মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:

ঝাঁসির খুব কাছেই মানে ১৮ কিলোমিটার দূরের শহর ওরচা। গাড়িতে আধ ঘণ্টায় দিব্যি পৌঁছে যাওয়া যায় মধ্যপ্রদেশের এই ছোট্ট জায়গাটিতে। বুন্দেলরাজ রাজা রুদ্রপ্রতাপের তৈরি ওরছা ফোর্ট দেখতে দেশী বিদেশী ট্যুরিস্টদের ভিড় লেগেই আছে। গোয়ালিয়র এয়ারপোর্ট থেকে নেমে ঝাঁসি হয়ে অনায়াসে চলে আসা যায় ওরছায়।

বেতোয়া নদীর ধারের ছোট্ট জায়গাটির নাম কেন ওরছা সেটা ব্যাখ্যা করলেন গাইড ভদ্রলোক, একদম গোড়ায় জায়গাটির না সামনে না পিছনে কোনও নির্দিষ্ট পথ ছিল, তার থেকেই নাম নাকি ওরছা। রুদ্রপ্রতাপ যখন মহারাজ, ভারতবর্ষ তখনও ইব্রাহিম লোধীর অধীনে, এরপর আসেন বাবর মানে মোঘলদের রাজত্বকাল, সেসময় কথিত কোনও সিদ্ধ পুরুষ মহারাজ রুদ্রপ্রতাপকে বলেন, এ জায়গার ভার নাও। জায়গার তখনও কোনও নির্দিষ্ট নাম নেই। মহারাজ জানতে চান কি নাম রাখবেন এমন জায়গার? সিদ্ধ পুরুষ বলেন "ভোরে উঠে তোমার মুখ নিঃসৃত প্রথম শব্দ হবে এ জায়গার নাম।" যথারীতি বেমালুম ভুলে যান মহারাজ, সকালে উঠে বুন্দেলি ভাষায় পোষা কুকুরকে বলেন "ওর ছা " মানে "উঠে পড়", সেই থেকেই নাকি জায়গার নাম "ওরচা।" এখানে নিজের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন রাজা রুদ্রপ্রতাপ, শুরু হয় দুর্গ নির্মাণ।

এবার আসি আমার কথায়। ঝাঁসির থেকে বেশ দেরিতেই বের হলাম কারন আমার ধারণায় ওরচা সবুজে ঘেরা গ্রাম, একটাই পুরোনো ফোর্ট দেখে, চারপাশ ঘুরে, রেস্ট নেব বাকিবেলা। ওমা! রাস্তাতে দেখি পুলিশ গাড়ি ঘুরিয়ে দিচ্ছি, আজ নাকি গোবর্ধন উৎসব, কাতারে কাতারে ট্রাক, বাসে চেপে গাঁয়ের লোক আসছে এখানকার বিখ্যাত রাম রাজার মন্দিরে। সরু রাস্তা, গাড়ি ঢুকতে দিচ্ছে না।

এক জায়গার পর থেকে, সব গাড়ি পার্ক করে লোকে হেঁটে বা অটোতে যাচ্ছে।

অতএব একটা অটোর সাথে কথা হল, সে সাতশো টাকা নেবে ওরচা ঘুরে দেখাবে। প্রথমে রাম মন্দিরে ছেড়ে দিল। তারপর সে, সেই যে গেল আর আসে না!

অতএব মন্দিরে আমি একাই যুদ্ধ করে দর্শন করলাম। কর্তা যথারীতি জুতো সামলে গেলেন।আমার মোজাটা ফুল, পাতা মিষ্টিতে চ্যাটচ্যাটে হয়ে গেল। কোনও রকমে মানুষ, বিশাল বিশাল গরু সরিয়ে অটোয়ালাকে ফোন করে বুঝলাম, সে এমন জায়গায় আছে আসতে পারবে না। তাই হেঁটেই ঢুকলাম ওরচা ফোর্ট দেখতে। নিলাম একজন গাইডকেও।

দুর্গের তিনটি মহল। রাজমহল, শিসমহল আর জাহাঙ্গীরমহল। কালে কালে তৈরি হয়েছে এই দুর্গ, প্রথমে শুরু হয় রাজমহল।

রুদ্রাপ্রতাপের পুত্র ভারতী চাঁদ রাজমহল নির্মাণ শেষ করেন। এই মহলের দুটি ভাগ, তিন দিকে পাঁচ তলা বিল্ডিং আর এক দিকে চার তলা। রাজার বসার জায়গা, পাশেই রয়েছে মন্ত্রীর বসার জায়গা, একটু দুরে এক পাশে আছে শৌচালয়। 

ভারতী চাঁদ বেশিদিন না বাঁচায় তার ভাই মধুকর শাহ সিংহাসনে বসেন। পরবর্তী কালে তিনি এই ফোর্টকে আরও  বিস্তার করেন। বানান রাজমহলের মধ্যেই রানীর মহলও। রানীর জন্য তৈরি হয় স্নানাগার যেখানে গরম আর ঠান্ডা জলের আলাদা জায়গা আবার মেশাবারও ব্যবস্থা আছে। 

মধুকর শাহ ছিলেন কৃষ্ণ ভক্ত তাই তার মহলে সারা দেওয়াল ছাদ জুড়ে অপূর্ব চিত্রকলা, কোথাও গিরি গোবর্ধন রূপ, কোথাও গোপীদের সাথে লীলা, এছাড়াও বিষ্ণুর দশাবতার, সমুদ্র মন্থনের চিত্র নানান জৈবিক রঙে আঁকা, প্রচুর নষ্ট হলেও এখনও যা আছে দেখবার মতো। ছাদ জুড়ে কার্পেটের ডিজাইন। এছাড়া একপাশে ছবি আছে তন্ত্র সাধনার, বোঝা যায় এসবের বেশ ভালই চর্চা ছিল সেযুগে এই অঞ্চল জুড়ে। একটি চিত্রে আছে অদ্ভুত দর্শন এক প্রাণী, গাইড বুন্দেলি ভাষায় যে নামটি বললেন সেটি মনে রাখতে পারিনি। হাতির মত সিং, সিংহের মত চেহারা আবার কানের পাশে দুটি ডানা, যদিও আমার মনে হয়েছে মহারাজের শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীকী ব্যবহার ওই জন্তুর চিত্র, এছাড়া জাতক কাহিনীও আছে একটি কক্ষে। 

মহারাজ মধুকর শাহের বড় রানী গণেশকুমারি ছিলেন অযোধ্যার মেয়ে, রামচন্দ্রের ভক্ত।

কথিত আছে রাজা  মধুকর শাহ বলেন, "পারলে এখানে এনে দেখাও তোমার শ্রীরামচন্দ্রকে।" রানী সরজু নদীর ধারে জঙ্গলে দীর্ঘ তপস্যা করে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করার সময় শ্রীরামচন্দ্র দেখা দেন এবং আসতে রাজী হন ওরচায়। তবে কিছু শর্তও রাখেন। প্রথম শর্ত ওরছার রাজা থাকবেন একজনই, আর তিনি হলেন শ্রীরামচন্দ্র। তাই আজও ওরচাবাসীরা সবাই নিজেদের রামচন্দ্রের প্রজাই ভাবে।

দ্বিতীয় যেখানে রামচন্দ্র একবার থামবেন বা রাণী তাঁকে নামাতে বাধ্য হবেন সেখান থেকে আর নাড়ানো যাবে না। সেই মত রামচন্দ্র যখন আসেন মহারানীর সাথে তখনও মন্দির বানানো বাকি, ভুল করে রান্নাঘরে শ্রীরামচন্দ্রের  মূর্তিটি সেখানে বসাতেই উনি আটকে যান। তাই দুর্গের বাইরে তৈরি হয় রাজ রাম বা রাম রাজার মন্দির। 

মন্দিরটি ছোট কিন্তু একই মন্দিরে রয়েছে এক দিকে শ্রীরামচন্দ্র আর এক পাশে কৃষ্ণ রাধার যুগল মূর্তিও।

দীপবলির পরের দিন হয় এই গোবর্ধন উৎসব। কার্তিক মাসে বুন্দেলখণ্ডের লোকেরা এক বেলা খান, আর গোবর্ধন উৎসবের দিন সবাই এক গোছা ময়ূরের পালক হাতে আসেন।

গাইডকে জিজ্ঞেস করায় তিনি জানালেন "গিরি গোবর্ধন যখন তুলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ তখন ছোট বাচ্ছা ছেলে, তাই তাকে সাহায্য করতে দূর দূর গ্রাম থেকে লোক আসে ওই ময়ূরের পালক হাতে নিয়ে।আমাদের সামনেই তারা ঢাক ঢোল বাজিয়ে নাচতে থাকল, কেউ গড় হয়ে প্রণাম করল। বিশাল ভিড়ে মন্দির চত্বরে পা রাখাই ছিল মুশকিল, একই মন্দিরে রাজা রামচন্দ্র দর্শন চলছে সাথে চলছে আর এক পাশে শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার দর্শন ও পুজো। যদিও রামচন্দ্রের নামেই মন্দিরটি, সেই থেকেই বুঝতে পারলাম মহারানী তার আরাধ্য দেবতাকে এনেই ছেড়েছেন শশুর বাড়ীতে।

মহারানী যে কত খানি রামচন্দ্রের ভক্ত ছিলেন সেটি তার মহলে গেলেই টের পাওয়া যায়--- দেওয়ালে রাম সীতার নানান চিত্র, অর্ধেক কালের নিয়মে নষ্ট হলেও এখনও কিছু আছে।

গাইড নিয়ে রাজমহল ঘুরে দেখে দূর থেকেই দেখলাম শিসমহল, বর্তমানে এমপি ট্যুরিজম এর হোটেল, আকাশ ছোঁয়া ভাড়া এক রাতের।

তার পাশেই আছে জাহাঙ্গীর মহল, এই মহল তৈরি করেন মধুকর শাহের পুত্র বীর সিং দেও। তিনি প্রচুর দুর্গ, প্রাসাদ নির্মাণ করেন, ঝাঁসির দূর্গটিও ওনার বানানো। খুবই প্রতাপশালী রাজা ছিলেন, তার দলবল মিলেই জঙ্গলের মাঝে সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার আবুল ফজলকে খুন করেন। আসলে জাহাঙ্গীরকে সিংহাসনে বসাতেই তিনি এই গুম খুন করেন। এরপর বন্ধু জাহাঙ্গীর এসে উঠবেন ভেবে তার নামে তৈরি করেন এই জাহাঙ্গীর মহল। যদিও মাত্র একটি দিনই এ প্রসাদ জাহাঙ্গীর ব্যবহার করেন তার পর থেকে খালি ধোয়া মোছাই হয় কিন্তু কেউ ব্যবহার করেনি আর কখনও।

জাহাঙ্গির মহলের মাটির তলা ওপর মিলিয়ে ২০৬ খানি ঘর আর অপূর্ব কারুকার্য করা তোরণ, স্তম্ভ আজও মুগ্ধ করে। পিছনের দরজার ওপারে আছে ছোট্ট গণেশ মূর্তি, ঢুকেই বিশাল চাতালের মাঝে জলের জায়গা, জাহাঙ্গীরের কোরান পাঠের আগে উজু করার জন্য এমন ব্যবস্থা রাখা হয়। এরপর দোতালায় রয়েছে সুন্দর শয়ন কক্ষে বাতানুকূল ব্যবস্থা, কুলুঙ্গিতে দ্বীপ জ্বালানোর জায়গা, সুগন্ধী আতর জল রাখার জায়গা।

সবচেয়ে চমকপ্রদ হলো, মহলের প্রবেশ দ্বার খানি, দরজার ওপারে পাখির নকশা, নিচে স্বস্তি চিহ্ন, তার নিচে পদ্মফুল। এর মাঝে রিদ্ধি সিদ্ধিকে নিয়ে আছেন গণেশ ঠাকুরও। এছাড়াও নিজের শক্তির আস্ফালনের উদ্দেশ্যে রাজ মহল, জাহাঙ্গীর মহল --সব জায়গায় দরজার ওপরে আছে এক আশ্চর্য মোটিফ, দেখা যাচ্ছে ময়ূর মুখে চেপে ধরেছে সাপকে। 

আসল বক্তব্য হল "রাজা এমনিতে ময়ূরের মতো সুন্দর কিন্তু শত্রু যদি সাপের মত হয় তবে তাকে দু টুকরো করে চিড়ে রেখে দেবেন মহারাজা বীর সিং দেও। এছাড়া প্রধান সদর দরজার বাইরে তিনটে প্লাটফর্ম করা সবচেয়ে উঁচু যদি হাতির পিঠে, মাঝেরটি উটের পিঠে আর সর্বশেষে ঘোড়ার পিঠ থেকে  সম্রাট জাহাঙ্গীরের ওঠা নামা করার জন্য।

দূরে দেখা যাচ্ছে একটি ছোট খাটো সুন্দর প্রাসাদ, গাইড জানালেন ওটি রাই পারভীন মহল। আকবরের আমলে তিনি ছিলেন বুন্দেলখণ্ডের যুবরাজ ইন্দ্রজিতের প্রেমিকা, পরে হোন রাজার খাস উপপত্নী। তিনি ছিলেন রূপে, গানে কাব্য চর্চায় অনন্যা, তাই আকবর স্বভাবতই এমন গুণীকে নিজের কাছে রাখতেই দিল্লী ডেকে পাঠান। সেখানে ভারী সুমিষ্ট ভাষায় রাই পারভীন একটি কবিতা উপহার দেন সম্রাটকে, তাতে লেখা ছিল,

দিল্লিশ্বরকে কি মানায় কারোর উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করা? 

মন প্রাণ দেহ সব কিছুই তিনি যুবরাজ ইন্দ্রজিৎকেই দান করে বসে আছেন যখন তখন তাকে টেনে এনে লাভ কি হবে!

এবার নিজের ভুল বুঝে সসম্মানে সম্রাট আকবর তাকে পাঠিয়ে দেন ওরচায় ,বানিয়ে দেন তার নামে একখানি মহল। 

এরপর গাইড ভদ্রলোক দেখালেন দূরের রাজা রাম মন্দিরের পাশে থাকা চতুর্ভূজ মন্দির। সে মন্দির বহু প্রাচীন, বিষ্ণু মূর্তি রাখা আছে সেখানে। এই মন্দির ছিল সোনার রঙে রাঙানো, বিষ্ণুর চতুর্বাহু তাই মন্দিরের নামও তাই, এর চুড়ো সব হিন্দু মন্দিরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এখানেই কথা ছিল রামচন্দ্রের মূর্তিও রাখা হবে, কিন্তু ওঠানো না যাওয়ায় ঠিক এর কোলে বানানো হয়েছে রাম রাজার মন্দির। এই মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণই পূজিত হন।

গাইড ভদ্রলোক এক হাজার টাকা চাইলেও একটু দরাদরি করে ছশো টাকাতেই রাজী হোন। কিন্তু এতো যত্ন করে দেখালেন যে মনে হল পয়সা উশুল।

একদিনেই ওরচা বেরিয়ে নেওয়া যায়, সন্ধ্যেটি মনোরম, প্রকৃতির কোলে দিনটি কাটিয়ে রাতে থেকে যেতে পারেন এখানকার কোনু হোটেলে।আমরা ছিলাম হোটেল ওরচা প্যালেস, ভীষণ ভালো ব্যবস্থা, বাঙালি এজিএম অল্পবয়সী মেয়েটি (প্রিয়াঙ্কা মুখার্জি) ভীষণ মিষ্টি ব্যবহার করলেন, সাথে সব রকম সাহায্য। ভোর বেলায় বেরিয়ে পড়ব বলে সাতটার আগেই ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে ডেকে নিয়েছিল ডাইনিং হলে। এই হোটেলেই ভুলভুলাইয়া ৩'এর লোকজন উঠেছিলেন, এছাড়া বিয়ের পার্টি, লোকজন নিয়ে থাকার জন্য ঝাঁসী থেকে অনেকেই বেছে নেন ওরচখর এই হোটেলেটি।

পরের দিন খুব ভোর ভোর উঠে সাতটা নাগাদ যাত্রা করেছিলাম দিল্লীর উদ্দেশ্যে। চার ঘণ্টার ড্রাইভ তবে ঠিক সময়ে পৌঁছে যায় এয়ারপোর্ট, ফিরে এলাম আহমেদাবাদ।

এযাত্রায় আমার গল্পটি ফুরোলো, নাতে গাছটি মুড়ালো।

সবাই ভালো থেকো, কেমন!

(www.theoffnews.com Orcha)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours