মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:
আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শখ ঘুরে বেড়ানো, তার জন্য ভাঙ্গা কোমর নিয়ে যদি রাস্তার পর রাস্তা হাঁটতে হয়, সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভাঙতে হয়, তবু সব সয়ে নিতে পারি। আমার পায়ের ব্যথা এবার একটু বেশীই ছিল, কারণ হট প্যাড চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সকালে দেখলাম দুটো বড় বড় টসটসে ফোসকা, তবে পুরো জায়গাটাই নিঃসাড় থাকায় গরমও টের পাইনি, ব্যথাও নয়। মনে মনে ভাবছি সামনেই বেড়াতে যাব, এসময় ফোসকা পড়ল ভাঙ্গা পায়ে। তবু জানি মনের জেদের কাছে শরীর হারবেই, বেড়াবো তো ঠিকই ।
এবার দীপাবলীতে প্রোগ্রাম ছিল আগ্রার তাজমহল দেখা, তার সাথেই গোয়ালিয়র ফোর্ট, ঝাঁসির ফোর্ট দেখে একরাত কাছেই অর্চায় কাটিয়ে বাড়ি ফেরা। একটি গাড়ি নিয়েই ঘোরার পরিকল্পনা বলে ঠিক করেছিলাম দিল্লি থেকে আগ্রা যাবার পথে মথুরা, বৃন্দাবনে একটু ঢুঁ মেরে নেব।
ধনতেরাসের পরের দিন নরক চৌদশ মানে ভূত চতুর্দশী, সেদিন ভোরেই যাত্রা শুরু, খবরটা জেনে আমার প্রতিবেশীরা বেশ রেগে গিয়ে বলে উঠেছিল, "কি অলক্ষ্মী বউ গো তুমি, বিশেষ পুজো আর্চা তো করতে দেখি না, তাই বলে দীপাবলির দিনও ঘরে আলো না জ্বেলে ডাং ড্যাং করে ঘুরতে চললে?"
কাঁচু মাচু মুখে বলি "কি করি, বাজির আওয়াজ কর্তার সহ্য হয়ে না, তাই প্রতিবার পালায়, তবে আগে কালী পুজোর পরে যেত, এবার আগেই পালাচ্ছে। তোমাদের মত প্রতিবেশী তো কপাল করে পেয়েছি, প্রদীপ দেশলাই সব গুছিয়ে যাচ্ছি, তোমারাই একটু জ্বেলে দিও, গাছেও একটু বুঝে বুঝে জল দিয়ে দিও। ঘুরে এসেই তোমাদের সবার বাড়ি যাব।"
আহমেদাবাদে দীপাবলীতে নতুন বছর শুরু হয়, তাই একে অপরকে গিফট দেওয়া, এর ওর বাড়ী গিয়ে চা নাস্তা খাওয়া চলতেই থাকে প্রায় পাঁচ দিন ধরে। এসময় কাজের মেয়ে, ড্রাইভার সবাই ছুটিতে, দোকান পাট কম খোলা, পুরো ছুটির মুড!
সে যাক ভোর পাঁচটায় দিল্লীর উদ্দেশ্যে কর্তা গিন্নি রওনা দেব ভেবে সবে দরজা খুলে বেড়িয়েছি কি দেখি আমার ঘরের আলো দেখে একটা বোকা পায়রা ভাবল সূর্য্য উঠে গেছে, মানি প্ল্যান্টের ঝোঁপটা বাগান ভেবে ঢুকে এলো। ( কর্তা বহুবার বলেছেন, "এটা বাড়ি, দিন দিন আমাজনের জঙ্গল বানাচ্ছ এরপর বাঘ বেরোলে ও অবাক হবো না!"
একদিকে বেরোবার মুখে পায়রা তাড়ানো চলছে কর্তার আর আমার হিস্টিরিয়া রুগীর মত চিৎকার, কারণ উড়ন্ত কিছু দেখলেই আমার ফোবিয়া চালু হয়ে যায় আনকনট্রোলেড ভাবে। যাক আমার চিৎকারে ঘাবড়ে পায়রা পালাতেই দুগ্গা বলে যাত্রা শুরু করলাম।
প্লেনে উঠেই জানলার পাশের সিটটা বাগিয়ে নিলাম, কর্তা জানালেন "ওটা তোমার নয়, ধারের সিট নিলাম, পাছে তোমার বাথরুম যেতে হয় বলে।" মনে মনে ভাবলাম ২৬ বছরেও বউকে চিনল না, গম্ভীর ভাবে বললাম, "এখন তো বসি কেউ এলে সরে যাবো।"
কি কপাল যে অল্প বয়সী ছেলেটার সিট ছিল, সে আমায় দেখেই হেসে বলল, "বসুন, বসুন আমি এদিকে বউ বাচ্ছা নিয়ে বসছি!"
কর্তার দিকে তাকিয়ে বললাম, "আগে স্বপ্ন দেখতে হয়, তবেই না সেটা সত্যি হয়!"
শুনে নাক দিয়ে "ফত" করে আওয়াজ করে বললেন, "আহা, স্বপ্নের কি ছিড়ি, পরের সিট বাগাবো!" তারপরেই মোবাইল ঘাঁটতে শুরু করলেন। ব্রেকফাস্ট বেশ ভালো ছিল, এখনও এয়ার লাইন্সটি টাটা ভিস্টেরার ----এয়ার ইন্ডিয়ার সাথে মিশে গেলে হয়ত সঙ্গ দোষে শত গুণ নাশ হবে!
দিল্লী এয়ারপোর্ট বিশাল বড় সবাই জানে, গাড়ি বলা থাকায় সে ঠিক সময়ে চলে এলো। অল্প বয়সী ছেলে নাম পবন কুমার। বেশ নয়ডা হয়ে যমুনা এক্সপ্রেস ধরে এগিয়ে চললাম মথুরার দিকে। পথেই একটা জমজমাট ধাবায় পবন
খাবার জন্য গাড়ি থামাতে দেখি ভিড় কাকে বলে, সবাই বেরিয়ে পড়েছে বোধহয়!
কিন্তু দেখার মত সার্ভিস, ঠিক মুভির মতো আমার সামনে বলে গেল, "গোবি পারাঠা, আলু পরোটা, মুলি পারাঠা, পনির পরাঠা, আলু পিয়াঁজ পারাঠা ছোলে বাটুরে...।"
তাকে থামিয়ে এক প্লেট ছোলে বাটুরে আর একটা আলু পিয়াঁজ পারাঠা নিলাম। কয়েকজন প্লেট দিচ্ছে, আর কয়েকজন টেবিল থেকে এঁটো প্লেট সরাচ্ছে মেশিনের মত। প্লেট দিতেই কর্তার ওষুধ ব্যাগ থেকে বের করে প্লেটের একপাশে রাখতেই নিমেষে একজন প্লেটটা নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল, হাঁ হাঁ করতে করতেই বুঝলাম ছেলেটি বোবা কালা, তার পাশের বন্ধু ক্ষমা চেয়ে অন্য প্লেট দিয়ে গেল, বুঝলাম এরা কাজ করতে করতে আর বিশাল ভিড় সামলাতে সামলাতে পুরো রোবট হয়ে গেছে। যাক ভোজন পর্ব সেরে পবন আমাদের মথুরা নিয়ে এলো, বেশ পরিষ্কার ছিমছাম শহর কিন্তু ঢোকার মুখেই একজন বলল, "আজ তো জন্মভুমি বন্ধ, গাড়িও যেতে দিচ্ছে না।" পবন আগ্রার ছেলে, পাত্তাও দিল না গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, "জীবনে কৃষ্ণের জন্ম স্থান বন্ধ থাকে না।" প্রচুর গেট উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম সব দিকে, কিন্তু উঁচু নিচু জায়গা, আর রাস্তা সরু হওয়ায় কোনও রাস্তায় গাড়ি যায় কোনওটায় অটো।
যাক আমরা উত্তরের গেট দিয়ে ঢুকে শুনলাম বেলা চারটের সময় মন্দির খুলবে, ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটে, একটু এদিক ওদিক ঘুরে দেখলাম, আসল কংসের কারাগারের ওপর মসজিদ বানানো হয়ে গেছে, তাই নিয়ে টানাপোড়েন চলছে, অযোধ্যার বাবরি মসজিদের মতই, খানিক পাশেই জন্মস্থান কারাগারের মত করে বানিয়ে রাখা হয়েছে। খানিক পরে মন্দির খুলতেই অপেক্ষামান প্রচুর মানুষ ঢুকে বসলেন মন্দিরের ভিতরের সুন্দর পাথরের মেঝেতে, আস্তে আস্তে খোলা হল রাধা কৃষ্ণের সোনার রঙের যুগল মূর্তি খানি, ভারী সুন্দর দেখতে। এরপর খানিক প্যাঁড়া কিনে চললাম বৃন্দনের দিকে।
আগেই কর্তা গিন্নির কথা হয়েছে পুণ্য করবেন গিন্নী আর জুতো সামলাবেন কর্তা, ভিড়, বাজি এসব থেকে পালাতে তিনি এসেছেন তাই এসব জায়গায় তিনি কিছুতেই ঢুকবেন না, তাই বৃন্দাবন বিহারীর আসল মন্দির যাব না ঠিক ছিল, আমিও মেনে নিয়েছিলাম কারণ ২০১৪ সালে বাবা মা, ভাই ভাইয়ের বউ ভাইজিদের সাথে পুত্র সহ আগ্রা বৃন্দাবন ঘোরা ছিল, না হলে বেড়াতে এসে কিছুই ছাড়ার পাত্রী নই আমি।
সে যাক ঠিক হল নিধিবন যাব, সেখানে রাতে নাকি কাউকে থাকতে দেওয়া হয় না, শ্রীকৃষ্ণ আসেন, গোপীদের সাথে চলে লীলা খেলা, সব সাজানো ভোগ আধ খাওয়া অবস্থায় পাওয়া যায়, রাধারাণীর জন্য রাখা শাড়ি এলোমেলো।
নিধিবন যেতে হলে সরু রাস্তায় টোটো চাপতে হল, অতি বাজে রাস্তা, আমি তো ভাবলাম এবার ফোস্কা ফেটে যাবে, সারা শরীরের কল কব্জা খুলে গেল বলে। যাক কুড়ি মিনিট পরে নামলাম নিধিবনের সামনে, প্রায় পুকুরের মত যমুনা, কষ্ট করে ভাবতে হবে এখানেই কালিয়াদহ, সামনে সেই গাছ যেখানে কাপড় চোপড় রাখতেন গোপিনীর দল। এরপর গাইড নিয়ে চললাম নিধিবন দেখতে, অদ্ভুত ধরনের তুলসী গাছে ভরা তবে এতই লালমুখো বানরের উৎপাত যে মানুষ চলেছে তার দিয়ে ঘেরা খাঁচার মধ্যে দিয়ে, ওপরের আসবেস্টাসের চালে ধুপ ধাপ বাঁদরের লাফালাফি।
ওখানেই আছে একটি ছোট মন্দির যেখানে শ্রীরাধার কৃষ্ণসাজে সজ্জিত রূপ হাতে বাঁশি, মাথায় মুকুট। এক জায়গায় বলরামের মন্দির, হলধর এদের বড় আদরের দেবতা, কথার ভাবে বুঝলাম।একটা খোলা উঠোনে যদিও তারও মাথা চারপাশ তারে, আসবেস্টেস দিয়ে ঢাকা সব ভক্তরা মিলে নাচছে। অনেকেই দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করে দিলেন, ফোস্কা পরা পা নিয়ে আমি এগোলাম না। এরপর বেরিয়ে দেখি গাইড নিয়ে চলেছে কোনও গুরুর আশ্রমে, বাঙালিরা নাকি বাবা মায়ের নামে টাকা দেয়, প্রথমে বুঝিনি, জুতো খুলে ঢুকে গেছিলাম, পরে যখন বলছে "বসুন, আশ্রমের পান্ডাদের বক্তব্য শুনতে হবে তখন উঠে পড়েছি।"
মনে হয় ওরা সবাই মিলে আমাকে এমন অভিশাপ দিয়েছে যে বেরিয়ে জুতো পড়তে একটা খালি চেয়ার দেখে জিজ্ঞেস করলাম "জুতো বাঁধব, বসতে পারি?" কিন্তু অতগুলো লোক কেউ কেন বসছে না মাথায় আসেনি, বসে নিচু হতেই, সুন্দর ভাবে চেয়ার ভেঙে জমিতে পড়লাম, লাগলো এই ভাঙ্গা ফোসকা পরা পায়েই, যদিও স্লো মোশানে পড়ছি বলে তেমন কিছুই বুঝলাম না। এবার এরা দান না পাওয়ায় বলে চেয়ারের দাম দিন! কর্তা রেগে আগুন, এতক্ষণ সব দেখছে দুর থেকে, গিন্নির ভক্তির ঠেলায় চুপচাপ এদের কাণ্ড দেখছিল, কিন্তু এবার গাইডকে এক ধমক লাগাতেই সব চুপ। আসতে আসতে টোটোতে উঠে মানে মানে বৃন্দাবন ছাড়লাম, আস্তে করে বলে উঠলাম এবার বুঝেছি কেন কথায় আছে, "পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবো!"
যাক এরপর পবনের গাড়িতে চেপে চললাম আগ্রার হোটেলে, পরদিন ভোরে তাজমহল দেখতে যাওয়া। হোটেলের ঘরেই খাবার খেয়ে টেনে ঘুম দিলাম।
পরের দিন সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে স্নান সেরে বেরিয়ে তাজমহলের সামনে ইরিক্সার পিছনের সিটে চড়তে গিয়ে কিভাবে যেন পায়ের ব্যালেন্স হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম, আর ঠিক সেই ভাঙ্গা পায়ে বেশ খানিকটা জায়গা গেল লোহায় কেটে, রক্ত খুব না বেরোলেও কালশিটে পড়েছে, ছাল উঠে দগ দগ করছে।
কোনও রকমে লেগিংস তুলে জায়গাটা একটু খুলে হওয়া লাগিয়ে সামনের সিটে উঠে বসলাম। গাইড ভদ্রলোক খুবই ভালো মানুষ ছিলেন, ভাবির করুণ দশা দেখে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে দিলেন ঢোকার আগেই ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে। মেয়েদের মানসিকতা বোঝেন দেখে ভারী ভালো লাগল, ব্যথাটাও যেন একটু কমে গেল। ভদ্রলোক কর্তাকে বললেন "একটু ম্যাডামের দিকে যদি তাকান মানে দুজনে দুজনের দিকে তাহলে বেশ রোমান্টিক ফটো ওঠে।"
শোনা মাত্রই কর্তা এমন গম্ভীর মুখে ওনার দিকে তাকালো যে ভদ্রলোক ভাবলেন থাক, ঘাঁটিয়ে লাভ নেই, পয়সা কম দেবে বেশি বললে।
এরপর তাজমহলের খুঁটিনাটি শোনাতে শুরু করলেন, কর্তা হিসেবে ব্যস্ত থাকলেন ঠিক কত খানি সোনা নিয়ে চলে গেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী।
তাজমহলের পিছনের মসজিদে লোকাল লোকেরা আসেন শুক্রবার তাই ওইদিন তাজ মহল বন্ধ আগে ছিল সোমবার বন্ধ।
এক এক খানি মার্বেলের ওপর এত সুন্দর কারুকার্য যারাই গেছেন তারাই জানেন কি অপূর্ব।
দশ বছর আগে জুতো খুলে ঢুকেছিলাম, তেতে থাকা মার্বেলে পা পুড়ে গেছিল, এখন বেশ সুবিধে পাতলা কাপড়ের থলিতে জুতো ঢেকে ঢোকা। আসল কবর নিচের তলায় থাকলেও ওপরের রেপ্লিকা থেকেই বোঝা যায় কারিগরদের ফিজিক্স আর ম্যাথমেটিক্স এর ওপর কি অসম্ভব দক্ষতা।প্রতিটি কারুকার্য একে অপরের মিরর ইমেজ, পুরো ঘরের ঠিক মাঝের পয়েন্টে মুমতাজ মহলের কবর খানি রাখা। ছাদের মার্বেল ঠিক হিরের মতো করে কাটা যাতে আলোর টোটাল রিফ্লেকশন হয়। ভদ্রলোক দুর থেকে কি সুন্দর তাজমহলের এক খানি ছবি তুলে দিলেন।
তাজের নাকি দিনের এক এক সময় এক এক রঙ, ভোরবেলা পিঙ্ক, একটু বেলায় কমলা, দুপুরে লাল, সন্ধ্যে বেলায় হলদেটে আর পূর্ণিমা রাতে দুধ সাদা।পূর্ণিমায় দূর থেকে আধ ঘণ্টার জন্য রাতে দেখতে দেয় টিকিট ভারতীয়দের জন্য পাঁচশো টাকার বিনিময়ে।
এরপর চললাম ফতেহপুর সিক্রি, তারপর আগ্রা ফোর্ট, এক দিনের পক্ষে একটু বেশি তায় আমার মতো এক পায়ে নানান চোট নিয়ে। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com tour Tajmahal Brindavan)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours