সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:
মুম্বাই ও দিল্লির সঙ্গে মস্কোর বাণিজ্যিক লেনদেনের উষ্ণতা যতটা জমাটবদ্ধ, ঠিক ততটাই পুঁজি নিবেশের শৈত্যতা অতি গভীরের, অন্তত কলকাতার সঙ্গে ক্রেমলিনের। এই আপ্তবাক্যটি কিন্তু এক আন্তর্জাতিক কূটনীতিকের। কোনও রকম জড়তা নয়। ঢাক ঢাক গুরগুরের তো প্রশ্ন একদমই নয়। কলকাতার বুকের উপর বসে একথা সরাসরি বললেন ম্যাক্সিম কোজলভ। তাও আবার নির্ভুল বাংলা ভাষায়। পদাধিকার বলে তিনি বর্তমানে কলকাতায় অবস্থিত রাশিয়ান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত। তিনি খানিকটা আক্ষেপের সুরেই জানান, পশ্চিমবঙ্গে কয়লা খনি আছে। দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার মতো বৃহৎ শিল্প আছে। চা নিলামের বৃহৎ বাজার রয়েছে। শিল্প পরিকাঠামোর প্রাচুর্য আছে। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন এই রাজ্যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে আগ্রহী ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের রাশিয়া এ'রাজ্যে পুঁজিনিবেশ নিয়ে একেবারে চুপচাপ। তিনি আরও বলেন, "আমি বিশ্বাস করি রাশিয়ার কাছে ভারত বলতে স্রেফ দিল্লি বা মুম্বাই নয়। কলকাতার অস্তিত্বকেও আমাদের গুরুত্ব দিয়ে ভাববার সময় এসে গেছে।" আশার কথা শুনিয়ে তিনি উল্লেখ, "কলকাতাতেও বিশ্ববাংলা বাণিজ্যিক সম্মেলন আয়োজিত হয় সাফল্যের সঙ্গে। আমি আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করবো যাতে রাশিয়ার পুঁজিপতিদের একটা বিশেষ দল অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গে আসে বিনিয়োগ করার লক্ষ্য নিয়ে।"
গত বুধবার ভারত চেম্বার অফ কমার্স'এর উদ্যোগে কলকাতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সভা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। 'ইন্দো রুশ বাণিজ্য ও পুঁজিনিবেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ' শীর্ষক এই সভায় বক্তব্য রাখেন সংশ্লিষ্ট বণিকসভার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নরেশ পাচিসিয়া ও রুশ রাষ্ট্রদূত ম্যাক্সিম কোজলভ। সভায় বণিকসভার সদস্যরা সহ সেখানে বিশেষ অতিথির আসন অলংকৃত করেন রাশিয়ার উপ রাষ্ট্রদূত এক্যাটরিনা তিউরিনা।
আয়োজক বণিক সভার পক্ষে নরেশ পাচিশিয়া আলোচনা সভার প্রারম্ভিক ভাষণ উল্লেখ করেন, ইন্দো রুশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্রেফ আচমকা স্থাপন হয়নি। ভারত স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়কাল থেকে তদানীন্তন সোভিয়েত আমাদের দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক মৈত্রী স্থাপন করেছিল। সেই ধারাবাহিকতা আজ আরও মজবুত হয়েছে অধুনা রাশিয়ার সঙ্গে। ১৯৭০ সাল থেকে এই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের বুনিয়াদ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। মস্কোর প্রশাসক ও দিল্লির শাসক উভয়েই এই বানিজ্যিক সম্পর্ককে এক অবিচ্ছেদ্য অকৃত্রিম পারস্পরিক বন্ধুত্বতে পরিণত করে এসেছেন বরাবর। এতকাল পরেও তা একবারের জন্য চিড় ধরেনি দ্বিস্তরীয় কূটনৈতিক তরফে, বলে তিনি জানান।
কলকাতায় অবস্থিত রুশ দূতাবাসের দায়িত্ব প্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ম্যাক্সিম কোজলভ আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, "দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে প্রতি বছর ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্যিক লেনদেন হয়। আমরা ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মুগ্ধ। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক ক্ষেত্র প্রসারে ভীষণ রকমের তৎপর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তো রুশ প্রেসিডেন্টের বিশেষ বন্ধু। এই দুই রাষ্ট্রনেতা এক যোগে দুটো দেশের পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষায় একে অপরের অভিন্ন পরিপূরক হয়ে উঠেছে। এর ফলে বিশ্বের নিরিখে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে এক উন্মুক্ত বাজার সৃষ্টি হয়েছে।"
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ ইউরোপের বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ রাশিয়ার উপর একাধিক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করেছে। ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারের ভারসাম্য রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে ভ্লাদিমির পুতিন প্রশাসন। প্রোটোকল মেনে একথা মুখে না স্বীকার করলেও রুশ রাষ্ট্রদূত একথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বুঝিয়ে দেন যে, বাণিজ্যিক দৃষ্টি কোন থেকে মস্কো এখন আর ইউরোপীয় বাজার নিয়ে ততটা উৎসাহী নয়, যতটা দক্ষিণ এশিয়ার ভারতীয় উদার বাজারের সম্পর্কে আগ্রহী। তিনি আরও মন্তব্য করেন, জ্বালানির গ্যাস ও তেল তো এখন রাশিয়ার কাছে ভারত এক হেভিওয়েট খদ্দের। সমরাস্ত্রের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম বিক্রিতেও ভারত এখন রাশিয়ার কাছে ভালো ক্রেতা। উল্টোদিকে ভারত চা, গম, ওষুধ, কম্পিউটারের সফটওয়্যার নাগারে রপ্তানি করে চলেছে ক্রেমলিনকে।
ম্যাক্সিম কোজলভ বক্তব্য রাখতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ক্ষেত্রে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রতিরক্ষা সহ বাণিজ্যের পুঁজিবাজারের মতো বিষয়গুলো রাশিয়ার অন্তরাত্মার সঙ্গে মিশে গেছে। আমরা গর্বিত যে ভারত এখন মেক ইন ইন্ডিয়া শুধু স্লোগান তুলি থেমে থাকেনি। যতদিন যাচ্ছে ভারতের স্বভিমানের প্রতীক হয়ে মেক ইন ইন্ডিয়া কনসেপ্টটা ততই যেন বাস্তবতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
(www.theoffnews.com Indian Russian Trade)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours