে রয়েছে ষাড়েশ্বরের মন্দির। এই মন্দির দুটোর নির্মাণকাল নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে অনেকে মনে করেন মল্লরাজ পৃথ্বীমল্ল ১৩৪৬ সালে এটি নির্মাণ করেন। আবার অনেকের মতে এই সময়ে এটি পুনর্নিমাণ করা হয়েছিল। মূল মন্দিরটি পূর্ববর্তী কোনও এক সময়ে তৈরি হয়েছিল। ল্যাটারাইট পাথরের ভূমির উপর মন্দির তৈরি হয়েছে। ফুল এবং মানুষের মূর্তি খোদাই করা আছে। তবে অনেক অংশেই সেগুলো ভেঙ্গে গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং অনবদ্য স্থাপত্য নির্মাণশৈলীর নিদর্শন হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই মন্দির দু'টি অত্যন্ত অবহেলিত অবস্থায় শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনের জন্য যেন অপেক্ষা করছে। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com Bankura Dihar)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours