রণজিৎ গুহ, লেখক ও সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:
(লেখক একজন গর্বিত প্রাক্তন ইস্পাত কর্মী)
সে ছিল এক অন্য সময়। তখন পায়ের তলায় সর্ষে। আজ এখানে কাল সেখানে। হুট বলতেই যত্রতত্র। ডাক দিতেই চলো গঙ্গাসাগর। বিনা নোটিশে কুম্ভমেলা। আর বছর বছর বন্ধুরা মিলে পৌষ সংক্রান্তিতে কেন্দুলি জয়দেব। একবছর একজন দেরিতে পৌঁছেছে তো অন্যদের মুখভার। পরের বছর সে বন্ধু বেবাক গরহাজির। বছর গড়ায়। বন্ধুরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে সংসার ধর্মে। নতুন সঙ্গী জোটে। মেলা চলে নিজের নিয়মে। ও হরি দেখতে দেখতে আমারও কোমড় ভারী। না এবছর আর যাব না। পরের বছরও না। না না করে পেরিয়ে গেল বারো চোদ্দ বছর। কেঁদুলি যাওয়া হয়নি। এখন ছেলের পায়ে চাকা। দৌড় মারে এখানে সেখানে। দূর ছাই বয়স বাড়ল নাকি? কে দিল পায়ে বেড়ি? ফুরসত পাই না ফুড়ুৎ ওড়ার? কিন্তু মন চাইলে ডানা ছাঁটবে কে? শ্যালক অমিতাভ ঘোষ দুর্গাপুরে এলো তো মন উতলা যাই যাই।
যাবে নাকি গো?
কোথায়? কি বেত্তান্ত!
আরে চলোই না ভাই। নিজেই বুঝবে। এসব কি বুঝিয়ে বলা যায়?
তা বেশ। চলো চলো। কি কি নিতে হবে সঙ্গে?
ওহো! লোটা আর একটা মোটা কম্বল। যেমন খুশী সাজো। ঠান্ডা কিন্তু জব্বর বাপু।
আর কে যাবে? কালু আছে তো। আমার গ্রামতুতো অনুজ মোহিত গঙ্গোপাধ্যায়। শতেক কাজের উৎসাহী কর্মী। বললেই তৈরি। শুধু জানতে চাইল রণজিৎদা সঙ্গী কে কে?
আরে কে কার সঙ্গে যায়? "সব আপন আপন যাপনমেলা - কেনে খোঁজ হট্টমেলা।"
ছেলের মা জানতে চায় কখন রওনা? ফিরবে কখন?
ফিরবো কখন কিগো কবে বলো। রইবো সে উপায় কোথায়। ফিরবো বলেই তো যাওয়া। খেয়েদেয়ে শেষ দুপুরে রওনা। রাত কাটিয়ে কাল সকালে আবার ঘরমুখো।
ছেলের মা জানতে চান রাতে আবার কোন মচ্ছব?
আহা রাতেইতো মেলাগো! মেলামেশা তো রাতেই জমে। দিনের আলোয় সব যে বড় স্পষ্টাস্পষ্টি। মিলবে যদি তো টুকুন আড়াল রাখো। "কথা বলো ছলেবলে নইলে সেতো আসবে না।" গিন্নীমার মনের কথার থই পাই না।
তোমার বুকে সর্দি। রাত জেগে আরও ঠান্ডা লাগালে দেখবে কে?
কে আর দেখবে? তবে থাক যাব না। বলে আসি অমিকে, কালুকে।
কোন ব্যাগটা নেবে?
ও বাবা! এ আবার কোন সুরে গায়? তেনার চলন বুঝতে জীবন জেরবার। যাত্রা মঞ্জুর। অনেক বছর পর আবার। চলো জয়দেব কেঁদুলি। সংক্রান্তি মেলায়।
দুর্গাপুর রেলস্টেশনে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতেই হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি। বাসকর্মী চিল্লায় জয়দেব মেলা জয়দেব মেলা। উঠে পড়ো উঠে পড়ো।
কিগো দাদা মেলায় নাকি? তাইলে টুকুন জায়গা দেন আজ্ঞা।
তো হাতের ছড়িটা কিসের লেগে বাপ?
উটো বুঝলেন নাই? উটো গওনা। অলঙ্কার বটে।
কেনেগো মেলায় যাবে তো অলঙ্কার কেন?
হেইগো তুমি এই ঢঙের টুপিটো কেনে মাথায় লাগালে? ছড়িটো ওই টুপির পারা। "ঢঙের বটিস রঙেরও বটিস কাজের কিছু হলিনে - ও পোড়া মন তাই তুই মনের মানুষ পেলিনে"।
হুশ করতেই মুচিপাড়া। বাসে ভীড় বাড়ে। নিত্যিদিন শিবপুর যেছি পাঁচ টাকায় আজ বেশি কেনে? তাইতো। হাঁক পাড়ি ও কনডাক্টর দাদা ভাড়া বেশি কেন? কন্ডাকটর পালটা বলেন প্রতি ট্রিপে ইউনিয়নকে দিতে হচ্ছে পঞ্চাশ টাকা। চল্লিশ টাকা বাস লাইনে। দিনে তিনটে ট্রিপও পাচ্ছি না। আমরা কি করব বলুন?
ঠিকই তো কে আর কি করবে? কার কি করার আছে? মেলায় যাবি তো গুনাগার দিবিনে? চলো চলো। মলানদিঘি শিবপুর। নামুন নামুন। জয়দেব মেলা জয়দেব মেলা। বিকেল গড়িয়ে গেছে অনেকটা।
সামলে সুমলে একটু চা খেয়েনি আগে। মুড়ি চপ খেতে খেতে খোঁজখবর চলে। অজয় নদে জল কতটা? তা হাঁটুতক হবে। অমি চোখ কুঁচকায়। জলের কথাতো বলোনি আগে। বালি পেরোবার কথা। আমি হেসে বলি এসেই তো সব জানতে হয় শালাবাবু। "জানলে কি আর রইল বাকি - জানলে হয় না দেখাদেখি।" তা কতটা চওড়া নদী? ধরো এ দোকান থেকে ওই দোকান। বিশ ফুট মতো।
হেই রণজিতদা কখন এলেগো! বিকাশ বাউল খুশিতে শুধায়? বিকাশ এবার তোমার সঙ্গী কে কে? সঙ্গী অনেক জুটেছে। সঙ্গত নাইগো। যন্ত্রপাতি কিছু আনিনি। মেলায় আর গাইব না।
সেকিরে! তবে মিছে মেলায় এলি কেন?
বিকাশ বাউল আমায় জড়িয়ে ধরে। রণজিৎদা গো "আমি যারে গুরু মানি - সে আমারে চেলা মানে না।" বাউলকে কাঁদতে নাই গো। এসব অসার কথা পরে হবে। চলো ওপারে যাই। "ও পারে গো- আমায় ডুবিয়ে দিতে ভাসিয়ে নিতে গাইতে গান- ওপারে গো।" বিকাশ বাউল পথ ধরে। আমরা ওপারে যাওয়ার আগে এপারের বেত্তান্ত খানিক বলে কয়ে নিই। সন্ধ্যের মুখে মুখে অস্থায়ী জেনেরেটর এর আলো দোকানে দোকানে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় তিন সংস্থার তিন লাউড স্পিকার নানা ধরনের জরুরী পরামর্শ দিয়েই চলেছে। কে শুনছে কে জানে? নানা কায়দার ব্যাজ বুকে লাগিয়ে কিছু স্বেচ্ছাসেবক যেমন যেমন পারছে খবরদারি করছে। এদিকে এখান থেকে নদী পাড় প্রায় আধ কিলোমিটার রাস্তা খানাখন্দভরা, ভাঙাচোরা। মেরামতির দায় কার? আলোর ব্যবস্থা তো নেইই। তবু চলো। যাব বলেই তো এসেছি। হেই দাদা জল কতটা? ফিরতি লোককে শুধাই। ওই হাঁটুটাক। কইগো অমি, কালু জুতো খোলো মোজা খোলো। হাতে নাও। প্যান্ট পাজামা গোটাও। অজয় বইছে। জয় রাধেগোবিন্দ! পদ্মাবতীর গা ধোয়া অজয়। জল বড় শীতল গো। পায়ের পাতা ডোবে, গোড়ালি ডোবে। হেই হেই ডানদিকে যানগো। উদিকে জল টিকুস কম বটে। হাঁটু ডোবা জলে অমি পা হড়কায়। আমাকে গালমন্দ করে। এই তোমার বিশ ফুট? আহা রাগ করো কেন? আরে সব কিছু কি হিসেব মতো হয়? না হয় একশো ফুটই হল। এক জীবনের আনন্দ নিয়ে ফিরবে। একবছরের গল্প উপাদান নিয়ে ফিরবে।
ও বোনটি তোমার দামী চাদর যে জলে ভেজে গো।সামলে নাও। নেন দাদু আমার হাত ধরে সাবধানে এগোন। গুটিকয়েক গরুর গাড়ি রাখলে তো লোক পারাপারে সুবিধা হতো। এ নাকি রাস্তা ছিল। পায়ের নীচে ধারালো বোল্ডার। পা কাটে কাটুক মেলা যাত্রীর। পা হড়কালে সে দোষ মেলা যাত্রীর। পারাপারে সময় লাগে প্রায় কুড়ি মিনিট। ওপারে পা দিতেই দেখি ব্যাজ বুকে ছেলেমেয়েরা বসে আছে।কিন্তু নদী পারাপারের যাত্রী সহায়ক ব্যবস্থা বা আলোর ব্যবস্থাপনায় এদের কারো গা নেই। দুর মশাই হাজার হাজার যাত্রী বছরের পর বছর এভাবেই আসছে যাচ্ছে। তা হবে। তবে এইভাবেই চলুক। কালু বিরক্ত হয়। রণজিৎদা এখন এসব তর্কে যাবেন না। চলুন পা বাড়াই।
চলো চলো। ডানদিকে যেন গানের সুর ভেসে আসে কানে। সরকারি বাউল মঞ্চ। যাত্রা চলছে বুঝি। চলো চলো। দুপদ না যেতেই অমি বলে এতো দেখি একটু অন্যরকম মেলা। একটু কিগো ঢের। সবেতো এলে। ধীরে চলো। ঘুরে ফিরে চলো। ওপাশে কি গো! ভীড় কিসের? ওইতো ফকিরবাবার আশ্রম। দু'দণ্ড দাঁড়াও। গান শোনো খানিক। না জমছে নাকো। চলো দেখি অন্য ঠাঁই। হ্যাঁগা মেয়ে মনোহর দাস বাবাজীর আখড়া কোনটে? জয়শঙ্কর বাবার আখড়াই বা কোন ঠেরে? পথ চিনে যাই মনোহর ক্ষ্যাপার বিশাল প্যাণ্ডেলে। ভীড়ে ভীড়াক্কার। লোক থইথই। গান শুনব, সঙ্গ করব সে উপায় নাই। উলটো দিকে ধর্মশালার সিড়িতে বসে জিরোচ্ছি। মন সুস্থির করছি। গানের সুরে বাঁধো নিজেকে।
বর্ধমান থেকে এসেছে নতুন শিল্পী সিদ্ধেশ্বরী। এখন গাইবে। খ্যাতিমান গোষ্ঠ গোপালের মেয়ে। যাঃ চলে! এ যে পাড়ার ফাংশন লাগালো দেখছি। নাঃহ গো জমছে না মন। অমি এতটুকুতেই বেজায় খুশী। এতো মাত্র রূপসাগরের তীরে এসে অবাকমানা। এমন চলবে সারারাত। কালুর মনে রসের বুজকুড়ি কাটে। রওনা কালে রণজিৎদা আপনার পোশাক দেখে কেমন যেন থতিয়ে গেছিলাম। এখন দেখি এ মেলায় আপনিই মানাচ্ছেন ভালো। অমির খেয়াল হয় কিছু খেতে হবে। খেতে তো হবেই। তার আর কিছুটা ঘুরে ফিরে দেখেনি। দুর্গাপুর সেবা সমিতির মণ্ডপে কে গায়গো! বড়ই মধুর গলা। কালু ওদিকে যাসনে ভাই। বেনাচিটির নানা কিসিমে’র পরিচিত লোকজন এর সাথে দেখা হলেই অন্য পাঁচ কথায় মন টলে যাবে। পাটশ্যাওরা গ্রামের বিজয়ভূষণ আখড়ায় কারখানা সহকর্মী দৈবকীনন্দন আমন্ত্রণ জানায়। এখন ঘুরেফিরে শেষরাতে এখানে এসে খানিক বিশ্রাম নিওগো ভাই। বাসিয়া, চিনাকুরি, হেতেডোবা আশেপাশের সব গ্রামের নিজস্ব আচ্ছাদন। বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ এই চার জেলার প্রায় শ তিনেক গ্রামের অস্থায়ী আশ্রয় আশ্রম আখড়া। সর্বক্ষণ ভাণ্ডারা। যত্নের আহার। দিনভর এসো গো ভক্ত। পাত পারো। অন্নসেবা করে তৃপ্ত হও। আরাম করো। সাধ হলে জয় রাধে গোবিন্দ। কৃষ্ণ নাম করো। নয়তো বৈষ্ণব সঙ্গ করো। অমি শুধায় এ মেলায় সকলেই নিরামিষাশী? দূর এ হল বাউল মেলা। বাউলদের কি জাত আছে না বিচার মানে? যা মন চায় খেতে পারো রাতভর।
বরং চলো এ চিকন গলা কার শুনে আসি। ওমা এতো বড় কচি গলা। কাঁচা সোনা। সাত তাড়াতাড়ি আসরে নামিয়েছে কেন? গলাটি তেমন তয়ের না।ভঙ্গি কিছু রপ্ত করেছে বটে। তা "ভঙ্গিতে মন ভুলবে কত?" অমি এ আসরে কিছুক্ষণ বসতে চায়। আমি গররাজি। আয়তো দেখি। দেখ দেখ কালুরে বাউল দেখে যা। হাসছে দেখ নাচছে দেখ গাইছে শোন। আহারে রাধেগোবিন্দ! আসরে লোকমাত্র কয়জনা।হঠাৎ আলো নিভে গেল। সে খেয়াল নেই কারও। বাউল গেয়ে চলে "কাল রেতে এক সপন দেখে চমকে উঠেছি - দিনমানে ঠাঁই ভেঙ্গে জেগে থেকেছি। আমার সপন কেনে ফিরে আসে না? মনরে.... " আওয়াজ ওঠে বুক- বুকুর - বুকুর। অনুরোধ করি আরেকখানি গাও বাউল আরেকখানা। কে গো তুমি জমিদার? ফরমাশ কোরোনি। ফরমাশে আমি গাইনাগো। "গাইলে গাইব আপন মনে থাকুক পড়ে বৃন্দাবন - আমার যে সব পরের ঘরে তোমরা শুধ আপনজন।"
পেন্নাম হই বাউল ভাই। কালু কনুই ধরে টান দেয়। চলুন ওই প্যাণ্ডেলে যাই। আহা খোল বাজাচ্ছে শুনুন। আয়োজন বিরাট। পাশে ছোট মন্দির। লোকজন একটু কমকম। এসো বসে পড়া যাক।বলিহারি ভাই। এ বাউল নয়। পদাবলী কীর্তন। মূল গায়েনের বয়স কত? এই বয়সেই এতো! যেমন সুরেলা গলাটি আসর জমানো কথনভঙ্গিও তেমনই সরেস ছেলেটির। ঘুরে ফিরে বৃন্দাদ্যূতির মথুরা যাত্রার বিবরণ দিচ্ছে। দূর থেকে নমস্কার করি।বুঝদার গায়েন মাথা নামিয়ে পালটা নমস্কার জানায়। ব্যস যোগ হয়ে গেল দুই প্রাণের। এক ভাবের। বড় সুন্দর গাইছে সে। অমি,কালুর ঘোর লেগেছে। গানের টানে যেমন লোক জমছে তেমনি রাতের মত হাত পা ছড়িয়ে শোওয়ার লোকও ভীড় করছে।জমি দখলের চিল্লানিতে তাল কাটে। ওদিকে আরেক কীর্তনীয়া অসীমা দাস যে আসরে হাজির।পুরুলিয়ার মনোরঞ্জন চটজলদি গান শেষ করে। এ বড় বিপদ। সময় ধরে চলাফেরা। চল উঠে পড়ি।একপাত্তর চড়িয়ে নিই এসময়ে। একটু আড়াল হলে ভাল। একটু ফাঁক মত জায়গা কই? ঘড়িতে রাত দেখি এগারোটা। লোকজন চলছে। যেন সবে সন্ধে নামলো। নজর বটে বাপু কালুভায়ের। বাঁশঝাড়ের গোড়ায় চাদর পাতে। সামনে অজয়ের পাথার।আয়োজনটি বেশ। চপ, বেগুনি, পাপড়ভাজা। আরও টুকুন নাও হে। বাহ জমেছে বেশ। এবার আবার চলো দেখি। উলটো দিকেই চরণদাস বাবাজীর আশ্রম। হেই রণজিৎদা আসেন গো আসেন। এ যে দুর্গাপুরের একই কারখানার লোকগো। উপরটাইম আর বোনাসের কচকচি শুরু করবে নাতো। যাহোক বসিতো খানিক। ও বাবা এ যে অনেক চেনা লোক এ ডেরায়। একটু সেবা করবেন নাকি? ফার্ণেশের সেকেণ্ড হেল্পার রাতুরিয়া গ্রামের শ্যামা রায় ডান হাতে নিজের কান ছুঁয়ে শুধায়। তা হোক একটু। হাতে হাতে ছিলিম ঘোরে। আসরে আসেন লক্ষীকান্ত চ্যাটার্জি। আহা সুমধুর গলা। "তুই খেয়ে কার বাগানের ফল তুই গেলি রসাতল।" আহা চেহারাটিও বড় সুন্দর। কিন্তু সব মেজাজ যে নষ্ট করে দিলে বাপ। ও কিরকম কথা।গানের ফাঁকে লক্ষীকান্ত জানান দেয়। আমি জাত বাউল নই। চাকরিজীবী। পৌষ শেষে এই দুচারদিন মেলায় এ আসর ও আসরে আপনাদের বিনোদন করি।
বাউল গান গাইলেই কি আর বাউল হওয়া যায়। যদি না মনটি থাকে বাউলের মত। এজনা শখের বাউল। চলো উঠে পড়ি। অমি এবার জিদ ধরে।খিদে পেয়েছে খুব। তা চলো। রাত দেড়টায় ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, ডাল, পোস্ত বড়া, বাঁধাকপির তরকারি। পেটচুক্তি। যত পারো খাও। চাইলে অতিরিক্ত অল্প খরচে মাছের ঝোল, ডিমের ঝোল বা মাংস খেতে পারো। আমরা রুটি তড়কা, মুরগী মাংস নিয়ে বসেছি। তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছি। ঘন্টা দেড়েক ধরে দেখছি কলকাতার এক সাংবাদিক আমাদের পিছে পিছে চলছে। এই হোটেলেও ছোট বিদেশি টেপ রেকর্ডার টেবিলে রেখে কাগজপত্রে কিসব লেখালেখি করছে ওই থুতনি দাড়ি সাংবাদিক। খুচরো আলাপ জমায় ব্যক্তিটি।
সে মেলা আর নেই। সে বাউল আর নেই ইত্যাদি সব অনেক নেইয়ের বিবরণ। ছাপা হবে বুঝি কলকেতার কাগজে। আমরা উঠে পড়ি। "যার নেই তার নেইরে মন - আমার কাছে সকলই আপন।" এবার একটু গড়ানো দরকার যে। ঘুরে ফিরে সেই চরণদাস বাবাজীর ঠেকে। কিগো না বলে কয়ে চলে গেছিলে যে বড়। ললিতা মা ধমকায়। কেউ সারা জনমের বাউল কেউবা দু দণ্ডের বাউল। কেনে মিছে ঝগড়া করলি চাকরে বাউলের সঙ্গে? ললিতা মায়ের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের মাথা নীচু হয়।মাথা তুলতেই দেখি জোড়া বাউল গান ধরে। আসরে অত রাতে তখন কজনাই বা জেগে। কালু বলে ঘুমিয়ে কি হবে? চলুন আরেক চক্কর ঘুরে আসি। ঠাণ্ডা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। এক বড় মণ্ডপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোকজন শুয়ে। মাঝখানে এক বিদেশীকে ঘিরে কয়েকজন লাল চোখ যুবা বসে আছে। ছিলিম চলছে। পাশে এক ছোট আসরে আলো নেই কেন? আলো আছে একেবারে টিমটিমে। ভিতরে ফিসফাস কথা চালাচালি। কয়েক জোড়া বাবাজী মাতাজী নিজেদের মধ্যে কোন আলোচনায় ব্যস্ত? আয়তো কান পাতি। শব্দগুলো সব চেনা লাগে। কিন্তু সব মিলিয়ে কিছু ঠাহর হয় না। কিছু কি রসের কথা? কালু আরও ঘন হয়।বোঝার চেষ্টা করে। আমি এক ঠাঁয়। নড়াচড়ার আওয়াজে যদি গোপনতা নষ্ট হয়। কি বুঝব কিই বা বুঝি। আড়াল থাক অস্পষ্ট থাক। স্পষ্টতা বুঝি ভালবাসায় ভাঙ্গন ধরায়। "দূরে থাকো নারী ঘন হও আমার স্বপ্নে কেন না যোনিগন্ধ বিস্বাদ করে তোমাকে, ফুলকে চেনায় বটানির নামে।"
চলো গো আঁধার ঘর থেকে পথে নামি। পথ এখন শুনশান। কোন মণ্ডপে এখনও কে গায়গো। শ্রোতা কোথায়? গুণী গায় গলা নামিয়ে। শোনার দায় রাত জাগানিয়াদের। মেলা কত মিলিয়ে দেয়। বিদেশী কম্বলের নীচে অচেনা অজানা দুজনা মুখমাথা ঢেকে গুটিশুটি শুয়ে। সময় কত? সময় চলুক সময়ের মত। আমরা চলি অন্যপথে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বারান্দায় সটান শুয়ে কতজনা। হু হু
হাওয়া। ভোর হল বুঝি। মৃদুমৃদু খোলের আওয়াজ। রাই জাগো রাই জাগো। রাতজাগা দু-দশ জনা কেউ কেউ আধো ঘুমে খোল করতালের পিছুপিছু তালি দিতে দিতে পথ চলে। ক্রমে এ প্যাণ্ডেল ও প্যাণ্ডেল থেকে লোক জোটে। বিশাল মিছিল পরিক্রমা শুরু করে। শুনশান পথ আবার জেগে ওঠে। অমি টান দেয় চায়ের দোকান দেখে। বড় গ্লাসে গরম চায়ে আয়েস করে চুমুক দিই। পাশের দোকানে দেখি খোলায় আড়াই প্যাচের জিলাপি ভাজছে। সামনে দাঁড়িয়ে আধবুড়ো লোকটার মুখ বড় চেনা চেনা ঠেকে। কে গো? ও হরি! এ যে সেই বাসের সহযাত্রী। আদুল কাওরা। কণ্ডাক্টারের সাথে যার ভাড়া নিয়ে বচসা।
কিগো এত ভোরে জিলাপির লোভ? না আজ্ঞে আমার জন্য লয়।
তবে? ঘরকে নিয়ে যাবে?
ঘর আমার কুথায় বড়বাবু। এ একমাস মেলাই আমার ঘর।
হপ্তা দুই আগেই চলে আসে। প্যাণ্ডেল মিস্তিরিদের ফাইফরমাশ খাটে সেই সুবাদে মুচিপাড়া শিবপুর যাতায়াত। খাওয়া জোটে। দু-চার টাকা নগদও মেলে। আদুল কাওরা সকালের রোদের ওম বাড়িয়ে দেয়।
দুবেলা ভরপেট খেতে তো ইখানে পয়সা লাগেনি। ওই দেখেন সার সার ভিখিরি। ভোর ভোর উয়াদের এক দুটো জিলাবি ভোগ দিলে তবে না রাধামাধব খুশি হবেক। দিনটো ভাল যাবেক। আধবুড়ো আদুল কাওরার হলদেটে দাঁতে সুখ হাসি। এ মেলায় না এলে এমন মানুষের দেখা মেলে না। দুর্ভাগা সাংবাদিক শুধু নেই খুঁজে বেড়ায়। আমরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। ফিরতে হবে দুর্গাপুরে। হঠাৎ শুনি শকুন্তলা - শকুন্তলা- দশ টাকা - দশ টাকা। ডেনিমের প্যান্ট পরা কয়েকজন যুবা চিৎকার জুড়েছে। কলকাতার ফেরানী জোটাতে যাকে তাকে তাদের চার পৃষ্ঠার পত্রিকা গছিয়ে দিতে ভিখিরি পারা হল্লায় ভোরের শান্তি নষ্ট করছে। কেতার্থ করেছে কলকেতা থেকে এসে। এখন ফেরাবার দায় মেলার লোকেদের। ধন্যি বাপু।
ফিরে চলি ফেরার পথে। ফিরব বলেই তো আসা।আবার আসব? আসতে পারব? কে জানে? বাসে উঠতেই খেয়াল হয় কি জানি কি ফেলে এলাম।সঙ্গ ছাড়া হল কি যেন। বাসের ভাড়া দিতে যেয়ে টের পাই কাঁধের ঝোলা রয়ে গেছে ললিতা মায়ের আশ্রমে। এই বেশ! শুধু নিতে কি আর মেলার ভীড়ে ভেরা যায়? কিছু দিয়ে আসতে হয়। কিছু থুয়ে আসতে হয়। ওই ঝোলা ব্যাগে রয়ে গেছে অল্প কিছু টাকা। ও কিছু নয়। ওই ব্যাগে রয়ে গেল আমার বোনের বিয়ের নিমন্ত্রনের একতাড়া চিঠি। আজই দুর্গাপুরে বন্ধু পরিজনদের পৌঁছে দেওয়ার কথা। কেন যে রওনা হওয়ার আগে চিঠির তাড়া বের করে ঘরে রেখে এলাম না? কালু অমি আমার বোকামির জন্য বকাবকি করে। আবার ফিরে যাব ওই ব্যাগটা আনতে? না। মেলায় সর্বজনে ছড়িয়ে পড়ুক আমন্ত্রণ পত্র। বিনিময়ে মেলা যেন আবার আমায় ডাক পাঠায়। গঙ্গা যেমন ফিবছর ফিরে আসে অজয় নদে। জয়দেবের আকুলতায়। ফিরে আসব মেলার টানে। আবার জয়দেব। সংক্রান্তি মেলায়।
(www.theoffnews.com poush sankranti Ajay river Joydeb Mela)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours