দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:
মূল বইয়ের নাম: রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড, লেখক রবার্ট টি কিওসাকি
"A fool and his money are soon parted."
টাকার জন্য সবাই কাজ করে। সবাই এমপ্লয়ি হতে চান, এমপ্লয়্যার নন। কেউ সরকারি অফিসে স্যালারি পান, কেউ পান বেসরকারি অফিসে। স্বাভাবিকভাবেই, তারা হয় সরকারের, না হয় বেসরকারি সংস্থার লাভালাভের সঙ্গে সংপৃক্ত। কিন্তু এই টাকা সবার জন্য কাজ করে না। তারজন্য ফিনান্সিয়াল লিটারেসি বা অর্থ বিষয়ে সাক্ষরতা দরকার। ধরুন, আপনি কিছু সঞ্চয় করার সামর্থ্য পেলেন। কী করবেন? বাড়ি কিনবেন? তারপর বাড়ি সারাই করতে ব্যায় করবেন? না সেই টাকা প্রসপেক্টিভ বন্ড কিনবেন? না, ভালো জায়গা কিনে ফেলে রেখে দেবেন? দেখবেন, এগুলোও আপনার কাজের জায়গা। সেখানে আপনি না গেলেও, অর্থ বা টাকা আপনার জন্য কাজ করে যাবে। অর্থ মাল্টিপ্লাই হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, নো রিস্ক, নো গেইন। আমেরিকান লেখক রবার্ট টি কিওসাকির "রিচ ড্যাড, পুওর ড্যাড" পুস্তক কেন বেস্ট সেলারের তালিকাভুক্ত, বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। লক্ষাধিক পুস্তক হট্ কেকের মতো বিক্রি হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। সচিত্র নকশার মাধ্যমে ইনকাম স্টেটমেন্ট, ব্যালেন্স সিটের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছেন, প্রথাগত এ্যাসেট এবং লায়াবিলিটি বলতে আমরা যা জানি, তার গলদ কোথায়?
তিনি দক্ষতা বা প্রশিক্ষণের কথা বলতে গিয়ে বেশ কিছু মূল্যবান কথা বলেছেন। দুই বালক রবার্ট ও মাইকের মাধ্যমে এক অনবদ্য কাহিনি। রবার্টের বাবা "গরিব পিতা", মাইকের বাবা "ধনী পিতা"। কিন্তু দুইজনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বিপরীত। রবার্টের বাবা চায় সিকিউরড জব। মাইকের বাবা চায় 'ফিনান্সিয়াল লিটারেসি'। সেই জানে ধনী হওয়ার আসল মন্ত্র। 'ফিনান্সিয়াল লিটারেসি' সেই সব মানুষের প্রয়োজন যারা ধনী হতে চান, দারিদ্র্য দূর করতে চান।
পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে, লেখক বলেন, ধনী ব্যক্তির আয় বৃদ্ধি হলে তারা সম্ভাবনাময় সম্পদ ক্রয় করে। আর মধ্যবিত্ত গাড়ি ক্রয় করে। বিলাসবহুল দ্রব্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে এগিয়ে নিম্ন ও উচ্চ মধ্যবিত্ত। তাঁর কথায়- "রিচ পিপল্ বাই লাক্সারিজ লাস্ট, হোয়াইল দ্য পুওর এ্যাণ্ড মিডল ক্লাস টেণ্ড ট্যু বাই লাক্সারিজ ফার্স্ট।"
শিক্ষক, অধ্যাপক, কেরানীর মতো নিশ্চিত মাস মাইনের চাকুরিজীবী হওয়ার জন্য আমাদের পড়াশোনা। তারপর হন্যে হয়ে ঘোরাঘুরি। না হলে, অদক্ষ শ্রমিক। ভাতা আর কষ্টের জীবন। অনাকাঙ্ক্ষিত দারিদ্র্য জীবন সঙ্গী। যদি নিশ্চিত চাকুরি, পেনশন জোটে, ট্যাক্স, ইনসুরেন্স, রোগ বালাই, ইএমআই, ক্রেডিট কার্ড, ছেলেপুলের পড়াশোনা, বিয়ে, দায় দৈব সামলাতে গিয়ে লভ্যাংশ শেষ। এই তো একজন 'পুওর ড্যাডে'র ভাগ্য। নিরন্তর নিশ্চিত জীবনের খোঁজ। হয়েছে একটি বৃহৎ বাড়ি। হাতে দু'পয়সা তো একটা শখের গাড়ি। কিন্তু যাকে এ্যাসেট ভাবলাম, দেখলাম সেটা আসলে লায়াবিলিটি অর্থাৎ দায়। মধ্যবিত্ত বৃহৎ বাড়িকে এ্যাসেট মনে করে, ধনী তাকে লায়াবিলিটি মনে করে। এখানেই পার্থক্য। গাড়িও তাই, ড্রাইভার থেকে ট্যাক্স, ব্যায়ের বহর বৃদ্ধির গোঁড়া। অথচ, স্যালারির একটা অংশ বিলাসিতার পিছনে না ঢেলে, স্টক, মিউচুয়াল বণ্ড বা বেশি হলে রিয়াল এস্টেটে ঢেলে উপার্জিত অর্থকে কাজে লাগাতে পারিনি, এই বোধগম্যতা আসে অনেক দেরিতে। যখন আর কিছু করার থাকে না। তাই অর্থের সঠিক লগ্নি সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান বা বোধ জরুরি। এই বোধের অভাব হলে, তাকে বলে- "ফিনান্সিয়াল ইললিটারেসি"।
সর্বক্ষেত্রে এই দক্ষতার প্রয়োজন। না হলে সেই প্রবাদ ধ্রুব সত্যে পরিণত হয়-- বাঁদরের চুল হলে বাঁদর চুল বাঁধতে জানে না।
সমগ্র বিশ্বে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে অদক্ষ মানুষের মূল্য কমেছে। তাই সরকারি চাকুরিজীবীদের ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকতে হবে। শিক্ষকদেরও স্মার্ট ক্লাস পরিচালনা করতে হবে।
একটি সহজলভ্য দৃশ্যের বর্ণনা করি। হরিয়ানার একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে নার্সারির একটি বাচ্চা ভেণ্ডর কিয়স্কের সামনে এলো। স্কিন টাচ ডিসপ্লে বোর্ডে আঙুল ছুঁইয়ে ট্রে চ্যুজ করে, "কিউ আর কোড" স্ক্যান করে পেমেন্ট করে কিছু খাবার নিয়ে চলে গেল।
এই দৃশ্যটা কষ্ট কল্পনা নয়, বাস্তব ঘটনা। কোথাও কোনও দোকানদার নেই। এমন দৃশ্য অনেক রেলওয়ে স্টেশনে সচরাচর দেখা যায়।
এর থেকে একটা বিষয় পরিস্কার, অদক্ষ শ্রমিক বা আনস্কিল্ড লেবারের শ্রমের জায়গা ক্রমশ ছোট হচ্ছে। কৃষিকাজেও দিনমজুরদের কাজের পরিসর একইভাবে ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে চলেছে।
স্কিল্ড লেবারার বা শ্রমজীবীদের জন্য তৈরী হচ্ছে নিত্য নতুন কাজের পরিসর। রাজনৈতিক সচেতনতা দরকার। তবে, অমূলক রাজনৈতিক কচকচানির জ্ঞানের দরকার নেই। দরকার, দক্ষতামূলক কর্মক্ষেত্রের খবর। সমাজমাধ্যমে শান্তিনিকেতন মেডিক্যাল কলেজ এ্যাণ্ড হসপিটালের বহুল প্রচারিত "পজিটিভ বার্তা" নামে একটি চ্যানেলের 'বিকাশ টক শো'তে, কারিগরি শিক্ষা বিশেষত আইটিআই কোর্সের পর self-employment বা এন্টারপ্রেনারশিপ ডেভেলপমেন্টের সুযোগ-সুবিধা বিষয়ক আলোচনা শুনছিলাম, নয়াগ্রাম সরকারি শিল্প প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের ইনস্ট্রাক্টার দেবব্রত পালের মুখে।
তাতে একটা দিক পরিস্কার, কাজে দক্ষতার প্রশিক্ষণ জরুরি। প্রশিক্ষক দেবব্রত পাল জানান, ফিটার, প্লাম্বারের মতো কতো কাজে সুযোগ রয়েছে। কারিগরি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিয়ে কন্ট্রাক্টরের লাইসেন্স নিয়ে জল কমিশনের বিভিন্ন প্রকল্পে কিভাবে কাজ পাওয়া যায়, সে কথাও তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে। সারা রাজ্যে সরকার পোষিত বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রগুলি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ভিন রাজ্যে চাকরি কিম্বা নিজস্ব মালিকানায় অনেকেই স্বপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন, এমন প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। একটি বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে, দক্ষ বা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মানুষের বিকল্প নেই। বেশি বেকারত্ব কোন সেক্টরে বুঝতে হবে। জেনারেল স্ট্রিমে পড়াশোনা করে নিশ্চিত জীবনের হাতছানি যত কমে তত দেশের মঙ্গল। প্রযুক্তির প্রয়োগে, দেখুন ডাক্তারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও, অর্থাগমের অভাব হয় না। এই জন্যই বলা- মাইণ্ড ইওর ওন বিজনেস। এর অর্থ নিজের চরকায় তেল দেওয়া নয়। বিজনেস মনস্ক হওয়া। প্রফেশনালিজম খারাপ কিছু না। মানুষকে পরিশ্রমী গড়ে তোলে। এই যুগ বৈশ্যের যুগ। একমাত্র বিজনেস সচেতনতা, ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ সুষ্ঠু পরিচালনা, প্রচার মাধ্যম এবং প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যিনি দক্ষ, গোটা বিশ্ব তাঁর হাতের মুঠোয়।
(www.theoffnews.com Rich dad poor dad financial literacy)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours