মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:

ঘড়িতে বাজছে বারোটা, তাজমহলের থেকে ৪০ কিমি দূর ফতেহপুর সিক্রী, যেতে লাগবে ঘন্টা খানেক, ফিরতেও তাই, মাঝে দেখতেও ঘন্টাখানেক। বুঝতেই পারছি লাঞ্চ করতে করতে তিনটে হবেই কিন্তু বছর দশেক আগে এসে সেই যে সিক্রীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, আজও তা অমলিন। এবার কর্তাকে দেখাব ভেবেই বেশ উত্তেজিত কারণ ইতিহাস তার বেশ প্রিয় বিষয়। গাড়ী থেকে নামতেই দেখি গাইড হাজির, বুঝলাম তাজমহলের গাইড ভদ্রলোক ফোনে খবর দিয়ে দিয়েছেন। এখানেও ই-রিক্সা চড়ে আগে সিক্রী দেখাতে নিয়ে গেল শেষে দেখাবে ফতেহপুর। 

আসলে সিকরি হল বিন্ধ্যপর্বতের ওপরের ভাগের একটা গ্রাম, যার চারপাশে ছিল সুন্দর জলাশয়, চারিদিকে সবুজে ঘেরা। প্রগৈতিহাসিক যুগ থেকে নানান বণ্য প্রাণীর সাথে আদিম গুহা মানবরাও থেকেছে।

প্রস্থর যুগের যন্ত্রপাতিও পাওয়া গেছে এখান থেকে, সাথে নানান গুহাচিত্রও। মহাভারতেও পান্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞের সময় সহদেব জয় করেছেন সৈক নামের এই জায়গাটিকে। সৈক মানে জলে ঘেরা জায়গা। পরবর্তী কালে নাম বদলে দাঁড়িয়েছে সৈকরি তা থেকে সিক্রী। যুগে যুগে মানুষ এখানে বসতি স্থাপন করেছে, মাটি খুঁড়ে যেমন দুই লক্ষ বছরের পুরোনো পাত্র পাওয়া গেছে তেমনি দেখা গেছে দশম, একাদশ শতাব্দীর জৈন মূর্তি। এ'পথে চলতো উত্তরের সাথে দক্ষিণের জলপথে ব্যবসা বাণিজ্য। 

বাবর খানওয়া যুদ্ধের সময় সিক্রী দেখে মুগ্ধ হন, সময়টা ১৫২৭ খ্রীষ্টাব্দ, যুদ্ধে জিতে তৈরী করেন জলমহল আর একটি ধাপ কাটা কুয়ো মানে বাউলি। পরে বাবরের নাতি আকবর নিজের রাজধানী নিয়ে আসেন সিক্রীতে।

সিক্রী হল মুঘল আমলের প্রথম প্ল্যানড সিটি।এখানে ক্যরাভানে থাকতেন সুফী সেলিম চিস্তি, যিনি প্রতিবার সুস্থ জীবিত সন্তানের আশায় আসা সম্রাট আকবরকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন। পরে চিস্তির সন্তান নাকি সম্রাটের যাতে বংশধর থাকে সেই উদ্দেশ্যে নিজের ছয় মাসের সন্তানকে বলি দেন আর যোধাবাই ওরফে মারিয়ামের কোল আলো করে আসে সেলিম মানে জাহাঙ্গীর। 

আনন্দে সিক্রীকে ঢেলে সাজান সম্রাট আকবর, গড়ে ওঠে বাজার দোকান, হাসপাতাল, স্কুল। সেলিমচিস্তের মৃত্যুর পর দরগা বানিয়ে তাঁকে যথাযথ সম্মান দেন জালালুদ্দিন মহম্মদ আকবর। 

এখানকার টোপোগ্রাফি অনুসারে সবচেয়ে উঁচু জায়গাটি ধর্মস্থান যার নাম ফতেহবাদ থেকে বর্তমানে ফতেহপুর। যেখানে রয়েছে জাম্মা মসজিদ, সেলিম চিস্তের দরগা। এখানেই নিজের ফতেহ মানে জয় করার স্মারক বুলন্দ দরওয়াজা, দাক্ষিণাত্য জয়ের নিশান বানান সম্রাট আকবর। সবটাই রেড স্টোনে বানানো। 

এরপর মাঝের সমতল জায়গায় সিক্রীতে রাণীদের মহল, মীনাবাজার, শাহী বাজার, বৈঠক, বাগান আর একদম নীচে পাঁচমহল, খোয়াববাগ, অনুপ তালাও ইত্যাদি। সাধারণ লোকেদের জীবিকা ছিল পাথরের কাজ, চামড়ার কাজ, কাঠের কাজ।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় এত জমজমাট পরিকল্পিত রাজধানী যেখানে সম্রাট আকবর দীন ইলাহী চালু করলেন, ঢেলে সব সাজালেন, মাত্র পনেরো বছর পরেই পাঞ্জাবের বিরোধিতা সামলাতে লাহোরে  রাজধানীকে সরিয়ে নিয়ে চলে গেলেন আকবর। আর জল কষ্টে সিক্রী হয়ে গেল পরিত্যক্ত নগরী। জলে ঘেরা বলে যে জায়গার নাম ছিল সৈক তার কি করুণ পরিণতি ভাবলে অবাক লাগে। 

গাইডের সাথে প্রথমে সিক্রী ঢুকেই সামনে দেওয়ানই খাস, যেখানে প্রজাদের কথা শোনা, বিচার সব কিছুই চলত। এরপর যোধাবাই মহল, যেখানে কারুকার্যে রাজপুত ঘরানার ছাপ সুস্পষ্ঠ। প্রিয় এবং প্রধাণ মহিষীর সাজগোজের, রান্নার সব আলাদা আলাদা মহল, কি অনবদ্য কারুকার্য!মেয়েদের কানের ঝুমকোর ডিজাইন থেকে শুরু করে শীতল পাটি, নানান জ্যামিতিক নকশা দিয়ে প্রতিটি পিলার, কার্নিশ, পরদা বানানো। 

চোখ বুঁজলেই মনে হয় ওই তো যোধাবাই স্নান সেরে তুলসী মঞ্চে জল দিচ্ছেন, এরপর রান্নাঘরে তৈরী হবে সুস্বাদু সব নিরামিষ রান্না যাতে থাকবে তার বাপের বাড়ীর রাজস্থানের ছোঁয়া। 

খানিক দূরে অনুপ তালাও, সবুজ জল টলটল করছে, এক কালে এই জলের কাছে সম্রাটের হারেমের মেয়েরা তাদের মনের কত কথা বলেছে। 

একদম মাঝ খানে বিনোদন ক্ষেত্র যেখানে বৈজু বাওরা রাগ মল্লাহার বাজিয়ে বৃষ্টি নামাচ্ছেন তো তানসেনের বাজানো দীপক রাগে আগুন জ্বলে উঠছে।

সাদা মার্বেলের ওপর কালো কাটা চিহ্ন, দাস দাসীদের ঘুঁটি করে চলত লুডো সহ নানান ধরণের খেলা। অদূরেই পাঁচ মহলা হারেম সম্রাটের! এছাড়া খোয়াববাগ আসলে লাইব্রেরি, পেন্টিংস, মুরাল দিয়ে সাজানো থাকত। সেখানে আছে দোতলা সমান সম্রাটের উঁচু পাথরের পালঙ্ক যাতে সিঁড়ি দিয়ে চড়তে হয়, সুন্দর ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা ঘরখানিতে সম্রাটের দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামাগার।

প্রতিটি বিল্ডিং হয় উত্তর নয় পূর্ব মুখে বেরোনোর দরজা, এমন ভাবে বিল্ডিং বানানো যে উঁচু দেওয়াল পেরিয়ে এক মহল থেকে অন্য মহল দেখা যায় না। তবে খোয়াববাগ আর হারেম সরু রাস্তা দিয়ে যুক্ত কিন্তু সে আসা যাওয়ার পথ লোকচক্ষুর আড়ালে। 

এরপর সিক্রী দেখা শেষ হলে ই-রিক্সা চেপে এলাম ফতেহপুর, এখানে জুতো খুলে ঢুকতে হয়। সেলিম চিস্তের দরগায় ফুল, চাদর চড়ানোর ব্যবস্থা আছে। একদিকে পরপর সুফী সেলিম চিস্তের আত্মীয়দের কবর, বাইরে পুরুষদের, ভিতরে মেয়েদের।

এখানেই ছিল আনারকলিকে যেখানে অন্ধকুঠুরিতে রাখা হয়। ওটি আসলে গুপ্ত রাস্তা, ওই পথ ধরেই আনারকলি লাহোর দূর্গে পালায়। এরপর বুলন্দ দরওয়াজার সামনে ছবি তুলে যখন বেরোলাম, ঘড়িতে বাজে দুপুর আড়াইটে। 

কাছেই দোকান থাকলেও কর্তার অফিসের আগ্রা ব্রাঞ্চের জুনিয়র ছেলেটির ঘনঘন ফোন আসছে সে অপেক্ষা করছে একসাথে লাঞ্চ করবে বলে। বারণ করলেও শুনছে না। অবশেষে তাকে পাওভাজি আর কোল্ড কফির অর্ডার দিতে বলে ঝড়ের গতিতে আগ্রার হলদিরামে গেলাম।

মায়ঙ্ক নামের ছেলেটি ”হ্যাপি দিওয়ালী ম্যাম!” বলে এক তোড়া লাল গোলাপের বুকে আমার দিকে এগিয়ে দিতেই আমার খুশিতে থার্টি সিক্স অল আউট।

খাবার পরে দেখি গাড়ীতে কোল্ড ড্রিংকস, বিস্কিট, কেক, কফির ক্যান, চিপ্স, আগ্রার পেঠা সব ভরেছে। তার স্যার আর্তস্বরে চীৎকার করছে, ”করেছিস কি? করেছিস কি? নিয়ে যা নিয়ে যা এসব!”

সেও নাছোড়বান্দা, ”আমাদের রাজ্যে এসেছেন, রাস্তায় ঘুরবেন, সব লাগবে দেখবেন।”

ভাগ্যিস দিয়েছিল, সে গল্প পরবর্তীতে হবে। 

এদের তর্কাতর্কি মিটলে একসাথে ছবি তুলে রওনা হলাম আগ্রা ফোর্টের দিকে, কারণ পাঁচটার পরে ঢুকতে দেয় না সেখানে। ৯৫ বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে বিশাল ফোর্ট, এখন বেশির ভাগ জায়গাই সেনাবাহিনী থাকে। র‌্যাম্প দিয়ে উঠে গিয়ে সামনেই রাখা জাহাঙ্গীরের বাথটাব, মামার বাড়ী থেকে আনা টাবটি ছিল সোনায় মোড়া। তাতে দূর্মুল্য রত্ন খচিত। ইংরেজরা ন্যাড়া মুড়ো করে ছেড়ে দিয়েছে। ফোর্টটি ইঁটের ওপর লাল স্যান্ড স্টোনের তৈরী তাই আর এক নাম লাল কিলাও বটে, অপূর্ব সব কারুকার্য। 

শাহজাহান মহল, সবচেয়ে সুন্দর, প্রতিটি সাদা মার্বেলের ওপর দামী রত্ন বসানো আলো পড়লেই জ্বলজ্বল করছে। বড় শখ করে বানান শৌখিন সম্রাট শাহজাহান। শীশমহলও বলে তাকে, দাদুর ওই ইঁটের ওপর মার্বেল বসানো মোটেই পছন্দ ছিল না বলেই শুধু মার্বেল দিয়ে বানান তাজমহল। এরপর নিজের জন্য কালো মার্বেলের তাজ  বানানোর খবর পেয়ে আর খরচের অঙ্ক শুনে ছেলে ঔরঙ্গজেব বাবাকে তাঁর পছন্দের শাহজাহান মহলেই গৃহবন্দি করেন। 

দুই পাশে দুই মেয়ের মহল। তবে জাহানারার  মহলটি বেশি সুন্দর, খোলামেলা। তবে দুটি মহলেই ওপরে পাল্কির মত করে বারান্দা কারণ দুজনেই যে চিরকুমারী। শাহজাহানের মহলের কারুকার্য একদিকে যেমন মুগ্ধ করে তেমন দূর থেকে তাজমহল দেখতে দেখতে মনে হয় অত শৌখিন মানুষ কি ভেবেছিলেন তাঁর শেষ বয়সটা এভাবে নিঃসঙ্গতা আর হতাশায় কাটবে! কর্ম ফল হয়ত!

আগ্রা ফোর্টের খোলা ছাদের ওপর  কালো পিওর গ্রানাইটের মন্ত্রীর বসার জায়গা আর উল্টো দিকে ধবধবে সাদা মার্বেলের উপর সম্রাটের বসার জায়গা। সম্রাট তার কাছের পারিষদ নিয়ে খাস  পরামর্শ চালাতেন। ইংরেজদের কামানের তোপ উড়ে আসায় চিড় ধরে গেছে সেই কালো  পাথরে, গোল গর্ত হয়ে গেছে পাশের দেওয়ালে। গাইড বলল প্রচুর জিনিস চুরি করেছে সারানোর কর্মীরা, দোষ হয়েছে টুরিস্টদের। খুঁটে তুলে নিয়েছে মার্বেলের ওপরের স্টোন গুলো। 

পড়ন্ত সূর্যালোকে লাল আগ্রা ফোর্টকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল কত ইতিহাসের সাক্ষী এই পাথুরে দেওয়ালগুলো! লোধী থেকে সুরী মোঘল থেকে জাঠ, মারাঠা কত ধরণের সুলতান, সম্রাটরা এসেছেন, গেছেন। চলেছে ভাঙ্গাগড়ার খেলা, তারপর একসময় কালের গর্ভে সবই বিলীন হয়ে গেছে প্রকৃতির আপন খেয়ালে। 

কত নতুন চিন্তাধারার সাক্ষী এই ফোর্ট। জাহাঙ্গীর বানিয়েছিলেন বিশাল ঘন্টা, যাতে সরাসরি গরীব প্রজা তার সমস্যা জানাতে পারে নির্দ্বিধায়, শের শাহ শুড়ি বানালেন সুবিশাল গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড, পথের পাশে জলসত্র, সরাইখানা, আনলেন ঘোড়ার ডাকের ব্যবস্থা। শাহজাহান স্থপতি, কারিগর এনে বানালেন কত ধরণের আর্টর মিশেলে স্তম্ভ, ঝরোখা! 

পাশ থেকে পবনের বন্ধু গাইড ছেলেটি বলে উঠল “ভাবী, আপ বহুত থাক্ গয়ে! গরম পানি মে নাহাকে শো যাইয়ে হোটেল যা কে।“ 

সত্যিই আর শরীর চলছে না যেন! কিন্তু একেবারে  কিছু কেনাকাটা করব না তাও কি হয়!

এদিকে দীপাবলী তাই অর্ধেক জায়গায় পুজো চলছে। পবন তার চেনা বিরিয়ানীর দোকানে ফোন করে জানল আজ বন্ধ! অতএব হোটেলের ঠিক পাশের ইউপি হ্যান্ডলুমে ঢুকে টুকটাক কেনাকাটি সেরে হোটেলের ঘরে খাবার আনিয়ে লম্বা ঘুম দিলাম। পরেরদিন ভোরে গোয়ালিয়র আর ঝাঁসি ফোর্ট দেখতে যাওয়া। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com Fatehpur Sikri Agra Fort tour)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours