সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

(এই অঞ্চলে জনবসতির বিকাশ)

আমরা জানি যে মানুষ সভ্য হয়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায় হলো প্রাচীন প্রস্তর যুগ। ভ্যালেনটাইন বল ১৮৬৫-৬৭ সময়কালে বাঁকুড়া জেলা থেকে প্রস্তর যুগের প্রাচীন মানুষদের ব্যবহার করা হাতকুঠার পেয়েছিলেন। সেই সময়ে বাঁকুড়া, বর্ধমানকে সিংভূম বলা হত। ১৮৬৭ থেকে ১৮৭৯ সময়কালের মধ্যে  বল সাহেব বাঁকুড়া, বর্ধমান থেকে তার আবিষ্কৃত তথ্য বর্ণনা করেছেন। এছাড়া প্রস্তর যুগের আরও অনেক প্রস্তরায়ুধ শুশুনিয়া পাহাড় সহ বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া গেছে। প্রত্নতত্ত্ব এবং সংগ্রহশালার অধিকর্তা শুশুনিয়া পাহাড় অঞ্চলে অনুসন্ধান চলার সময় বাঁকাজোড়, ধানকোড়া আর গন্ধেশ্বরী নদীর অববাহিকায় প্রস্তর যুগের শেষ পর্যায়ের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। সুবর্ণরেখা নদী অববাহিকায় আর দুর্গাপুর অঞ্চল থেকেও প্রাচীন এবং মধ্য প্রস্তর যুগের অনেক আয়ুধ পাওয়া গেছে। বাঁকুড়া ছাড়া পশ্চিম বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, পুরুলিয়া থেকেও প্রস্তরযুগের অনেক প্রস্তরায়ুধ পাওয়া গিয়েছে। আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ভি. ডি. কৃষ্ণস্বামী বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার কংসাবতী, কুমারী আর যম নদীর অববাহিকা থেকে প্রচুর সামগ্রী আবিষ্কার করেন। এর মধ্যে লৌহমল পাওয়ার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানথ্রোপোলজি বিভাগের ধরণী সেন ও অশোক কে. ঘোষের অধীনে অনুসন্ধানের ফলে এই অঞ্চলে প্রথম প্রস্তরায়ুধ কর্মশালার হদিস পাওয়া গেছে বলে বলা হযেছে। ঘোষবাবু বলেছেন যে এই অঞ্চলের প্রায় সর্বত্রই কলাকৌশলগত ভাবে একই ধরণের কারখানার বৈশিষ্ট্য দেখা গিয়েছে। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের পক্ষ থেকে দিলীপ কুমার চক্রবর্তী পশ্চিম বাংলার প্রাগৌতিহাসিক পর্বের জন্য ক্ষেত্র সমীক্ষা করেন। পশ্চিম বাংলার এবং বিশেষ করে বাঁকুড়ার প্রাচীন প্রস্তর যুগের বিকাশ সাপেক্ষে তার এই গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গাপুর অঞ্চলে দামোদরের উত্তর তট থেকে ক্ষুদ্র প্রস্তরায়ুধ পাওয়ার কথা ননী গোপাল মজুমদার প্রথম উল্লেখ করেছেন। এইচ. সি. চাকলাদারও পশ্চিম বাংলার ক্ষুদ্র প্রস্তরায়ুধ গবেষণার ক্ষেত্রে অন্যতম পথীকৃত। 

এ সব তথ্য থেকে এটা বোঝা যায় যে প্রাচীন প্রস্তর যুগ থেকেই এই সব অঞ্চলে প্রাচীন মানুষেরা বসবাস করত। আবার বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া পাহাড় ও তার আশেপাশের জায়গা থেকে প্লাইস্টোসিনের শেষ পর্যায়ের প্রচুর পরিমান অ্যাশুইলিয়ান সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছে। এ থেকেও বোঝা যায় যে মানব সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই তারা এসব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা থেকে পণ্ডিতেরা নিশ্চিত যে শুশুনিয়া পাহাড় অঞ্চলে এবং গন্ধেশ্বরী ও তার শাখা নদীগুলোর অববাহিকায় প্লাইস্টোসিন সময়কালের শেষদিক থেকে প্রাচীন মানুষেরা বসবাস করত। এই সব স্থানে প্রস্তর যুগের অনেক অঞ্চলের হদিস প্রত্নতাত্ত্বিকরা পেয়েছেন। তার মধ্যে নিম্নপ্রস্তর যুগের প্রচুর আয়ুধ বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়া বর্ধমান, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া থেকেও প্রস্তরায়ুধ পাওয়া গিয়েছে।

প্লাইস্টোসিন সময়কালের শেষে প্রস্তরায়ুধগুলোর প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। আয়ুধগুলোর আকার ছোট হয়ে যায়। এগুলো তৈরির উদ্দেশ্যও অনেক ক্ষেত্রে আলাদা হয়ে যায়। যেমন, কোনও কোনও আয়ুধ শিকার করা পশুর চামড়া ছাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হতো। এই আয়ুধ তৈরির প্রযুক্তিগত পরিবর্তনও সে সময় ঘটেছিল। এই পরিবর্তিত ছোট ছোট প্রস্তরায়ুধগুলোও বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকায় মধ্যপ্রস্তর যুগ এবং নিম্নপ্রস্তর যুগেও যে প্রাচীন মানুষেরা এই সব অঞ্চলে বসবাস করত তা বোঝা যায়। মনে রাখতে হবে সেই সময় এই অঞ্চলের ছোট ছোট নদীগুলোর অববাহিকা জঙ্গলাবৃত ছিল। ফলে পানীয় জল, প্রস্তরায়ুধ তৈরি করার মত কাঁচামাল অর্থাৎ, নদীবাহিত নুড়ি পাথর আর শিকার করার মতো পশুর কোনও অভাব এখানে হতো না। প্রাচীন মানুষের বসবাস করার পক্ষে তাই এই অঞ্চলগুলো ছিল উপযুক্ত।

প্রায় ১২,০০০ বছর আগে নবপ্রস্তর যুগের শুরু থেকেই এই অঞ্চলে মানুষের বসবাসের চিহ্ন পণ্ডিতেরা পেয়েছেন। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া জেলার অনেক স্থানে নবপ্রস্তর যুগের আয়ুধসমূহ পাওয়া গেছে। বাংলা ছাড়াও বিহার, ওড়িষ্যাতেও নবপ্রস্তর যুগের আয়ুধসমূহ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, সমগ্র পূর্বাঞ্চল জুড়েই তখন প্রাচীন মানুষেরা বসবাস করত। একটা কথা বলে রাখা ভাল যে প্রাচীন মানুষের এই ক্রমবিকাশের পর্যায়ে তাদের আরও কতকগুলো সামাজিক ধারার বিকাশ ঘটেছিল। তারা ধীরে ধীরে খাদ্য উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছিল। খাদ্য সংগ্রহ আর শিকার করা থেকে তাদের বিকাশ ঘটছিল। শুরু হচ্ছিল মৃৎপাত্রের ব্যবহার। তাদের বিকাশ ঘটছিল ধাতুর ব্যবহারের দিকে। প্রথম দিকে তামার ব্যবহার থেকে পরে লোহার ব্যবহারের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। খ্রিঃপূঃ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝির পর থেকে বিভিন্ন স্থানে তামার মত ধাতুর চিহ্ন পাওয়া যায়। এই সময়ের মৃৎপাত্রের নিদর্শন থেকে লাল, ধূসর, কালো মৃৎপাত্রের প্রচলন ধরা পড়ে। এই স্তরের দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের সামাজিক বিকাশে ধানের মত শস্য উৎপাদনের এবং মাছ ধরার কৌশল আয়ত্ব করেছিল বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। হাড়ের অস্ত্র তৈরির কর্মশালা ছিল বলে তারা  অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে ধাতুর ব্যবহার কিন্তু সীমিতই ছিল।

সাধারণত অজয়, দ্বারকেশ্বর, কোপাই, শিলাবতী, রূপনারায়ণ আর অন্য শাখা নদীগুলোর তীর বরাবর এই সময়কালের জনবসতি গড়ে উঠেছিল। এই প্রসঙ্গে খ্রিঃ পূঃ প্রথম সহস্রাব্দের অজয় নদীর তীরের পাণ্ডুরাজার ঢিবি, দ্বারকেশ্বর গন্ধেশ্বরী নদীর তীরের ডিহর প্রভৃতি স্থানের নিদর্শন জনবসতির ক্রমবিকাশ স্পষ্ট করে দেয়। অনেকেই মনে করেন যে ডিহর এবং পাণ্ডুরাজার ঢিবি সমসাময়িক। তাই এই অঞ্চলের প্রাচীন জনবসতির বিকাশের কথা বোঝার জন্য ডিহরে প্রাচীন সভ্যতার বিকাশের সংক্ষিপ্ত আলোচনা আগামীকাল প্রকাশিত হবে। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com Bankura)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours