সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

আশ্চর্য পৃথিবীর এক অন্যতম বিশ্ববিস্ময়! ১১,০০০ বছর বয়েসের একটি পাথুরে স্থাপত্য, মানুষের বিকাশ সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞদের এতদিনের লালিত পালিত ধ্যান ধারণাকে তছনছ করে কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মানুষ যখন চাকা আবিষ্কার করেনি, হায়ারোগ্লিফিক্স লেখা বহু দূরের কথা, এমনকি স্টোনহেঞ্জেরও আগে একদল আদিম মানুষ এখন যাকে তুরস্ক বলা হয় সেখানে এই ছকভাঙা বিশাল প্রার্থনালয় গড়ে তুলেছিল। এটাই কি বিশ্বের প্রাচীনতম উপাসনালয়? সানলিউরফাতে অবস্থিত ‘গোবেকলি তেপে’ নামের এই ভজনালয়টি নিওলিথিক যুগের অন্যান্য সব বিখ্যাত স্মৃতি স্তম্ভের থেকে হাজার হাজার বছরের পুরনো।

তুর্কি ভাষায় ‘গোবেকলি তেপে’ মানে “নাভির পাহাড়” বা “পেটের পাহাড়” কারণ প্রত্নস্থলটি একটি ‘টেল’ - মানুষের বসতির জন্য মানুষের তৈরি একটি ঢিবি। এটি সিরিয়ার সীমান্তের কাছে উরফা প্রদেশে অবস্থিত।

তুর্কি এবং আমেরিকান নৃবিজ্ঞানীরা উনিশশো ষাটের দশকে এর কিছু অংশ খুঁজে পেয়েও ভুল করে মধ্যযুগের কবরস্থান মনে করে ততটা গুরুত্ব দেননি। কিন্তু আরও বিশদ খনন আর নব্বইয়ের দশকে জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্লাউস স্মিটের (Klaus Schimdt) রেডিওকার্বন ডেটিং থেকে জানা যায় যে মানব সভ্যতার উন্মেষ পর্বের এটি সমসাময়িক। এজন্য, অনেকে এটিকে তুর্কি স্টোনহেঞ্জ বলে থাকেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের স্টোনহেঞ্জের থেকে এটি ৬,০০০ হাজার আগে তৈরি হয়েছিল - ধাতুর সরঞ্জামের ব্যবহার আর মানুষের আদিমতম অনেক আবিষ্কারের আগে।

আনুমানিক ৯৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ‘গোবেকলি তেপে’র নির্মাণ। তখনও চলছে প্রস্তর যুগ, অধিকাংশ মানুষই যাযাবর গোষ্ঠীর। সেই সময়ে কিনা স্থায়ী উপাসনালয়? এটাই সবচেয়ে অদ্ভুত লেগেছিল স্মিটের। খননকার্য থেকে যে ধরনের পাথর ফলক পাওয়া গেছে, তাতে অন্তত এটা পরিষ্কার যে এখানে মানুষ বসবাস করত না। শয়নকক্ষ, স্নানাগার ইত্যাদির সন্ধানও মেলেনি। আয়তনেও খুব বেশি বড়ো নয় স্থানটি। ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো ১৫ মিটারের ২০টি পাথরফলক দাঁড়িয়ে আছে বৃত্তাকারে। নিশ্চয়ই গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ মাত্র কয়েকজনের জন্য বাড়িঘর বানাবে না? অথচ স্থাপত্যের প্রবেশ পথটি দেখে মনে হয় যেন এখানে নিত্য যাতায়াত ছিল মানুষের। কয়েকটি ফলকে বিভিন্ন পশুপাখির মূর্তি খোদাই করা। সব মিলিয়ে দৃঢ় হতে থাকে স্মিটের ধারণা। 

তাঁর গবেষণায় উঠে আসে আরও একটি তথ্য। শুধু উরফা নয়, মিশর, ইজরায়েল থেকে বহু মানুষ আসতেন এখানে। কয়েক হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঘুরতে যাওয়া আজকের দিনে মামুলি ব্যাপার, কিন্তু প্রস্তর যুগে নিশ্চয়ই সহজ ছিল না বিষয়টি। একমাত্র তীর্থ দর্শনের জন্যই এত দূর যেতে পারে মানুষ। স্মিট ‘প্রার্থনাগৃহ’ নির্মাণকার্যের যে নমুনা সামনে রেখেছেন, তাও রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। কয়েকশো মানুষের চেষ্টায় প্রায় দশ বছর লেগেছে মন্দিরটি তৈরি হতে। কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়। কৃষিকাজের জন্য মানুষ স্থায়ী বাসস্থান খুঁজে নিয়েছে আরও কয়েক হাজার বছর পরে।  তাহলে গোবেকলি তেপে কি বিস্ময়করভাবে ব্যতিক্রম? সেক্ষেত্রে তো মানব সভ্যতার ইতিহাসকে দেখতে হয় নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে। কীভাবে যে ওই যুগে এত ভারি পাথরকে কেটে প্রার্থনাগৃহের রূপ দেওয়া হল সেটাও আশ্চর্যের। আবার, গোবেকলি তেপে-র পাথর ফলকগুলি পাওয়া যায় প্রায় অক্ষত অবস্থায়। অনুমান, অধিবাসী যাওয়ার আগে মাটির নিচে পুঁতে রেখে যায় উপাসনালয়ের অংশগুলি। সেক্ষেত্রে প্রশংসা করতে হয় তাদের বুদ্ধিমত্তারও।

চুনাপাথর সমৃদ্ধ টরাস পর্বতমালায় ১০ হেক্টর প্রত্নস্থানটিতে ১৫ মিটার উঁচু গোলাকার এবং আয়তাকার স্তম্ভ রয়েছে। কোনও এক সময়ে হয়তো ছাদও ছিল। এই স্তম্ভগুলিতে শকুন, সাপ, শেয়াল, হরিণ এবং গৃহপালিত জন্তুর আকৃতি খোদাই করা আছে। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন যে এই খোদাই মূর্তিগুলি এই শিকারী-সংগ্রাহক গোষ্ঠীগুলির ধর্মীয় বিশ্বাসের পাথুরে নিদর্শন। কিন্তু এটা এখনও স্পষ্ট নয় যে এগুলি দেবতা হিসেবে পূজিত হতো নাকি টোটেম ছিল নাকি অমঙ্গল থেকে বাঁচতে ব্যবহার করা হত।  

পাঁচ মিটার পর্যন্ত লম্বা এই স্তম্ভগুলিতে শকুন, সাপ, শেয়াল, হরিণ এবং গৃহপালিত প্রাণীর খোদাই করা আছে। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন যে এই রিলিফগুলি এই শিকারী-সংগ্রাহক গোষ্ঠীগুলির ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রদর্শন করেছিল। এটা স্পষ্ট নয় যে এই খোদাইগুলি দেবতা ছিল, নাকি টোটেম ছিল, নাকি মন্দ ভাগ্য থেকে বাঁচতে ব্যবহৃত হয়েছিল। কেউ কেউ মনে করেন যে এটি একটি তীর্থস্থান ছিল। অন্যরা আবার মনে করেন যে এটি একটি সাম্প্রদায়িক সমাবেশের জায়গা ছিল।

একটি তুর্কি কিংবদন্তি আছে যে্টির সঙ্গে কেউ কেউ মন্দিরের বারংবার ব্যবহৃত সাপের মোটিফের সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। গল্পটি হল তাহমাস্প নামে এক দরিদ্র যুবক সাপের গুহায় আটকা পড়েছিল। এখানে, তিনি সাপের রানী শাহমরানের মুখোমুখি হন, যিনি ছিলেন অর্ধেক সাপ, অর্ধেক নারী। দুজনের প্রেম হয়। যখন পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসার সময় হয়েছিল, তখন তাহমাস্প ভূগর্ভস্থ রাজ্য সম্পর্কে গোপনীয়তার শপথ নিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, ভূপৃষ্ঠের বাসিন্দারা তার গোপন রহস্য আবিষ্কার করে এবং শাহমরানকে হত্যা করে। তার মৃত্যুর কারণে, সাপ হয়ে ওঠে মানবতার নেমেসিস।

এমন একটি জটিল নকশা অনুসরণ করে প্রার্থনাগৃহটি তৈরি করা হয়েছিল যা আপাতদৃষ্টিতে সেই সময়ের মানুষের সামর্থ্যের বাইরে ছিল। ইজরায়েলের পণ্ডিত গিল হ্যাকলে এবং আভি গোফার লক্ষ্য করছেন যে প্রত্নস্থলটি “প্রায় নিখুঁত একটি সমবাহু ত্রিভুজে মিলিত হয়েছে।” এই ইচ্ছাকৃত প্রতিসাম্যের একটি উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু কি? তারার সঙ্গে একই সারিতে থাকতে, নাকি তাদের দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে? আশ্চর্যজনকভাবে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখানে পশু বলির অবশিষ্টাংশ এবং এমনকি মানুষের মাথার খুলিও খুঁজে পেয়েছেন।

‘গোবেকলি তেপে’র অসামান্য গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও প্রত্নবিদরা পাঁচ শতাংশেরও কম জায়গায় খননকার্য চালাতে পেরেছেন। এই স্থাপত্যের নীচে আরও নির্মাণ থাকতে পারে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে আরও ১৫ থেকে ২০টা পাথর দিয়ে ঘেরা কবরস্থান আর বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষ ওখানে রয়েছে। আবহাওয়াজনিত কারণে কিছু ক্ষয় হলেও বেশিরভাগ পাথর ভাল অবস্থায় আছে।

প্রাথমিক ভাবে আমাদের যাযাবর পূর্বপুরুষরা পরিযায়ী প্রাণীদের অনুসরণ করেছিল। কিন্তু ‘গোবেকলি তেপে’ মানুষের স্থায়ী বসবাসের দিকে ইঙ্গিত করছে। এর ফলেই হয়তো এই মন্দিরের মৃত্যুঘন্টা বেজে ওঠে। গবেষক সান্দ্রা স্ক্যাম দাবি করেছেন যে চাষবাসের উৎপত্তি ‘গোবেকলি তেপে’র কিছু অংশের ধ্বংসের জন্য দায়ী কারণ নিয়মিত কৃষিকাজের ফলে শিকারী-সংগ্রাহকরা তাদের আদি রীতিনীতি, ধর্মীয় আচার ব্যবহার ত্যাগ করে প্রাচীন উপাসনালয়কে অবহেলা করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

প্রস্তর যুগের এই অসামান্য স্থাপত্যের গুরুত্ব সত্ত্বেও এর উৎপত্তি এবং তাৎপর্য এখনও রহস্যাবৃত। মাঝে মাঝে কিছু খবর ভেসে উঠলেও বেশিরভাগটাই অজানা। অতি সম্প্রতি প্রত্নবিদরা এখানে নোড়া পাথর আর হাতুড়ি পাথর আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু ‘গোবেকলি তেপে’র মানে ছাড়াও প্রশ্ন রয়েই গেল যে প্রস্তর যুগের প্রথম দিকের মানুষরা এরকম একটি জটিল স্মৃতিসৌধের ধারণা আর নির্মাণ করতে পেরেছিল।

(www.theoffnews.com Gobekli Tepe)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours