পি আর প্ল্যাসিড, প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক, জাপান:
ডিসেম্বর মাস এলেই মাথায় ভর করে বছরের শেষ সময়ের যত হিসাব। সারা বছরে করা ভালো কাজগুলো পাশে রেখে ভুলগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষন করি। নিজেই নিজেকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজেই বিচারকের ভূমিকা পালন করি। কারণ খুঁজি বিগত দিনে কেন ভুল হয়েছে। সেই সাথে আগামীতে ভুল না যেন হয় সে বিষয় পরিকল্পনা করি। কাজগুলো যখন করি তখনই মনে পড়ে একাত্তরের স্মৃতি কথা। বিশেষভাবে ডিসেম্বর মাস ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ডিসেম্বর মাস আমরা ছিলাম বাড়ি ছাড়া। যুদ্ধ ভয়াবহতার কারণে জীবন বাঁচাতে রিফিউজি হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি। যুদ্ধ তখন তুঙ্গে। রেডিওতে প্রতি সন্ধ্যায় বড়দের সাথে আশ্রয় নেওয়া বাড়ির আঙ্গিনায় পাটি বিছিয়ে সেখানে বসে রেডিওতে যুদ্ধ পরিস্থিতি শুনি। নিজের চোখেও কয়েকবার বোম্বিং এর দৃশ্য দেখেছি। যে কারণে আতঙ্কে দিন কাটে। শুধু তাই নয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে সারাদিন বড়দের ভাবতে দেখি।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির পূর্ব দিকের ঢালুতে বসে রোদ পোহাচ্ছিলাম। এমন সময় মাথার উপর দিয়ে কালছা সবুজ রঙের একটা হেলিকপ্টার উড়ে যায়। দৌড়ে বাড়ি এসে বললাম হেলিকপ্টার উড়ে যাবার কথা। ভেবেছিলাম এটা পাকিস্তানের কোনও হেলিকপ্টার হবে হয়তো, তাই। বাড়ি এসে বলার পর বড়রা বললেন, এটা ভারতের হেলিকপ্টার। সামনে হয়তো ভালো কোনও সংবাদ অপেক্ষা করছে। তাদের কথায় সেদিন আমরা উল্লসিত হয়েছিলাম। এর কিছুদিন পর বাড়ির এক জ্যাঠাতো ভাই সিপ্রিয়ান তার এক সঙ্গীকে নিয়ে আমরা কেমন আছি জানার জন্য আমাদের খোঁজ নিতে আশ্রিত বাড়িতে দেখা করতে এলেন। অনেক রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বিলের ধারে বসে ভাই সিপ্রিয়ানের সাথে গল্প করেছি। বিভিন্ন এলাকায় তাদের যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা বলেন। তারাই প্রথম জানায়, কয়েকদিনের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হবার কথা। আমরা যে আবার নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে পারবো, সে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন, বেশীদিন আর এখানে এভাবে কষ্ট করতে হবে না। বড়দিন যে বাড়িতে করা হবে সেই কথাও বলে বিদায় নেন।
দেশের ভিতর পাকিস্তানি সেনাদের সাথে বাঙালি রাজাকারেরা মিলে যখন তান্ডব শুরু করে। অর্থাৎ যুদ্ধ পুরো দৃশ্যমান তখন আমরা বাধ্য হয়ে জীবন রক্ষার্থে বাড়ী ছেড়ে উত্তর দিকে কৌচান এলাকায় আশ্রয় নিই। সেখানে আমাদের দিনগুলো কষ্টের মধ্যেও যেমন ছিল আনন্দের, তেমনই ভয়ের। সারাক্ষণ আমাদের অদৃশ্য এক ভয়ে দিন কেটেছে।
পুরো ডিসেম্বর মাসের প্রতিটি দিনের কথা আমার এখনও মনে আছে।
আমার স্মৃতি যদি বিট্রে না করে থাকে তাহলে বলতে পারি, ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ রাতে রেডিওর সংবাদ শুনে আনন্দে বাড়ির সকলকে লাফাতে দেখেছি। রেডিওতে পাকিস্তানি সৈনিকদের পরাজয়ের কথা বলা হয়। বলা হয় আত্মসমর্পণ করার কথা। একথা শোনার পর সবার মাঝে যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি এখনও যেন আমার চোখে তা স্পষ্ট।
সেদিন আমাদের ঘুম যেন আসছিল না। তবুও ঘুমিয়েছি। পরেরদিন খুব সকালে সবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে বাড়ি ফেরার আনন্দে সবাই নিজেদের কাপড় গোছাতে শুরু করে। কেউ কেউ আটা রুটি চা বানিয়ে খেতে দেয়। আনন্দ উত্তেজনা তখন এতোটাই ছিল যে কেউ আর খেতে পারছিল না। তারপরেও না খেলে সমস্যা হবে মনে করে খেয়ে নেয়।
এরপর সকাল দশটার দিকে বাড়ির কর্তা হিসাবে বাবা বিলের ধারে দাঁড়িয়ে আশেপাশে অন্য বাড়িতে থাকা অন্য পরিবারের লোকদের ডাকাডাকি করে জড়ো করলেন। সবাই জড়ো হলে একসাথে রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। সবার মাথায় নিজেদের কাপড়, হাড়ি পাতিল, কাঁথা কম্বল বাধা বোঝা। বাড়ি পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যায়। কাছাকাছি যাবার পর দূর থেকে ভিটা বাড়ি দেখা গেলেও ভিটা ছিল ঘর শূন্য। সব পুড়ে ছাই। বাড়ির ভিটায় পা রেখে বাবা মা খুব কান্না কাটি করলেন। কিছু সময় পর পোড়া ঘরের ছাই সরিয়ে ধর্মীয় মূর্তি, কাপ পিরিচ পেয়ে সেসব আলাদা করে রাখা হয়। আমি আর ছোট বোন খেলার সামগ্রী খুঁজছিলাম। ছাইয়ের আড়ালে থাকা ভাঙা কাঁচের টুকরা দিয়ে পা কেটে যেতে পারে মনে করে বাবা আমাদের বিরত করলেন।
সেদিন ঘরের পোড়া টিন কোনভাবে একটার সাথে আরেকটা আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে সেখানেই রাত কাটাই। পরের দিন বাঁশ বাগান থেকে বাঁশ কেটে এনে পোড়া টিন দিয়ে ছাপড়া ঘড় বানানো হয়। তার নিচে ঢালাও বিছানা করে রাত যাপন করতে শুরু করি। বিছানা করা হয় খের (ধান গাছ) দিয়ে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগের দিনগুলো ছিল এক রকম ভয় আর আতঙ্কের। পরবর্তী দিনগুলো ছিল আনন্দ আর সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। বয়সের কারণে সব মনে না থাকলেও যেটুকুই মনে আছে সবটাই এখনও স্পষ্ট।
কিছু দিন পরেই ২৫ শে ডিসেম্বর বড়দিন। ভালো কাপড় বলতে কিছু নেই। যা কিছু ছিল সবটাই মানুষের দেওয়া। তখনও কোনও রিলিফ পাইনি। কষ্টে আমাদের দিন কাটে। মা তার বাবার বাড়ি বোনের বাড়ি থেকে চেয়ে চেয়ে শীতের কাপড়, কাঁথা কম্বল, বালিশ নিয়ে আসে। সেসময় মাকে মামার বাড়ি, মাসির বাড়ি গিয়ে মুখ ছোট করে অসহায়ের মতো সাহায্য চাওয়ার দৃশ্য এখনও ভুলতে পারি না। এ যে ভোলার নয়। মামা মাসির ছেলে মেয়েদের মধ্যে কয়েকজন আমার সমবয়সীও। তাদের কাপড়ও নিয়ে ব্যবহার করেছি। তাদের কাছ থেকে কাপড়, বালিশ আর খেলার পুতুল পেয়ে কি যে খুশী হয়েছিলাম তা মনে করলে এখনও মনের ভিতর লাফায়। বালিশ আর পুতুল নিয়ে ছোট বোনের সাথে ঝগড়াও হতো মাঝে মধ্যে।
দেখতে দেখতে বড়দিন চলে এলো। মামার বাড়ি থেকে আনা আমার জন্য শার্ট প্যান্ট ধুয়ে শোকানো হলো। সেগুলো খুব যত্ন করে ভাজ করে বালিশের নীচে রেখে দিলাম আয়রনের মতো ভাজ হবার জন্য। বড়দিনের দিন সকালে সেই শার্ট প্যান্ট পড়ে গির্জায় যাই বড়দিনের প্রার্থনায় অংশ নিতে। তখন বড়দিনের অর্থ বা তাৎপর্য বুঝিনি। তবে ঘটনা সবই এখনও মনে আছে।
(www.theoffnews.com freedom Bangladesh Christmas festival)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours