মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:
আগেরদিন আগ্রা ঘুরে পা প্রায় পাথরের মতো অবস্থা তবু নতুন জায়গা দেখার আগ্রহে সাত তাড়াতাড়ি উঠে সব সেরে বেরোতে বেরোতে ৯টা বাজল। ব্রেকফাস্টে গরম পুরি (ভুলেও পুরিকে লুচি বলে লুচিকে অপমান করব না) আলুর রসা মানে ঝোলই বেশি আলু খুঁজতে হবে খেয়ে রওনা দিলাম। প্রায় তিন ঘন্টা লাগবে, ইচ্ছে আগে গোয়ালিয়র ফোর্ট দেখে রাস্তায় লাঞ্চ করে ঝাঁসি চলে যাব। কর্তার অফিসের ছুটি কম তাই এমন হ্যারিকেন সফর। আমার অবশ্য যা পাই যতটুকু পাই তাই চেটেপুটে খাই---তাই ঝটিকা সফরেও রাজি। তবে গোয়ালিয়র আরও একবার যেতে হবে পরে।
আগ্রা পেরিয়ে ধোলপুর হয়ে গাড়ী চলেছে, কেমন আস্তে আস্তে প্রকৃতিও পাল্টে যাচ্ছে। পবন হঠাৎ বলে উঠল “ম্যাডাম, আমরা কিন্তু রাজস্থান দিয়ে যাচ্ছি। “চমকে বলি “সেকি ইউপি আর এমপির মাঝে রাজস্থান কি করে এল?”
হাসতে হাসতে পবন বলে “সেটাই তো, একটু খানি রাজস্থান ঢুকে গেছে।“
খানিক পরেই একটা নদী আর তার পাশের সবুজ পাহাড় দেখিয়ে বলে উঠল পবন “দেখুন, এবার চম্বল দিয়ে পাস করছি, এখন আর ডাকাত থাকে না, ওদের ছেলে মেয়েরা পরীক্ষা দিয়ে পুলিশের নোকরি করছে। গোয়ালিয়র মধ্যপ্রদেশে কিন্তু ঝাঁসি আবার উত্তর প্রদেশ। আজ আমরা তিনটে রাজ্যই ছুঁয়ে গেলাম।“
প্রায় বারোটা নাগাধ পৌঁছলাম গোয়ালিয়র, বেশ পাহাড়ি রাস্তা পথের পাশে পাহাড় কেটে বানানো বিশাল জৈন ধর্মগুরুদের মূর্তি। সর্বোচ্চ মূর্তিটি ৫৮ ফুট লম্বা, চলন্ত গাড়ী থেকে ভাল ছবি তুলতে পারলাম না। এরপর একটা গোল চক্কর থেকে দু'দিকে দুটি রাস্তা গেছে এক দিকে বর্তমানের রাজা রাজরাদের পুত্র কন্যাদের পড়বার জন্য সিন্ধিয়া স্কুল, মাধব রাও সিন্ধিয়ার প্রতিষ্ঠিত। আর একদিকে গেছে ফোর্টের রাস্তা।
ফোর্টের সামনে, বাইরের রঙ্গীন কারুকার্য স্তব্ধ করে দেয় দর্শকদের, সুবিশাল ফোর্ট, ষষ্ঠ শতাব্দীরও আগে তৈরী হয়েছে। কত হাত বদল হয়েছে সময়ের সাথে সাথে, কখনও এসেছে হুণ রাজ মিহিরকূল, কখনও ঘোরী, গুর্জর, প্রতিহাররা, কখনও রাজপুত তোমার বংশ, কখনও ইব্রাহিম লোদী তো কখনও মুঘল সম্রাট বাবর। এসেছে শের শাহ, হিমু, আকবর থেকে জাহাঙ্গীর, শাহজাহান পরের দিকে ব্রিটিশরা, শেষে মারাঠারা।
ফোর্টের ভিতর ঢোকার দুটো গেট –একটা উত্তর পূর্ব দিকে যেখানে হাতির পিঠ থেকে নামার জায়গা মানে হাতি পোল আছে। এখানেই মান সিং তোমারের মহল, সবচেয় ভাল ভাবে সংরক্ষিত। অন্য গেটটি দক্ষিণ পশ্চিমে, বিশাল পাকদন্ডীর পথ, পায়ে হেঁটে আসার।
ফোর্টে ঢুকেই গাইড প্রথমেই কর্ণ মহল নিয়ে গেলেন ---- 'তোমার' বংশের রাজা কীর্তি সিং তৈরী করেন মহলটি। অনেক ঘটনার সাক্ষী মহলটি, সুন্দর খোলামেলা মহল, বড় বড় লোহার আংটা ঝুলছে ঘরের মাঝেই ছাদ থেকে, ঝুলা লাগানো থাকত প্রথমে কিন্তু কালের নিয়মে কখন যেন সেই আংটা গুলো দিয়ে ফাঁসীর দড়ি ঝুলতে ব্যবহার হতে শুরু হল।
মুঘলরা জেল আর ফাঁসি ঘর হিসেবে ব্যবহার করেছে এই কর্ণ মহলকে --- আকবর তার সৎ ভাইকে মেরেছেন, জাহাঙ্গীর বন্দি করে রেখেছিলেন বারো বছরের গুরু গোবিন্দকে, ঔরঙ্গজেবের ভাই মুরাদকে অত্যাচার করে মেরেছেন এই মহলেরই ঘরে।
ঘরগুলি এমন ভাবে তৈরী যে একটি ঘর থেকেই পর পর সব ঘরের দরজা দেখা যায়, কে আসছে কে যাচ্ছে অনায়াসে লক্ষ্য রাখা সম্ভব।
কর্ণ মহলের বাইরে এক জায়গা রয়েছে যেখানে বাইরে থেকে তোপ ছুঁড়েছিল ব্রিটিশ সেনারা ক্যাপটেন হিউ রোসের নির্দেশে। উদ্দেশ্য ছিল রাণী লক্ষীবাইকে উড়িয়ে দেওয়া।
রানী লক্ষীবাই এসেছিলেন ঝাঁসি থেকে গোয়ালিয়রে সিন্ধিয়াদের কাছে সাহায্য চাইতে, খবরটা বিশ্বাসঘাতক সিন্ধিয়ারাজ ব্রিটিশদের পাচার করেন।
কিন্তু বিধাতার পরিহাসে অল্পের জন্য বেঁচে যান রাণী কারণ ততক্ষণে দুই কিলোমিটার এগিয়ে গিয়েছিলেন প্রিয় ঘোড়া বাদলের পিঠে চেপে।
দূরে একটা মহল দেখিয়ে গাইড বললেন ওটা গোলা বারুদ রাখার মহল। দূরে টলটল করছে জহর কুন্ড, যুগে যুগে সম্মান বাঁচাতে হিন্দু নারীরা এই পথই বেছে নিয়েছেন।
এরপর দেখলাম ভিক্রান্ত মহল, কীর্তি সিং এর নাতি, মান সিং তোমারের পুত্র ছিলেন শিব ভক্ত, মুঘলের আক্রমনে তার মহলের ভিতরের প্রতিষ্ঠিত মন্দির ভাঙ্গলেও মূর্তি মাটির নীচে চাপা পড়ে যায়। বর্তমানে মাটি খুঁড়ে খুঁজে পেয়ে এখন মহলের বাইরে রেখে পূজা হয়।
দূরে ছিল জাহাঙ্গীর মহল আর শাহজাহান মহল, খুবই শোচনীয় অবস্থা, শুনলাম টাকা মঞ্জুর হয়েছে, চারিদিকে ঘাস বসানো হবে। এই চারটি মহলের মাঝের খোলা জায়গা জুড়ে বিশাল সিঁড়ি কাটা জলাধার, যেখান থেকে শ্রমিকদের বউরা সারাদিন খালি ভিস্তা ভিস্তা জল তুলত, প্রাসাদে ব্যবহারের জন্য, শ্রমিকদের মহল বানানোর জন্য। বেরিয়ে আসার আগে ঘোড়াশাল দেখলাম, বাইরে রাখা ব্রিটিশ আমলের তোপখানিও দেখলাম।
এবার ৫০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকলাম মান সিং মহলে, এককালের সবচেয়ে প্রতাপশালী রাজা মান সিং তোমার! রাজার আট রাণীর জন্য নাচ, গান শেখার জায়গা বানিয়েছেন অপরূপ কারুকার্যে সাজানো পিলার দিয়ে। নবম রানী মৃগনয়নী গুর্জরী কন্যা, অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ---পাঁচ ভুতের ব্যবহার্য জল তিনি ব্যবহার করতে পারেন না।
তাই একটু দূরে তাঁর নিজস্ব মহল নাম গুর্জরী মহল। বর্তমানে তা মিউজিয়াম, শুক্রবার থাকায় সেটি যথারীতি বন্ধ। মানসিং মহলের কারুকার্য দেখার মতো, মা হাতি কোলে শিশু হাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে, এক জায়গায় ড্রাগনের মুখও দেখলাম। গাইড বললেন জনৈক চৈনিক পরিব্রাজককে বিশ্রামের অনুমতি দেন রাজা মান সিং, সে সময় মহল তৈরী হচ্ছে, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন ড্রাগনের প্রতিকৃতি বানিয়ে দেন সেই চৈনিক পরিব্রাজক।
এরপর মাটির নীচে তিনটে তলা পাথুরে সিঁড়ি ভেঙ্গে দেখতে গেলাম ---ঈশ্বরই জানেন কোথা থেকে মনের জোড় পাই! সে সময় বিধর্মীদের আক্রমনের ভয়ে রাণীদের মহল বেশির ভাগই মাটির নীচে। ওপরে প্রাঙ্গণ জুড়ে নৃত্যগীত বাদ্য চর্চা, প্রমোদ বিনোদনের ব্যবস্থা কিন্তু বিশ্রাম কক্ষ, ঝুলায় দোলা, স্নানাগার সব কিছুই মাটির নীচে।
মান্ডুতেও ঠিক এক রকম স্থাপত্য। সুন্দর ইন্টার কমে কথা বলার ব্যবস্থা। পাথরের গায়ে সুগৌল ছিদ্র। এছাড়া আলো হাওয়া আসার সুন্দর ব্যবস্থা, ছোট গর্ত যার চারপাশের ছাপ বলছে সেখানে বৃত্তাকার চাকা ছিল। ঠিক যেন আধুনিক টেবিল ফ্যান। দরজাগুলো এমন ভাবে বানানো যে মাথা নীচু করে ঢুকতে হবে, দুই পাশে তরোয়ালধারী রক্ষী থাকতেন, শত্রু বুঝলে কুচ করে গর্দানটি নামিয়ে দিতেন।
এছাড়া মাটির নীচের প্রথম তলার পাথরের গায়ের ফুটোয় চোখ রাখলে দূর্গের ঝান্ডা দেখা যায়, ঝান্ডার রং সাদা দেখলে বুঝতেন সময় হয়েছে জহর করবার। একদম নীচে তলায় রাখা জলে ঝাঁপ দিতেন গায়ে আগুন দিয়ে।
মানসিং মহল থেকে বেরোবার সময়। জানলাম প্রাচীন মন্দিরে রাখা আছে আর্যভট্টের শুন্য আবিষ্কারের শিলালিপি খানি। আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে অনুমতি পেলে দেখা সম্ভব।
নামার সময় থেকে মনে হয় মঘা আর অশ্লেষা এক সাথে হল, বিশাল জ্যাম, পাহাড়ি রাস্তা, স্কুলের দিক থেকে গাড়ী বেরিয়েছে, ঘড়িতে বাজছে দুটো। ঝাঁসি খুব দূর না হলেও ঘন্টা আড়াই লাগবে তাই মাঝপথেই কোন ধাবায় খাব ঠিক করলাম।
যথারীতি ছুটির মরশুম অনেক ধাবাই বন্ধ তায় দেরীও কম হয়নি। তবু একটা খালি পেয়ে ঢুকলাম। পবন ডাল রুটি আর আমরা পনির রুটি অর্ডার দিয়ে বসে আছি, আধ ঘন্টা কেটে গেল—কর্তা আর পবনের অসীম ধৈর্য আমার শরীরে আবার ওটা দিতে ভুলে গেছেন ঈশ্বর!
উঠে গিয়ে উঁকি মেরে দেখি তারা সবাই মায় মালিক পর্যন্ত খেতে বসে গেছে। আমায় দেখেই যে যেদিকে পারল উঠে গেছে, মালিক একটা লোক দেখানো হাঁকডাক শুরু করতেই আমি অ্যবাউট টার্ন। বুঝেছি এদের হয় ভাঁড়ে মা ভবানী নয়তো অন্য কোনও সমস্যা আছে। আমার পিছু পিছু পবন আর কর্তাও বেরিয়ে এসেছে ---তখন দেখি গ্যাস সিলিন্ডারের গাড়ী এসে দাঁড়াল। বুঝলাম এতক্ষণে কেন খেতে দিচ্ছিল না ,গাড়ীতে উঠেই গত দিনের মায়াঙ্কের দেওয়া খাবার গুলোর সদগতি করলাম তিনজনে।
ঝাঁসি পৌঁছলাম প্রায় চারটে, এখানেও দেখি কর্তার অফিসের দুই জুনিয়র ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে। মনে হল ফুল পেয়ে আমার গত দিনের উচ্ছ্বাসের খবর এখানেও পৌঁছে গেছে! হোটেলটা দেখে বেশ ভাল লাগল, ড্রেস ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে চললাম ঝাঁসির ফোর্ট দেখতে।
ওরচার রাজা ভীর সিং বানান ফোর্টটি ষোলশ শতাব্দীতে। ঝাঁসি তখন গ্রাম, মারাঠা সুবেদার রঘুনাথ রাও দেখাশুনো করেন। এরপর গঙ্গাধর রাওয়ের সময় প্রজারা খুশি, ঝাঁসি যেন ফুলে ফেঁপে উঠল। বিঠুরের ব্রাহ্মণ মোরপন্থের মেয়ে মণিকর্ণিকা তাম্বে এলেন এই দূর্গের লক্ষীবাই হয়ে, গঙ্গাধর রাওয়ের স্ত্রী।
শিবভক্ত গঙ্গাধরের মন্দিরে পুজো করতে যাওয়ার জায়গাটি ঠিক ফাঁসী ঘরের পাশ দিয়ে। সে সময় চুরির শাস্তিও ছিল মৃত্যুদন্ড, রোজ পুজোর সময় ওই আর্ত চীৎকার সহ্য করতে না পেরে স্বামীকে অনুরোধ করে চুরির শাস্তি মৃত্যুদন্ড রদ করালেন। ফলে চুড়ান্ত জনপ্রিয় হোন নতুন রাণী!
তারপর প্রথমে পুত্র দামোদর রাও, পরে স্বামীর মৃত্যুর পরে রানী দত্তক সন্তান অনন্ত রাওকে (পরে নাম হয় দামোদর) নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস অবধি লড়ে যান।
রানীর ছিল দূর্গা বাহিনী, ছিল সেনাপতি জান মহম্মদ, বাবা মোরপন্থ দাঁড়িয়েছিলেন ঢাল হয়ে তাই বারবার ওরচার আক্রমন, গোয়ালিয়রের আক্রমণ রুখেছেন। প্রথমে বাধ্য হন দুর্গ ছেড়ে রানী মহলে যেতে। তবে আবার দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন।
তাঁতিয়া টোপী যে সময় ভেবেছিলেন একসাথে লক্ষীবাই এর দলের সাথে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন তার আগেই ব্যারাকপুরে জ্বলে উঠল আগুন, মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে। ফলে সময়ের আগেই লড়াই শুরু হয়, তবু হারতেন না রাণী যদি না নিজের লোকেরাই বিশ্বাসঘাতকতা করত।
দুই হাতে তরোয়াল নিয়ে লড়েছিল ২৯ বছরের মেয়েটি, চোখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে, ঘোড়ার ওপর চেতনা হারানোর আগে অবধি লড়ে গেছে মারাঠী মুলগী। প্রতিপক্ষ ব্রিটিশ জেনারেল হিউ রোস বাধ্য হয়ে বলেছেন, এত লড়াকু, এত ভয়ঙ্কর যোদ্ধা তিনি অন্তত দেখেননি তার জীবদ্দশায়।
ছ'টা থেকে শুরু হল লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো, অনেক জায়গার থেকেই বেশ ভাল লাগল, ১২৫ টাকা করে টিকিট ৪৫ মিনিট পরে বেশ ঘোরের মধ্যে থেকে শেষে হোটেলে ফিরলাম ।
পরদিন যাব কাছের গ্রাম ওরচায়, বেলা করে উঠলেও চলবে। ভাবলে অবাক লাগে একসময় ওরচা ছিল রাজধানী আর ঝাঁসি অনামী গ্রাম, আর আজ ঝাঁসী স্মার্ট সিটি, সেনাবাহিনীর বেস, আর্মি ইউনিটের নাম হোয়াইট টাইগার --- আর সেখানে ওরচা এক অনামী গ্রাম! পরবর্তীতে হবে ওরচার গল্প। এখন বাই বাই। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews Gwalior Jhansi Fort)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours