মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:
আমার কাজের মেয়েটি আজ ঘর মুছতে মুছতে বলল "আজ ছেলেটাকে নিয়ে মা গাঁয়ে গেছে।" এখান থেকে বেশ খানিক দূরে মেহেসানাতে ওর আদি বাড়ি। ছোট তিন বছরের দুষ্টু ছেলে নিয়ে ওর কাজ করা ভারী মুশকিল হয়, তাই ওর মা সামাল দেন। তাঁর ও তো বয়স হয়েছে,নাকানি চোবানি খেয়ে প্রায়ই অনুযোগ করে বড় দুষ্টু তোর ছেলে। সারাদিনের খাটুনির পরে, বাড়ি ফিরে ছেলের নামে নালিশ শুনে একটি কাজই করে, সেটা হল পিঠে ঘা কতক বসিয়ে দেওয়া। দিদিমা তখন নাতিকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেও মেয়েটি শোনে না।
আজ ছেলেকে নিয়ে দু'দিনের জন্য দিদিমা চলে যাওয়ায় একদিকে নিশ্চিন্তে কাজ করছে কিন্তু বোধহয় ছেলের জন্য মনটা কেমন যেন করছিল।
হঠাৎ বলে বসে, "কি করি বলো তো ভাবী, এত মার খায় তবু কথা শোনে না, স্কুলে পাঠালে কি হবে কে জানে, মারপিট করবে, টিচাররা নালিশ করবে।ভাবলেই মাথা খারাপ লাগছে।"
আস্তে আস্তে বলি, "ওর ভয়টাই তো ভেঙে গেছে মার খেতে খেতে, ওকে এখন শত মারলেও ফল পাবি না। ভালোবেসে, গল্প করে বোঝাতে হবে, ধৈর্য্য হারালে চলবে না। পারলে কিছু কাদা মাটি দিয়ে বানাতে দে, আঁকতে দে, শান্ত থাকবে।"
বলতে বলতেই নিজের ছানার কথা মনে এলো, খুব ডানপিটে না হলেও একেবারে ভীষণ শান্ত শিষ্ট ছেলেও তিনি ছিলেন না। তবে যুক্তি দিয়ে বোঝালে খানিক থমকে যেত, সবচেয়ে জ্বালিয়েছে স্কুলে যাবে না বলে। অবশ্য এ ব্যাপারে তিনি নরানাং মাতুলঃ ক্রম।
তার মাতুল খাতায় বইতে টিফিনের চিড়ে মাখা লাগিয়ে বলত, "দিদি, বাড়ী চল।" একই স্কুলে পড়ি দুই ভাই বোন, তাই শান্ত দিদিকে ডেকে পাঠানো হতো আড়াই বছরের ছোট ভাইকে সামলাতে। অনেক বুঝিয়ে টিফিনে শান্ত করা গেলেও একদিন তো মামা এসেছে দেখতে পেয়ে কেঁদে কেটে স্কুল ছেড়ে চলে গেল, বছরটা নষ্ট হল। দিদান তাকে চক্ দিয়ে মাটিতে আঁকতে বসিয়ে দিত, অসম্ভব ভালো আঁকত ছোট থেকেই।
তাই তার ভাগ্নের বেলায় আমি ছেলেকে স্কুলে ঢুকিয়ে বাইরে পায়চারী করতাম, সেও তেমনি কেঁদে, কেটে পটিতে গিয়ে বসে থেকে ক্লাস করবেই না।
ক্লাস টিচার ভদ্রমহিলা নাস্তানাবুদ হয়ে যেতেন, প্রি স্কুল ছিল সেটা।
তখন তাকে একদিন একটা কালো জীপ দেখিয়ে বললাম, ওরা বেবি ক্যাচার, স্কুলের সামনে ঘোরে, ক্রাইং বেবীদের তুলে নিয়ে চলে যায় আর তাদের সপাং কনভেন্টে ভর্তি করে। একটা ছোট অন্ধকার মাটির পোড়ো স্কুল দেখিয়ে বলেছিলাম ওখানে ওই অন্ধকার কালো বেঞ্চে বসতে হবে, ওরা আদর করে না, বেত দিয়ে সপাং সপাং করে পেটায়। এমন সুন্দর গল্প লিখেছিলাম থুড়ি বলেছিলাম ছেলে একটু জেদ কমিয়ে স্কুলে যেত তবে বেশিক্ষণ থাকবে না।
অসম্ভব স্বাধীনতা প্রিয়, টিচারও বুঝলেন এক জায়গায় বসবে না, তাই কখনও সে মনিটর তো সরস্বতী পুজোর পুরুত সব ভূমিকায় রাখা হতো তাকে তাই তিনি ভারী খুশি। সাথে চলত আমার তার এনার্জি কমানোর জন্য সাঁতারে না হলে মাঠে নিয়ে যাওয়া।
এনার প্রিয় কাজ ছিল খেলনা ভাঙা, সব সময় খেলনা নিয়ে ঠুকে তাকে ভেঙে তার ভিতরটা দেখা চাই। তবে বড় হয়ে সেটা উল্টে গেল, অসম্ভব বিষয় ফিজিক্সটাই ভালো বোঝে। হয়ত আমরা বুঝতাম না কৌতূহলী বাচ্চারা এরকম বিহেভ কেন করে!
সে যাক, সেসময় তাই দামী খেলনা বক্সখাটে ঢুকিয়ে বলতাম "ওসামা বিন লাদেন নিয়ে গেছে, ওদের দেশের বাচ্চাদের খেলনা নেই তো।"
ওমা! ছেলে দোলনা স্কুলের ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে শুনলাম ওদের লাদেন কিভাবে ওর ভালো খেলনা নিয়ে নেয়, ও আর খুঁজে পায় না, ওদের বাচ্চাদের খেলনা নেই কেন, সেসব গল্প করে এসেছে। হাসতে হাসতে প্রিন্সিপাল বললেন।
কি ভাগ্য তাও ওরা সিলেক্ট করেছিলেন কিন্তু শুনেছিলাম খুব কড়া স্কুল, ডিসিপ্লিনড তাই আর ভর্তি করিনি। জানতাম ছেলে যা, দুদিন পরেই স্কুলে পাঠানো মুশকিল হবে। তবে ছেলে মানুষ করতে গিয়ে একটা জিনিস বুঝেছিলাম, মারাটা শেষ অস্ত্র, ভয় ভেঙে গেলে বেপরোয়া হতে বাধ্য। অনেক বেশি কাজ হয় ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইল করলে। মাঝে মাঝে ছেলেকে বলতাম "মাঠের ওপারে আমার আর একটা ছেলে আছে, ভাবছি তার কাছেই চলে যাই।" প্রথম প্রথম শুনেই চোখে জল আসত, কাঁদো কাঁদো হয়ে বেশ কথা শুনত কিন্তু এই মায়েরই ছেলে কিনা!
কয়েক মাস পরেই গম্ভীর হয়ে বলতে শুরু করল, "ওকে ডেকে আনো, আমার বন্ধু চাই, ওর সঙ্গে খেলব।"
বাধ্য হয়ে অন্য রাস্তা ধরতে হল, তখন ছুটির দিনে বন্ধুদের বাড়িতে এনে সারা দিন রেখে দিত। আমিও খুশি ছেলেও খুশি।
এখনও আমাদের মা বেটায় সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি চলে। একটু আগে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি, "শীত পড়েছে কিন্তু জল খাওয়া কম করো না, লিকুইড ডায়েটে রেখো বেশি করে।"
অমনি ছেলে হাসতে হাসতে বলল, "বাবা, তুমি সাক্ষী মা কিন্তু আমায় লিকুইড খেতে বলেছে, ফেস্ট চলছে, চারিদিকে নানান লিকুইডয়ের ফোয়ারা চলছে, তাই মামমামের কথা রাখার চেষ্টা করতে হবে।"
আমার তখন কুন্তীর হাল, চিৎকার করছি জল, ফলের রস, ওআরএস বলতে চেয়েছি।
তাই আপ্ত বাক্যটা এরকম, ছোট বেলাতে কথা দিয়েই ভয় যদিও বা দেখানো যায়, বড় বেলায় বেফাঁস কিছু বলেছ কি মরেছ!
(www.theoffnews.com childhood caring)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours