দেবাত্রেয়ী গুহ, লেখিকা, বারাসাত, কলকাতা:

এ এক অদ্ভুত মেলার গল্প। প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির পরের দিন (১লা মাঘ তারিখটা মনে রাখবেন) হুগলি জেলার আদিসপ্তগ্রামে মাছের মেলা বসে, এই মেলা উত্তরায়ণ মেলা নামেও পরিচিত।

মেলার মূল আকর্ষণ হলো বিভিন্ন প্রকার মাছের বিপুল সমাবেশ। রুই, কাতলা, ইলিশ, ভেটকি, চিংড়ি, কাঁকড়া সহ নানারকম প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। মূলত প্রমান সাইজের মাছ কেনার জন্যে ক্রেতারা অনেক দূর দূর থেকে মেলায় আসেন। আদিসপ্তগ্রামের এই মাছের মেলা একদিনের জন্য অনুষ্ঠিত হয়। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত চলে মেলা।

মানুষের সমান এক একটা মাছের দেখা মেলে। এ মেলার বয়স ৫০০ বছরের বেশি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মভিটা দেবানন্দপুরে  বা মতান্তরে আদিসপ্তগ্রামে এই মেলা বসে।

একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের সমান উচ্চতার তেলিয়া ভোলা, ৫-৬ বছরের বাচ্চার সমান আড় মাছ। চুনো পুঁটি থেকে রাঘব বোয়াল, রুই, কাতলা থেকে ভেটকি, ইলিশ— বাদ নেই কেউ-ই। এমনই সব মাছ নিয়ে জমজমাট মাছের মেলা।

ফি-বছর এই মাছের মেলা দেখতে বহু মানুষ ভিড় জমান। এ মেলায় একটা তেলিয়া ভোলার ওজন ৪৫ কেজি, ৩০ কেজি ওজন আড় মাছের। রুই-কাতলাও নেহাত ছোটোখাটো নয়। এ ছাড়া চিংড়ি থেকে কাঁকড়া, ক্রেতার অপেক্ষায় তারাও।

শোনা যায়, চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যতম শিষ্য রঘুনাথ দাস গোস্বামীর বাড়ির পাশে বসতো এই মাছের মেলা। শোনা যায়, এই মেলা আসলে উত্তরায়ণী মেলা নামেও একদা খ্যাতি ছড়িয়েছিল। তবে এ মেলার পরিচিতি মাছের মেলা নামেই। এই মেলা ঘিরে রয়েছে কাহিনি।

কথিত আছে, দেবানন্দপুরের কেষ্টপুর এলাকার জমিদার ছিলেন গোবর্ধন গোস্বামী। তাঁর ছেলে রঘুনাথ গার্হস্থ্য জীবন ছেড়ে সন্ন্যাস নেবেন বলে ঠিক করেন। চৈতন্য মহাপ্রভুর পারিষদ নিত্যানন্দের কাছে দীক্ষা নেবেন বলে তিনি উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটি যান। কিন্তু তখন রঘুনাথ মাত্র ১৫ বছরের কিশোর। তাই নিত্যানন্দ তাকে দীক্ষা দিতে রাজি হননি। রঘুনাথকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেন। নিজের ভক্তির পরীক্ষা দিয়ে ৯ মাস পর কেষ্টপুরে বাড়ি ফেরেন রঘুনাথ।

এ দিকে ছেলের বাড়ি ফেরার আনন্দে বাবা গোবর্ধন গোস্বামী গ্রামের লোকজনকে পাত পেড়ে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। গ্রামের লোকজন আব্দার করেছিলেন, কাঁচা আমের ঝোল আর ইলিশ মাছ। পাশের জলাশয়ে ফেলা হয় জাল। সেই জলাশয় থেকে জোড়া ইলিশ মাছ ওঠায় সকলে তাজ্জব হয়ে যান। কিন্তু মাঘ মাসে আম পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে।কিন্তু রঘুনাথের ভক্তির কারণেই পুকুরে জোড়া ইলিশ  যেমন উদ্ধার হয় ঠিক তেমনি অসময়ে কাঁচা আমের জোগাড়ও হয়ে যায়। ভক্তের ভক্তি দেখে অবাক হয়ে যান গ্রামের মানুষজন।

এলাকার লোকজন জানান, সেই থেকে প্রতি বছর স্থানীয় রাধা গোবিন্দ মন্দিরে পুজো দেওয়ার পাশাপাশি ভক্তরা মাছের মেলার আয়োজন করেন। দূর দূরান্ত থেকে বহু মাছ ব্যবসায়ী নদী, পুকুরের মাছের পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছেরও পসরা নিয়ে হাজির হন। হুগলি ছাড়াও বর্ধমান, হাওড়া, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, বাঁকুড়া থেকে মানুষ আসেন এই মেলায়। ৫০০ টাকা থেকে দেড়-দু’ হাজার টাকা কেজি দরে মাছ বিক্রি হয়।

এখানে লোকজন শুধু মাছ কিনতে আসেন এমনই নয়। মাছ কিনে পাশের আম বাগানে মাছ-ভাতের পিকনিকও করেন অনেকে। এই মাছের মেলা কার্যত এখন গ্রামীণ মেলার চেহারা নিয়েছে। নাগরদোলা, বাচ্চাদের খেলনা, হরেক রকমের জিনিস, জিলিপি, মিষ্টি, ফুচকার দোকানও বসে।

(www.theoffnews.com fish fair Adisaptagram)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours