সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
জানলা, জানালা, বাতায়ন, ঝরোখা, আওয়াজি; ঘুলঘুলি, ভেন্টিলেটার, শার্সি, চিক, খড়খড়ি, ঝিলমিল, জাফরি – একই জানলার কত প্রতিশব্দ! প্রতিটি শব্দের দ্যোতনা ভিন্ন - স্মৃতি বৈচিত্র্যময়।
সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমায় সিধু জ্যাঠার অননুকরণীয় কন্ঠে আর ভঙ্গিমায় ফেলুদাকে বলা সাবধানবাণী অবিস্মরণীয় হয়ে আছে –
'আমি অনেক কিছু করলেই অনেকের পশার থাকত না ফেলু। তাই আমি কিছুই করিনি। শুধু মনের জানলাগুলো খুলে দিয়ে বসে আছি। যাতে আলো আর বাতাস এসে মনটাকে তাজা রাখে। ... মানুষের অন্ধকার দিকটা নিয়ে তোমার কারবার কিন্তু নিজের মনটাকে অন্ধকার হতে দিও না ফেলু, হতে দিও না।'
ফেলুদা সিধু জ্যাঠাকে আশ্বস্ত করে বলে ‘না, আমিও জানলা খুলেই রেখেছি’। সত্যজিৎ রায় স্বয়ং মনের জানলা খুলেই রেখেছিলেন। কত বিষয়ে তাঁর অনুসন্ধিৎসা, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে তাঁর অনায়াস যাতায়াত। বাংলা রেনেসাঁর শেষ প্রতিভূ বললেও অত্যুক্তি করা হয় না।
মানুষ তো ছিল প্রকৃতির মাঝে – তারপরে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে গুহায়, গাছের কোটরে আশ্রয় নিল। গুহার গবাক্ষ বিশ্বচরাচরের সঙ্গে যোগ রেখে চলল। আঁধার নেমে আসার পর বাইরের প্রকৃতির ভেতরে আসা বন্ধ হলেও বাইরের জগতের স্মৃতিকে ভেতরে নিয়ে আসত মনের জানলা খুলে গুহার গায়ে ছবি আঁকার মাধ্যমে। হাজার হাজার বছরের পুরনো গুহাচিত্র আসলে গুহাবাসী মানুষের মনের জানালার স্মৃতিচিত্র। পরিমল গোস্বামীর বিখ্যাত স্মৃতিকথার নামই তো স্মৃতিচিত্রণ!
জোড়াসাঁকোর একটি জানলাকে রবীন্দ্রনাথ অমর করে রেখে গেছেন জীবন স্মৃতি-র আমার ছেলেবেলা পরিচ্ছেদে। সামাজিক অনুশাসনে ঘরে বন্দী রবীন্দ্রনাথ ওই জানলা দিয়ে দেখা প্রাচীন বট, পুকুর আর পুকুরে স্নানরত সাধারণ মানুষকে চিরকালীন করে গেছেন। এরই প্রক্ষেপণ কি ডাকঘর নাটকে অমলের চরিত্রে দেখা যায়? আমরা যদি চারুলতা-র খড়খড়ি তুলে রাস্তার দৃশ্য দেখার কথা স্মরণ করি তাহলে বুঝব যে চারুলতা-র বদ্ধ, অবহেলিত প্রাত্যহিক জীবনে জানলা বাইরের জীবনের প্রতীক। একটি এস্কেপ মোড। অমল যখন বাইরের আলো-বাতাস নিয়ে চারু-র জগতে প্রবেশ করল তখন তার জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে বাইরের জগতকে দেখার দরকার ফুরোল।
আমরা এখন মনোবিজ্ঞানের কল্যাণে জানি যে ছোটবেলার নিপীড়ন, অত্যাচার আমাদের মনে ট্রমার জন্ম দেয় যা বড় হলেও অতিক্রম করা মুস্কিল। একটি মূল্যবান কথা আছে – Make disadvantages advantages। রবীন্দ্রনাথ বৃহৎ প্রাণ তাই জীবনের ক্ষতকে শুধু নিজের ক্ষেত্রে নিরাময় না করে আপামর শিক্ষার্থীদের জন্য বাঁধনহীন শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অবচেতন মনে যে বন্দি দশা সারাজীবন কাজ করেছে তার প্রমাণ রাজা, রক্তকরবী, তাসের দেশ প্রভৃতি নাটকগুলিতে দেখা গেছে।
বিশ্বচরাচরে চারখানি দেওয়াল ও একখানি ছাদ দিয়ে মানুষ তার ঘর বানালো কিন্তু জানলার মাধ্যমে অসীম বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখল।
ছোটবেলায় দুপুরবেলায় মা জোর করে ঘুম পাড়াতে চাইত – আমিও মায়ের ঘুমনো পর্যন্ত মটকা মেরে শুয়ে থাকতাম, মা ঘুমিয়ে গেলেই বন্ধ জানলার পাল্লার জোড়ের ফাঁক দিয়ে আসা ক্ষীণ আলোয় গল্পের বই পড়তাম। জানলার ওপরের ফাঁক দিয়ে বাড়ির পাশে রাস্তায় যাওয়া সব কিছুর ছবি ওপর দিকে সিমেন্টের সাদা ফ্রেমের ওপর পড়ত – গরুর গাড়ি, পুকুরে স্নান করতে যাওয়া বা স্নান করে ফিরে আসা লোকের সারি, ফেরিওয়ালা – সব কিছুর মিনিয়েচার, হাই কন্ট্রাস্ট, সাদা কালো চলন্ত ছবি। এ যেন সহজপাঠ বইয়ে নন্দলাল বসুর ছবি। এই ছবি দেখাও নেশা হয়ে গিয়েছিল।
বর্ধমানে বি সি রোডে ছিল মাসির বাড়ি। ডিসেম্বর মাসের ছুটি ছাড়া বাকি অনেক ছুটিতেই আমাদের গন্তব্য ছিল ন’মাসির বাড়ি। ডিসেম্বরের ছুটিতে যাওয়া হত হরিপালে বড় পিসির বাড়ি - চৌধুরীদের মস্ত বাড়ি – প্রাসাদ বললেও অত্যুক্তি হয় না – পুরনো দিনের কাঠের সিঁড়ি আর খড়খড়ি দেওয়া মস্ত মস্ত কাঠের জানলা – ওইগুলোই টানত বেশি – মাঝের ডান্ডা ধরে খড়খড়িগুলোকে ওঠানামা করে ভেতর-বাইরে দেখার ঝোঁক ছিল খুব – তখনও চারুলতা বহুদূর। বড় পিসেমশাইরা আটটা কয়লাখনির মালিক ছিলেন, সঙ্গে কলকাতায় সাহেবদের খাবার সরবরাহের বরাত। কিন্তু একই দিনে আটটা খনিতেই আগুন লেগে পিসেমশাইরা সর্বস্বান্ত হয়ে যান। আমার জ্যাঠামশাই বলেছিলেন “রাজা কিভাবে এক রাত্রে ফকির হয় বড় জামাইবাবু তার জলজ্যান্ত জানালার বাইরে থেকে ভেতরে তাকালে সেটা বোঝা যেত। বৈভবহীন ঘরে একটা চাপা বিষাদ ঘোরাফেরা করত। আমাদের বাড়িতে বড় পিসিমণি এলেই পুরনো দিনের গল্প শুনতে চাইতাম। এইভাবেই জানতে পেরেছিলাম বড় পিসির শ্বশুরের আমলে মাহিনা করা কুস্তিগীর থাকত যারা বাড়ির সামনে কুস্তির আখড়ায় লড়াই করত আর বাড়ির মেয়েরা চিকের আড়াল থেকে সেই লড়াই দেখত।
ন’মাসির বাড়ির আকর্ষণ ছিল অন্য কারণে এবং অনেক বেশি। মেসোমশাই, মাসতুতো দাদা, দিদির কল্যাণে ঘর ভর্তি গল্পের বই। মেসোমশাই জীবনে ছোটদের বই ছাড়া কিছু পড়েননি – গল্প বলতেও পারতেন অসাধারণ – কত গল্প যে ঠোঁটস্থ – আর খুব রসিয়ে বলতে পারতেন। মাসির বাড়ি ঢুকলেই প্রাণখোলা আনন্দ। মাসতুতো দিদি লালীদি বা মাসতুতো দাদা রানাদা - যে কেউ বইয়ের আলমারির চাবি খুলে দিত। আমার উপযোগী বই বার করে নিয়ে বসে পড়তাম জানলার সিলে। বহু পুরনো দিনের বাড়ি বলে দেওয়ালগুলো ছিল ভীষণ মোটা, ফলে জানলার সিলও (জানালার ধারি বা গোবরাট) ছিল খুব মোটা। একদিকে ঠেস দিয়ে বসে আর এক দিকে পা তুলে দিয়ে পড়ার মজাই আলাদা। একটা জানলায় বসতাম আমি, আর একটায় রানাদা। সময়ের কোনও হিসেব থাকত না। দাদা বেশীরভাগ সময় পড়ত কিরোর হাত দেখার বই। চলে আসার আগে লালীদি নিয়ে যেত বাড়ির কাছেই জ্ঞানতীর্থ বলে বইয়ের দোকানে, সেখানেও দাদার পছন্দ কিরোর কোনও বই। বিকেলবেলায় বা সন্ধ্যেবেলায় জানলা সিনেমার কাজ করত। দিদির সঙ্গে ছাদে বা বাইরে কোথাও না গেলে জানলা দিয়ে লোক দেখা আর চরিত্র বিশ্লেষণ চলত। জানলার সোজাসুজি ছিল একটা লেটার প্রেস। অনেক সময় জানলায় উঠে দেখতাম একটা কালো বড় তাওয়ার মত জায়গায় একজন কর্মচারী একটা করে কাগজ বসিয়ে দিচ্ছেন আর সেটা ওপর দিকে উঠে উল্টো দিকে ছাপা হয়ে যাচ্ছে। হ্যান্ডবিল জাতীয় জিনিসই বোধহয় বেশী ছাপা হ’ত। এখনকার অনেকেই হয়ত এই লেটার প্রেস দেখেনি।
এই জানলা দিয়েই মাসিরা নকশাল আমলে এক রাত্তিরে একটা খুন দেখেছিল। একজন মাঝবয়সী লোককে রাস্তার ওপর ছুরি মারা হয়, সে বহুক্ষণ রাস্তায় পড়ে কাতরাতে থাকে, মেসোমশাই আর দাদা চুপিচুপি ছাদে উঠে গিয়ে দেখতে থাকে। কেউ সাহায্য করতে বেরিয়ে আসে না, লোকটি ওখানেই ধীরে ধীরে মারা যায়।
মাসির বাড়ির আকর্ষণ যদি ছিল এক আলমারি বই তাহলে মামারবাড়ি রাঁচি-তে প্রধান আকর্ষণ ছিল প্রতিটি ঘরে অন্তত এক আলমারি বই। বইয়ের সমুদ্র, বইয়ের পাহাড়। এই বাড়িতে সব ঘরের জানলার সিলে বসা যেত না, ব্যতিক্রম পড়ার ঘর। কিন্তু চেয়ার টেবিল খাট সোফা যে কোন জায়গায় পড়া যেত। বড়দা-ছোড়দার ঘরের জানলা থেকে দেখা যেত দূরে রাঁচি পাহাড়, তার টঙে একটি সাদা মন্দির, তার মাথায় জ্বলছে একটা লাল আলো, আর শোনা যেত হারমোনিয়াম সহযোগে সাধুদের কীর্তনের একটানা আওয়াজ, রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে গেলেও কানে আসত কত্তাল আর কীর্তনের শব্দ। রাত্রিবেলা শোয়ার আগে রোজ এই দৃশ্যটা দেখতে আমার খুব ভাল লাগত।
ছোটবেলার আবছা একটা স্মৃতি – সেটা নিজের মনে থাকা না বড়দের স্মৃতিচারণ শুনে মনে ঠাঁই নেওয়া – জানি না। জ্যাঠামশাই ঠিকাদারি করতেন – ম্যানেজার ছিলেন বিজয়কাকু। প্রতিদিন সকালে ওনাকে টাকা দিতে দেখতাম – একদিন ড্রেসিং টেবিলের ওপর দু’টাকার একটা বান্ডিল দেখতে পেয়ে সেটাকে নিয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলাম – কাকু, এই নাও টাকা। এ পর্যন্ত শোনা। আমার শুধু মনে আছে কাকুর নিচু হয়ে বাগানে টাকা কুড়নোর দৃশ্য।
আমাদের নিজেদের দুর্গাপুজো। তিনদিন নির্বিঘ্নে কেটে যেত – বিসর্জনের দিন জ্বর আসবেই - তিন রাত্রি শিশির লাগার ফল হয়ত – বাড়ির প্রতিমা রাস্তা দিয়ে পুকুরের দিকে বিসর্জিত হতে যেত – নিরুপায় হয়ে দেখার উপায় সেই দোতলার দরজা সমান জানলা। মায়ের কোলে বসে থাকতাম – আর নিচে থেকে ছোট-বড় সবাই দুঃখু দুঃখু মুখ করে তাকিয়ে থাকত।
ইতিহাসের পাতায় ‘জানালা’ জায়গা করে নিয়েছে। ১৬৬৩ সালের ৫ এপ্রিল শায়েস্তা খানের ওপর শিবাজীর আক্রমণের সময় মুঘলদের যাবতীয় কীর্তি-কলাপ তরবারির এক কোপে রাতারাতি নস্যাৎ হয়ে যায়। আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খাঁ-কে শায়েস্তা করার ঘটনা শিবাজীর জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা আজও লোকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। দাক্ষিণাত্যের সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৬০ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে ১৬৬৩-র এপ্রিল এই চার বছরে লাগাতার ভয়ঙ্কর আক্রমণ করে শিবাজীর রাজত্ব তছনছ করে দেন। এমন কি পুনা-ও দখল করে নেন ৯ মে, ১৬৬০ সালে। ৫ এপ্রিল (১৬৬৩) চাঁদ উঠলে চারশ জন বিশ্বস্ত মালোয়ালী সেনা নিয়ে শিবাজী গোপনে দুর্ভেদ্য লাল মহল (শিবাজীর নিজের প্রাসাদ) পুনর্দখলের জন্য অভিযান করেন। পঞ্চাশটি অনুচর নিয়ে রান্নাঘরের অশক্ত দেওয়াল ফুটো করে প্রাসাদে প্রবেশ করেন। তারপর তাঁরা শয়ন-কক্ষের দিকে ছুটে যান, কাপড়ের পার্টিশানগুলো কেটে ফেলে বিছানায় শায়িত মুঘলদের আক্রমণ করতে থাকেন আর প্রচন্ড গোলমাল করতে থাকেন যাতে শত্রুপক্ষ আরো ঘাবড়ে যায়। চীৎকার, চ্যাঁচামেচি, কান্নাকাটির মধ্যেই শিবাজী আর তাঁর দলবল ওখান থেকে সরে পড়েন আর যেখান থেকে এসেছিলেন সেই সিংহগড়ে পালিয়ে যান। পরে আবিষ্কৃত হয় যে শায়েস্তা খান প্রাণে বেঁচে গেলেও জানলা দিয়ে পালাবার সময় শিবাজীর তরবারীর এক কোপে তার হাতের আঙুলগুলো কাটা যায়।
শিবাজীর অতর্কিত আক্রমণ থেকে শায়েস্তা খাঁ-এর আঙুল হারিয়ে কোনক্রমে পলায়ন করে।
হাজার হাজার মুঘল সেনা দ্বারা পরিবেষ্টিত মুঘল ছাউনির মধ্যে ঢুকে অবিশ্বাস্য ভাবে দাক্ষিণাত্যের সুবেদার শায়েস্তা খাঁ-র ওপর এত সুনিপুণ পরিকল্পনা আর সফল আক্রমণের জন্য শিবাজীর বুদ্ধিমত্তা আর সাহসিকতার খ্যাতি বহু গুণে বেড়ে গেল আর মুঘল সম্রাটের ব্যাপক অপমান হল কিন্তু এই অবিশ্বাস্য অভিযানে সব থেকে কাজের কাজ হল শায়েস্তা খাঁ-কে নিরাপত্তার জন্য প্রথমে বুরহানপুর ফিরে যেতে হল আর তারপর একেবারেই সরে যেতে হল বঙ্গাল প্রদেশে। চার বছরে মুঘলরা যা যা দখল করেছিল, শিবাজী এক ঘায়েই সব নস্যাৎ করে দিলেন। এখানেও এক জানালাই বদলে দিল ইতিহাস।
পরিমল গোস্বামী তাঁর স্মৃতি কথা স্মৃতিচিত্রণ-এ জানিয়েছেন,
"আর এক কবির কথা বলতে হবে – জগদীশ ভট্টাচার্য...কলেজ বয়ের ছদ্মবেশে উৎকৃষ্ট কবিতা লিখছে তখন। তার কলমেও কলেজ বয়ের গন্ধ –
রোজ বিকেল বেলা এই জানলাখানির
ঠিক সামনে দিয়ে
ওই ঘড়ির কাঁটায় সোয়া পাঁচটা হলে
এই রাস্তা বেয়ে ধীরে যায় সে চলে।
তুমি চিনবে ওকে
তার করুণ চোখে
খুব ক্লান্ত বিষণ্ণতা ফুটবে তাতে
খান তিনেক পুঁথিও আর থাকবে হাতে;
যাবে আপন মনেই তার মেয়েলি বাঁটের
ছাতা বাঁ হাতে নিয়ে।
রোজ বিকেল বেলা এই জানলাখানির
ঠিক সামনে দিয়ে।
ক্রমে তার মধ্যে একটি একটি করে সৌন্দর্য আবিষ্কার হবে, এবং তোমার অবস্থা কি হবে বলা বাহুল্য। অর্থাৎ...
ঠিক দুদিন পরেই বাসা বদলে এদিকে
তুমি আসবে চলে।
আর তাহারো দুদিন পরে ধরবে পিছু,
ওহে বাড়িয়ে বলিনি আমি তেমন কিছু;
ছেলে তোমার মতো
দেখে এলাম কত!...(নভেম্বর ১৯৩৪)
কাছে বসে দূর থেকে দেখার ছল! অর্থাৎ “দেখে এলাম কত” এই বিজ্ঞজনোচিত কথাটাই একটা ছলনা।
ইংলিশ অনার্সের ক্লাসে ঘটক স্যার অক্সিমরঁ (Oxymoron - বিরোধাভাস) ফিগারস্ অভ স্পীচ বোঝাতে গিয়ে অবিস্মরণীয় উদাহরণ দিয়েছিলেন – “আমরা কলেজে পড়ার সময় ‘কেয়ারফুলি কেয়ারলেস’ হয়ে চুল না আঁচড়ে চাদর লুটিয়ে মেয়েদের হস্টেলের জানালার সামনে পায়চারি করতাম”। প্রেমে যুগ যুগ ধরে জানালার এক অসামান্য অবদান রয়েছে। প্রেমের সঙ্গে বর্ষাকালের একটা সম্পর্ক রয়েছে – “এমন দিনে তারে বলা যায়” ইত্যাদি। কিন্তু জানালা দিয়ে শুধু বৃষ্টি পড়া দেখাও কি কম রোম্যান্টিক!
‘ঝরোখা’ উচ্চারণে মনে পড়ে যায় সেই দুর্ভাগা ভারতীয় মেয়েটির কথা যে ব্রিটিশ আমলে একজন ব্রিটিশারকে ভালোবেসে চিঠি লিখে দেখা করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সাহেবটি যখন দেখা করতে এল ঝরোখা থেকে মেয়েটির শুধু দু’টি হাত বেরিয়ে থাকতে দেখল যেগুলি মণিবন্ধ থেকে কাটা। বিজাতীয় লোককে চিঠি লেখা আর ভালোবাসার জন্য বাড়ির লোকের দেওয়া শাস্তি। এই মর্মন্তুদ ঘটনা এখনও ভারতবর্ষে কতটা প্রাসঙ্গিক! প্রতিদিন আরও কি ভয়ঙ্কর ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে চলেছে!
আমাদের সকল কাজের কান্ডারী রবীন্দ্রনাথের একটি অপূর্ব লেখনী স্মরণ করে জানালা বন্ধ করি এইবেলা –
ওই জানালার কাছে বসে আছে
করতলে রাখি মাথা
আর কোলে ফুল পড়ে রয়েছে
সে যে ভুলে গেছে মালা গাঁথা।
(www.theoffnews.com Window)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours