রূদ্রাণী মিশ্র, লেখিকা ও কবি, কলকাতা:

সমরেশ বসু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম সুরতনাথ বসু হলেও তিনি সমবেশ বসু নামেই সমাধিক সমাদৃত। কালকূট ও ভ্রমর দুইটি বাড়তি ছদ্মনামেও তার সৃষ্টি রয়েছে।

বাবা মোহিনি মোহন বসু ও মা শৈবালিনী দেবীর এই কনিষ্ঠ পুত্রের জন্ম হয় ঢাকার সুতানোরের একবালপুর গ্রামে। সেখানেই তার শৈশব অতিবাহিত হয়। ঢাকার গ্র্যাজুয়েট স্কুলে অষ্টম শ্রেণি অবধি তিনি পড়াশোনা করেন। সেখানে অকৃতকার্য হওয়ার দরুণ তাকে, তার দাদা মন্মথ বসুর কর্মস্থল, নৈহাটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বড়দাদার রেল-কোয়ার্টার্সে থেকে মহেন্দ্র উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী থেকেই আবার তিনি পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। তবে নৈহাটিতে এসে ছবি আঁকা, সঙ্গীত চর্চা, লেখালেখি আর বাল্য প্রেমে মেতে ওঠার জন্য পড়াশোনায় ইতি পড়ে যায়।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে সমরেশ পূর্ব কাঁঠাল পাড়ার যোগেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়ের বড় মেয়ে তার বন্ধু দেবশঙ্করের দিদিকে বিয়ে করেছিলেন। যেহেতু গৌরী দেবী তাঁর থেকে মাত্র চার বছরের বড় ও ডিভোর্সি মহিলা ছিলেন। তাই সমাজ ও পরিবার কেউই এই বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। এজন্য তাঁরা নৈহাটি ত্যাগ করে ৪ মাইল দূরে আতপুরে জগদ্দলে বসবাস আরম্ভ করেন। বহু কষ্টে এই সময়ে তাদের দু'জনের সংসার চলত। তিনি মাথায় করে ডিম ফেরি করে এবং ছবি এঁকে নানা ভাবে অর্থ রোজগার করতেন।

জগদ্দলে তিনি সত্যভুষণ দাশগুপ্ত বা সত্য মাস্টারের সংস্পর্শে আসেন। এই সত্য মাস্টার ছিলেন বিখ্যাত শ্রমিক নেতা, তাই সত্য মাস্টারের হাত ধরেই তিনি তখনকার কমিউনিস্ট পার্টিতে তিনি যোগদান করেন। এরপর কমিউনিস্ট পার্টির নিয়মিত সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন।

১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ এই ছয় বছর সমরেশ ইছাপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে কাজ করে ছিলেন। যদিও ফ্যাক্টরির প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট মার্কার হিসেবে যোগদান করে, পরে ড্রাফ্টস ম্যান পদে উন্নীত হন। চাকরির পাশাপাশি তিনি পার্টির কাজেও সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ব্যারাকপুরের চটকল শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে তার বেশ ভালই সংযোগ ছিল। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হওয়ায় সমরেশ বসু ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাকে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অন্তরীণ অবস্থায় তাকে নানা ধরনের পুলিশি অত্যাচারে অত্যাচারিত হতে হয়েছিল। এক বছর কারাবাসে থাকার পর তিনি ছাড়া পান। অবশ্য এর আগের সময় থেকেই পার্টির সঙ্গে তার একটা দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছিল। তবে কারাগৃহ থেকে ফিরে ফ্যাক্টরি চাকরি বজায় থাকে না। যদিও সমরেশ জেলে যাওয়ার সময় থেকেই মনস্থির করেন। যে তিনি লেখার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করবেন। তাই তিনি পরিপূর্ণভাবে নিজেকে লেখাতে নিয়োজিত করেন। আর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি ব্যাপৃত ছিলেন তার সৃষ্টিকর্মে। এ বিষয়ে দেবেশ রায় লিখেছিলেন (প্রতিক্ষণ পত্রিকায় পঞ্চম বর্ষ ১৭ সংখ্যা ২-১৬ এপ্রিল ১৯৮৮), "তিনি আমাদের মতো অফিস পালানো কেরানি লেখক ছিলেন না। যাদের সাহস নেই লেখাকে জীবিকা করার অথচ ষোলো আনার ওপর আঠেরো আনার শখ আছে লেখক হওয়ার।...“ এই লেখার শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন, ‘জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক।’

সমরেশ বসু তার ছদ্মনামও যুক্তিযুক্তভাবে ব্যবহার করেছেন। প্রথমে শুরু থেকে সমরেশ হয়ে ওঠা তার শ্যালক দেবশঙ্করের জন্য, তবে কালকূট নামের মধ্য দিয়ে তিনি সমাজের হিংসা মারামারি আর লোলুপতার ভয়াল ভাবায় দুর্বিষহ জীবনকে মন্থন করে উপন্যাসের মাধ্যমে অমৃত হিসেবে পরিবেশন করেছেন। তার ভ্রমর ছদ্ম নামে তিনি বেশিরভাগ প্রেম সম্বন্ধীয় বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন। এখানে তার একটা গল্প আত্মজা, প্রভূত সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। তবু তিনি তার মতবাদ থেকে সরে আসেননি। সাহিত্যিক হিসেবে সমরেশ বসুর আত্মপ্রকাশ কারামুক্তির পর নয়। তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে শারদীয় পরিচয় পত্রিকায়। গল্পের নাম আদাব, রাইফেল ফ্যাক্টরিতে কাজ করার সময় লিখে ফেলেন একটি উপন্যাস। নাম নয়নপুরের মাটি। এরপর কারাগারে অন্তরীন অবস্থায় লেখেন আরেকটি উপন্যাস উত্তরঙ্গ। দ্বিতীয় উপন্যাসটি ১৯৫১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। তার এই দ্বিতীয় উপন্যাসকেই প্রথম রচিত উপন্যাস বলে চিহ্নিত করা হয়।

সমরেশ বসু রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ১০০ ছোটগল্পের সংখ্যা দুশো। এছাড়া নানা গল্প সংকলনের সঙ্গে, কিশোর উপন্যাস ও কিশোর গল্পও তার সৃষ্টিতে পাওয়া যায়। তিনি গোয়েন্দা গোগল সৃষ্টি করেন। এছাড়া নানা হত্যা রহস্য ও ভৌতিক গল্পের ঠিকানাও তার সৃষ্টিতে আমরা পাই। তাই বলে প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লেখেননি, এমনটা ভাবার দরকার নেই। নিজেকে জানার জন্য নামক একটা প্রবন্ধ সংকলনও আমরা তার লেখনীতে পড়তে পাই। 

১৯৮৮ সালের ১২ই মার্চ মাসে তিনি মারা যান তার লেখার টেবিলে দশ বছরের অমানুষিক শ্রমের অসমাপ্ত উপন্যাস দেখি নাই ফিরে পাওয়া যায়। যা মূলত রামকিঙ্কর বেজকে নিয়ে তার এই উপন্যাস রচিত হয়েছিল। উপন্যাসের প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন বিকাশ ভট্টাচার্য। ১৯৮৩ সালে প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও ঐতিহাসিক ডঃ সুকুমার সেন এর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবের নিয়মিত সদস্য ছিলেন, সমরেশ বসু। এছাড়া আনন্দবাজারে প্রকাশিত কুম্ভ মেলার কথা নিয়ে লেখার সময় নানা অভিজ্ঞতার কথা সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের নানা স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়। এরকম একজন লেখক বোধয় বারবার পৃথিবীতে আসেন না। তাই বাংলার এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে বাংলার রুক্ষ জমির চিত্র তুলে ধরে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন চিরকাল।

(www.theoffnews.com Bengali writer Samaresh Basu)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours