সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর: 

বিজ্ঞানীদের মতে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ও শিশুদের একটি দল সম্ভবত একটি পাথুরে উপকূল বরাবর হাঁটার সময় তাদের পায়ের ছাপের প্রমাণ রেখে গেছে। 

ওই আঁকাবাঁকা যে পথ  যায় সুদূরে                          যুগ যুগ ধরে মাটিতে রয়ে যাওয়া আদিম মানুষের পদচিহ্ন আমাদের আদি পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে কী বলতে পারে? অপ্রত্যাশিত ও আশ্চর্যজনকভাবে অনেক কিছুই।

সাম্প্রতিক কালে মরক্কো, ফ্রান্স, জার্মানি এবং স্পেনের বিজ্ঞানীদের একটি আন্তর্জাতিক দল এক চমকপ্রদ আবিষ্কারের বিশদ বিবরণ প্রকাশ করেছে, এক লক্ষ বছরের পুরনো মানুষের পদচিহ্ন সমূহের একটি সুসংরক্ষিত নমুনা। পায়ের ছাপগুলি পাঁচটি মানুষের একটি দলের বলে মনে করা হচ্ছে এবং উত্তর মরক্কোর লারাচে নামক একটি পাথুরে সৈকতে এগুলি পাওয়া গেছে। 

বিজ্ঞানীরা বহু কাল ধরে মানুষের সত্যিকারের উদ্ভবের রহস্যময় জিগস পাজলের সূত্রগুলো খাপে খাপে বসানোর চেষ্টা করছেন। সুবিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রটি সেই প্রচেষ্টায় আর একটি সূত্র যোগ করেছে। কিন্তু যদিও তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার একটি প্রত্নতাত্ত্বিক কৃতিত্ব, তা সত্বেও এই প্রাচীন পায়ের ছাপের সমষ্টি উপকূলীয় ক্ষয়ের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। এবার দেখা যাক বিজ্ঞানীদের এই সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে এবং এতদিন পর্যন্ত বিভিন্ন আবিষ্কারে প্রাচীন মানুষের কী কী অবশেষ পাওয়া গেছে। 

মরক্কোতে বিজ্ঞানীরা কী খুঁজে পেয়েছেন? ২০২২ সালের জুন মাসে প্রত্নতাত্ত্বিক মুন্সেফ সেদ্রাতির নেতৃত্বে একদল গবেষক টাঙ্গিয়ারের দক্ষিণে মরক্কোর উপকূলের কাছাকাছি একটি এলাকায় বড় বড় পাথরের মধ্যে অনুসন্ধান চালাবার সময় লারাচে শহরের মাটিতে এই পায়ের ছাপগুলির গর্ত দেখতে পান। খুঁটিয়ে দেখার পর তাঁরা বুঝতে পারেন যে গর্তগুলি আসলে প্রাচীন মানুষের বিভিন্ন আকারের পায়ের ছাপ। ফ্রান্সের ‘য়ুনিভার্সিটি অভ সাদার্ন ব্রিটানি’-র ‘কোস্টাল ডাইনামিক্স অ্যান্ড মেরিন জিওলজি’ বিশেষজ্ঞ সেদ্রাতির চোখে এটি ছিল একটি “বিরল” দৃশ্য। তিনি “আল জাজিরা”-কে বলেছেন - “প্রথম পায়ের ছাপটি দেখে আমরা একশো শতাংশ নিশ্চিত ছিলাম না, কিন্তু ক্রমে ক্রমে আমরা দ্বিতীয়, তৃতীয়, তারপরে একদম স্পষ্ট একটা পায়ে চলা রাস্তা এবং আরও অনেক কিছু খুঁজে পেয়েছি। সেই সময়ই আমাদের সব সন্দেহ দূরীভূত হল। প্রায় এক লক্ষ বছর আগে একদল সুস্থ হোমো সেপিয়েন্স একটি বালুকাময় বেলাভূমির পলিমাটিতে এই পায়ের চিহ্নগুলো রেখে গিয়ে ছিল”। সম্ভবত পাঁচজন মানুষের একটি দলের সর্বমোট প্রায় ৮৫টি পদচিহ্ন পাওয়া গেছে যারা এই জায়গাটিকে চলার জন্য ব্যবহার করে জলের দিকে যাচ্ছিল। উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ ভূমধ্যসাগরে এই প্রথম আদিম মানুষের পায়ের ছাপ আবিষ্কৃত হল।

পায়ের ছাপে ধনুকের মত খিলান, গোলাকার গোড়ালি এবং কড়ি আঙ্গুলের দাগগুলি নিশ্চিত করে যে সেগুলি হোমো সেপিয়েন্স বা আমাদের মত আধুনিক মানুষের পদচিহ্ন। এখানে বিভিন্ন আকারের পায়ের ছাপ দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে ওই দলটিতে প্রাপ্তবয়স্ক এবং বিভিন্ন বয়সের বাচ্চা ছিল। বিজ্ঞানীরা অবশ্য এখনও জানেন না যে দলটি ওই জায়গায় কী করছিল। তারা কি সমুদ্র থেকে খাবার সংগ্রহ করতে চেষ্টা করছিল? নাকি তারা শুধুমাত্র ওই জায়গা দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিল আর দৈবাৎ তারা সমুদ্রতীরে উপস্থিত হয়েছিল?

এখন প্রশ্ন যে এতদিন ধরে এই পায়ের ছাপ টিকে আছে কী করে? সেদ্রাতির টীম নিজেরাই ওই অঞ্চলের পলিমাটি এবং পায়ের ছাপগুলি পরীক্ষা করে দেখেছে এগুলির বয়েস নির্ধারণের জন্য। অপটিক্যালি স্টিমুলেটেড লুমিনেসেন্স ডেটিং এমন একটি গবেষণা পদ্ধতি যা প্রত্নতাত্ত্বিকদের নির্ধারণ করতে সাহায্য করে যে আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তুগুলির আশপাশের খনিজ বা কার্বন শেষ কখন তাপ বা সূর্যালোকের সংস্পর্শে এসেছিল এবং তার থেকে তাঁরা অনুমান করতে পারেন যে ছাপগুলি কতদিনের পুরনো। তাঁদের অনুমান এগুলি লেট প্লাইস্টোসিন যুগের যে সময়ে শেষ তুষারযুগ ঘটেছিল। বিজ্ঞানীদের ব্যাপক বিশ্বাস যে মিডল থেকে লেট প্লাইস্টোসিন যুগে বা ৭,৭০,০০০ থেকে ১,২০,০০০ বছর পূর্বে প্রাচীন মানুষ পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করত যারা আধুনিক মানুষের থেকে আলাদা ছিল।

গবেষকরা একটি ড্রোনের সাহায্যে পায়ের চিহ্নগুলির ৪৬১টি ছবি তুলে একটি বিশেষ সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে ছবিগুলিকে প্রসেস করে প্রত্যেকটি ছবির ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করছেন যাতে ছাপগুলির অবতল ও প্রস্থের সঠিক পরিমাপ করে ওই পাঁচজনের বয়েস নির্ধারণ করা যায়।

গবেষকরা তাঁদের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন যে ‘লারাচে পদচিহ্নগুলি’ এতদিন টিকে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ আছে যেমন ছাপগুলির অবস্থান, সেখানের মাটির ধরণ এবং সমুদ্রের ঢেউ। তাঁরা অনুমান করেছেন যে পাথুরে চাতালে সমুদ্র সৈকত হওয়ার ফলে জোয়ারের সময় পলিমাটিতে পায়ের ছাপগুলি চাপা পড়ে গিয়ে রক্ষা পেয়ে গিয়েছিল যতদিন না সাম্প্রতিক ভূমিক্ষয় সেগুলিকে আবার অনাবৃত করে দেয়। 

উত্তর আফ্রিকান সেদ্রাতির জন্য এই আবিষ্কারটি খুবই ব্যক্তিগত। তিনি বলেছেন - “এই আবিষ্কারটি যে গবেষক দলটি করেছে তাদের নেতৃত্ব দিতে পেরে আর সেটা আমার হৃদয়ের কাছাকাছি মরক্কো শহরে হওয়ার জন্য যে আমি কতটা গর্বিত সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না”। সঙ্গে তিনি এও জানিয়েছেন যে ভূতত্ত্বের মত অন্যান্য বিষয়ের সহকর্মীদের সঙ্গে কাজটি সম্পূর্ণ করতে তিনি ভীষণ আনন্দ পেয়েছেন। তবে তাঁদের কাজ এখনও বাকী আছে। ছাপগুলির শুধুমাত্র আংশিক প্রসেস করা হয়েছে এবং গবেষকদের অনেক প্রশ্ন আছে। সেদ্রাতি শুধিয়েছেন - “সেই সময়ের জলবায়ু এবং আবহাওয়া পরিস্থিতি কেমন ছিল? কোথায় ছিল উপকূলরেখা, সমুদ্রতল?” আদি মানবের এই বিরল চিহ্নের অবলুপ্তি আধুনিক মানুষকেই যে কোন মূল্যে রোধ করতে হবে।

(www.theoffnews.com ancient human footprints)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours