সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই প্রাকৃতিক ভাবে আর আধুনিক যুগে পরিযায়ী মানুষের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে উদ্ভিদ এবং প্রাণী দেশ থেকে দেশে, মহাদেশ থেকে মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন পরিবেশে প্রাকৃতিক খাদক না থাকায় তাদের বাড়বৃদ্ধি হয়ে ওঠে অনিয়ন্ত্রিত এবং স্থানীয় প্রজাতির পক্ষে হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগী। ১৮ শো শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংসের স্ত্রী লেডি হেস্টিংস দক্ষিণ আমেরিকার কচুরিপানার ফুলের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে গিয়ে ভারতে রোপণ করেন যা পরে রক্তবীজের ঝাড়ের মত ভারত, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার বেশিরভাগ জলাশয়কে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমেরিকা থেকে পিএল ৪৮০ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতে ৩২ বিলিয়ন টাকার বদলে যে গমের ভাণ্ডার এসেছিল তার মধ্যেই ছিল পার্থেনিয়ামের বীজ যা থেকে পার্থেনিয়াম গাছ কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতের ৭৬% জমিতে পঙ্গপালের মত ছড়িয়ে পড়েছে, যার রেণু থেকে চুলকানি, হাঁপানি, হে ফিভার এবং ব্রঙ্কাইটিসের মত বিভিন্ন অ্যালার্জির মহামারির মত সৃষ্টি হচ্ছে। আমেরিকার ফ্লোরিডায় বার্মিজ পাইথন আর বোয়া কনস্ট্রিক্টর জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে কিন্তু এত দ্রুত তারা ছড়িয়ে পড়েছে যে কর্তৃপক্ষ পরাজিত হয়েছে। ইংল্যান্ড থেকে জাহাজের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে যাওয়া দ্রুত প্রজননকারী খরগোশও সে দেশের শাসকদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্দামানে কাঠের ব্যবসার জন্য যে হাতিগুলি মূল ভূখণ্ড থেকে আনা হয়েছিল তাদেরকে নিয়েও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। বুনো হাতিরা সংখ্যায় কম এবং সাম্প্রতিক গবেষণার অভাবের ফলে আন্দামানের বাস্তুতন্ত্রের উপর বুনো হাতির প্রভাবগুলি অজানা।
বঙ্গোপসাগরে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় এক হাজার মাইল পূর্বে অবস্থিত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে কয়েকশো দ্বীপ রয়েছে যেগুলি অনিন্দ্যসুন্দর সাদা সৈকত এবং অনন্য জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্যের হটস্পটের অংশ, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে প্রায় ৯,১৩০টি প্রাণীর প্রজাতি রয়েছে যা ডাঙ্গা এবং সমুদ্র, এই দুই জায়গাতেই বিচরণ করে। এর মধ্যে ১,০৩২টি প্রজাতি এই দ্বীপগুলির স্থানীয়। এছাড়াও বহুদিন ধরে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের বনগুলিতে কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছে খুব লোভনীয় কয়েকটি গাছের প্রাচুর্য ছিল - অত্যন্ত মূল্যবান পাডাউক; গুরজান, একটি সোজা এবং লম্বা গাছ যা উচ্চ মানের কাঠের জন্য বিখ্যাত; গ্যাঙ্গাও স্লিপার তৈরির জন্য উপযুক্ত এবং চা বাক্সের জন্য ডিডু। উনিশ শতকের শেষের দিকে, ইংরেজ ঔপনিবেশিকরা এই দুর্গম দ্বীপগুলিতে একটি লাভজনক কাঠের ব্যবসা শুরু করে। ১৮৮৩ সালে ২০,০০০ ঘনমিটারের বার্ষিক কাঠের গুঁড়ি গ্রহণের ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম করাতকলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এই দ্বীপগুলি, কাঠুরিয়াদের সঙ্গে সত্বর একটি নতুন প্রজাতির আগমনও দেখেছিল - এশিয়ান হাতি (Elephas maximus)। লগিং শিল্পে কাজ করার জন্য ভারতীয় মূল ভূখণ্ড এবং বার্মা থেকে হাতিগুলিকে আন্দামানে আনা হয়েছিল। তারা গাছ কাটার জায়গা থেকে সমুদ্র উপকূলের ডকগুলিতে গুঁড়িগুলো টেনে আনবে।
ভারতের স্বাধীনতার পর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ২০০১ সালে নিষিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রচুর পরিমাণে গাছ কাটা অব্যাহত ছিল। যদিও লগিং শিল্প অতীতের জিনিস হয়ে উঠেছে, কাঠ বয়ে আনার জন্য আন্দামানে আনা হাতিগুলি এখানেই রয়ে গেছে। ২০০৯ সাল নাগাদ, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে প্রায় ৯৯টি বন্দী হাতি ছিল। ২০১৯ সালের মধ্যে সংখ্যাটি প্রায় ৬৩-তে নেমে এসেছে। এই হাতিগুলির বেশিরভাগই এখন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। যারা তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং দারুশিল্প বা পর্যটন শিল্পে ব্যবহার করে।
আন্দামানে কম সংখ্যায় বুনো হাতিও আছে। টিম্বার খোঁজার প্রথম দিক থেকেই, কাজের হাতিরা মাঝে মাঝে পালিয়ে যেত বা জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হতো। কালের নিয়মে, গৃহপালিত এই হাতিগুলি ক্রমশ বুনো হয়ে ওঠে আর জঙ্গলেই প্রজনন শুরু করে।
বর্তমানে, আন্দামানের ইন্টারভিউ দ্বীপে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বুনো হাতির বসবাস। উত্তর আন্দামান থেকে মাঝে মাঝে বুনো হাতির খুব ছোট দলের খবর পাওয়া যায়। ইন্টারভিউ ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির কর্মকর্তাদের মতে আন্দামানের বুনো হাতির যদিও কোনও আদমশুমারি হয়নি, তবে অভয়ারণ্যে বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় এক ডজন বলে মনে করা হয়।
অসংখ্য অনুপ্রবেশকারী প্রজাতির চাপে আন্দামানের দ্বীপের ইকোসিস্টেমগুলির দফারফা হয়ে যাচ্ছে, যেগুলির মধ্যে সবথেকে ক্ষতিকারক চিতল হরিণ (Axis axis), ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আনা একটি তৃণভোজী প্রাণী যা আন্দামানে স্থানীয় গাছপালার ফিরে আসাকে বানচাল করছে।
ইন্টারভিউ দ্বীপের ১০১-বর্গ-কিলোমিটার ভূভাগ প্রায়-চিরসবুজ উপকূলীয় বন এবং ম্যানগ্রোভ দিয়ে ঢাকা। এই দ্বীপটি পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ১২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত, এটা ব্রিটিশদের আমলে একটি প্রধান লগিং সাইট ছিল।
মার্কিন লেখক এবং ঔপন্যাসিক লরি উইনস্লো সার্জেন্ট জানিয়েছেন যে তাঁর দাদা জে কেনেথ পিয়ার্স, বিংশ শতকের শুরুর দিকে ইন্টারভিউ আইল্যান্ডে লগিং ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করেছিলেন। তিনি বলেছেন - “গাছ কাটার কাজে হাতিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। দাদা তার ডায়েরিতে হাতির কথা উল্লেখ করেছেন এবং হাতির কয়েকটি ছবিও তুলেছিলেন। তিনি হাতির শক্তির বিকল্প হিসাবে যান্ত্রিক লগিং প্রযুক্তি চালু করেছিলেন।"
ষাটের দশকের গোড়ার দিকে, একটি দেউলিয়া লগিং কোম্পানি দ্বীপে আনুমানিক ৫০টি হাতি ছেড়ে দেয়। এই প্রাণীগুলি তখন থেকে একটি বংশবিস্তারকারী দল তৈরি করেছে। ১৯৮৫ সালে, সরকার এই বন্য হাতিদের রক্ষার জন্য ইন্টারভিউ দ্বীপকে একটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বলে ঘোষণা করে।
রউফ আলী, একজন বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী জীববিজ্ঞানী, ২০০১ সালের একটি সমীক্ষায়, ইন্টারভিউ দ্বীপে ৩১টি হাতি গুণেছিলেন। তবে, তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটোরের সালিম আলি ইনস্টিটিউট অফ অর্নিথোলোজি অ্যান্ড ন্যাচারাল হিস্ট্রির গবেষকরা ২০১২ সালের একটি সমীক্ষায় দেখেছেন যে ইন্টারভিউ দ্বীপে বুনো হাতির সংখ্যা মাত্র ১১টি। তাঁরা এটাও জানিয়েছেন যে বনবিভাগের কর্তারা আগের দশকগুলিতে প্রায় ১৫টি হাতির মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছেন। আন্দামান প্রশাসন ইন্টারভিউ দ্বীপের বন্য হাতিদের স্টাডি করতে সাহায্য করার জন্য আসামের একজন হাতি বিশেষজ্ঞ এবং প্রশিক্ষক বিজয়নন্দনা দুদুল চৌধুরীকে আমন্ত্রণ করেছিল। তিনি ১৯৯৭ সালে ঐ দ্বীপে গিয়ে মাত্র ১১টি হাতি দেখেছিলেন। সংরক্ষণবিদদের মতে শিকারের কারণে আন্দামানের বুনো হাতির সংখ্যা কমে যেতে পারে। সারা আন্দামান জুড়ে, বছরের পর বছর, হাতির দাঁত ধরা পড়ার অসংখ্য খবর পাওয়া গেছে।
জীববিজ্ঞানী আলী ২০০৪ সালে দেখেছিলেন যে হাতিরা বেত, বাঁশ এবং পান্ডানুস (খেজুর জাতীয়) গাছের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। আন্দামানের বন্য হাতিদের উপর ২০১২ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে - হাতিদের উপস্থিতি ইন্টারভিউ দ্বীপের স্থানীয় গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি করছে। এমন কিছু গাছের ছাল ছাড়ানোর কারণে ক্ষতি হচ্ছে যেগুলি আগে হাতিরা খেত না, কিন্তু এখন খাবারের অভাবে খেতে বাধ্য হচ্ছে এবং হাতিদের নাগাড়ে এক জায়গায় থাকার কারণে বনের আরও ক্ষতি হবে। আন্দামানের ফরেস্ট রেঞ্জাররা একমত যে ইন্টারভিউ দ্বীপের গাছপালা গত কয়েক দশক ধরে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাঁশ, বেত, পান্ডানাসের মতো গাছপালা দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে।
তবে এটাও মানতে হবে যে সবাই মনে করেন না যে বন্য হাতি আন্দামানের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রজ্ঞা চৌতা, একজন ভারতীয় সংরক্ষণবাদী, এশিয়ান হাতি বিশেষজ্ঞ এবং ‘আনা মানে ফাউন্ডেশন’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন - “আগের গবেষণায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জীববৈচিত্র্যের ওপর ঔপনিবেশিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে জঙ্গল কেটে ফেলার ফলাফলকে বিবেচনাই করা হয়নি। তাছাড়াও বন্য হাতি এতো কম এবং অধরা যে তারা দ্বীপগুলির গাছপালাকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করতে পারে না। এছাড়াও, আন্দামানের জঙ্গলটির বার্মার সঙ্গে খুব মিল, যা হাজার বছর ধরে বৃহৎ তৃণভোজীদের ধারণ করেছে।"
(www.theoffnews.com Andaman Elephas maximus Elephant Axis axis)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours