পি আর প্ল্যাসিড, প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক, জাপান:
জীবনের প্রথম কবে কবিতা লিখেছি সেই দিন তারিখ এখন সঠিক মনে করতে পারছি না। সম্ভবত তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া কালে আমার কবিতা লেখা শুরু। অর্থাৎ প্রথম কবিতা লেখা, তাও আবার একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস উপলক্ষে। আমার লেখা সেই কবিতা শেষ পর্যন্ত কবিতা হিসেবে ধরা হয়নি। তারপরেও বলছি আমার জীবনে সেটাই ছিল প্রথম কবিতা লেখা। তবে সেই সময় লেখা কবিতার অনেক কিছুই এখন আর মনে করতে পারছি না। শুধু এটুকু মনে করতে পারছি যে, একুশে ফেব্রুয়ারি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রভাতফেরী উদযাপন করা উপলক্ষে আমাদের কবিতা বা ছড়া লিখে নিয়ে যাবার কথা বলা হয়। অনুষ্ঠানের দিন মঞ্চে স্বরচিত কবিতা বা ছড়া পাঠ করার সুযোগ থাকবে। তাই বুঝে না বুঝে লেখার সাহস দেখানোই ছিল বড় কথা।
উল্লেখ্য, একুশে ফেব্রুয়ারী (১৯৭২) উপলক্ষে আমাদের গ্রাম রাঙামাটিয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত প্রভাতফেরী উদযাপনের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানেই পাঠ করেছিলাম স্বরচিত কবিতা। (সম্ভবত বড় বোন কিংবা ভাই সেটি সম্পাদনা করে দিয়েছিলেন)। এর আগে কবিতা নিয়ে আমার কোনও ধারণা বা ভাবনা ছিল না।
এরপর তো বাংলা পাঠ্য বইয়ে যে সকল কবিতা ছিল তা মুখস্থ করেছি, তার বাইরে মনে পরছে না ছোট বয়সে আর কোনও কবিতা পড়া বা লেখার কথা।
এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে যখন কলেজে ভর্তি হতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা আসি তখন থেকে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা পড়তে শুরু করি। আর সেই পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত আধুনিক কবিতা পড়তে শুরু করি আমি কলেজ পড়ার সময় থেকে। এটা ঠিক ১৯৮০ সালের কথা। খুব মনে পড়ছে সেই সময় জাতীয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা বা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হতো। বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হলে হকারকে ডেকে বলতাম, ভালো যে কয়টি কাগজ বা ম্যাগাজিন রয়েছে সবকটি বাসায় দিয়ে যেতে। বিশেষ সংখ্যাগুলো বাসায় দিয়ে গেলে আমি সকালে ঘুম থেকে জেগে নাস্তা করার আগেই সেগুলো নিজের রুমে নিয়ে খুঁজে খুঁজে প্রিয় লেখকদের কবিতাগুলো আগে পড়ে শেষ করতাম। আমার কবিতা পড়া শেষ হলে পর, বাসায় অন্যদের পড়ার জন্য পত্রিকাগুলো খাবার টেবিলে নিয়ে রাখতাম। এভাবেই আমার আধুনিক কবিতা পড়া হতো নিত্য।
শুরুর দিকে কবিতা পড়ে যেটা বেশি ভালো লাগতো সেই কবিতার সাথে মিলিয়ে নিজে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। কবিতা লেখার পর কখনও সেটা শব্দ করে আবৃত্তি করে পড়তাম। শব্দ করে পড়ার সময় লেখায় কোথাও ভুল থাকলে ভুলটা নিজের কানে ধরা পড়তো। কয়েকবার পড়ার পর নিজের কাছে যখন শুনতে ভালো শোনাতো তখন সেটা কবিতা হয়েছে মনে করে আলাদা খাতায় সুন্দর করে যত্নের সাথে লিখে রাখতাম। তবে থিম নিতাম পত্রিকায় প্রকাশিত কবিদের কবিতা থেকেই।
১৯৮০ সালের পরের কথা বলছি। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করার পর ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হই। থাকি বড় ভাইয়ের বাসায়। বাসায় তখন প্রায়ই নতুন-পুরাতন (খ্যাতিমান) অনেক কবি সাহিত্যিকের আসা যাওয়া ছিল। বাসায় সুযোগ পেলে তাদের সাথে কবিতা নিয়ে কথা বলতাম। আমার কবিতার মূল বিষয় হতো তখন মেয়ে, মেয়েদের শরীর এমনকি বুঝে না বুঝে সেক্সচ্যুয়াল কথাও ব্যবহার করেছি বলে প্রথম প্রথম লজ্জায় কাউকে সেসব কবিতা দেখাতে পারিনি। দেখালেও তাদের কেউ কেউ আমার লেখা কবিতাকে কোনও কবিতাই হয়নি বলে ছুড়ে ফেলতেন দূরে।
আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় আজকের মতো ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। এলাকায় কয়েক বাসায় টেলিভিশন কেনার কথা জেনে ভাই ভাবীও টেলিভিশন কেনার কথা ভাবেন। একসময় বাসায় সাদা-কালো ২৪" টেলিভিশন কিনে আনার পর থেকেই আশে পাশের বাসার লোকজন বাসায় আসতে শুরু করে বিটিভিতে প্রচারিত বিশেষ সাপ্তাহিক এবং ধারাবাহিক নাটক দেখতে। সেই সময় টিভিতে সম্প্রচার করা নাটকের দর্শক ছিল প্রচুর। জনপ্রিয়তা তো আকাশ ছোয়া। তখন বিটিভি ছাড়া অন্য কোনও টিভি চ্যানেল ছিল না। তাই বিটিভির অনুষ্ঠান দেখার জন্যই আমরা পাগল ছিলাম তখন।
টিভি দেখার নাম করে পাশের বাসার অন্যদের সাথে চম্পা নামের বাচ্চা বয়সের এক মেয়ে আমাদের ঘরে আসতে শুরু করে। টিভি দেখতে এসে প্রায়ই দেখি তাকে আমার রুমে ঢুকে টেবিলের উপর থাকা কোনও খাতার মাঝখানে কোথাও না কোথাও কবিতা আকারে কিছু ছন্দ লিখে রেখে যেত। কখনও আবার চিঠিও পেতাম বই বা খাতার ভিতর। বিষয়টিকে আমি কোনও গুরুত্বই দেইনি প্রথম। আমার থেকে চম্পা বয়সে অনেক ছোট ছিল, তাই সরাসরি একদিন সে তার নিজ মুখে বলতে শুরু করলো তা এসব চিঠির উত্তর দিতে, তখনই মনে হয় ওর চিঠির উত্তর দিতে শুরু করি। যার মাঝখানে আমার কবিতা বা ছন্দের মতো কিছু লেখা হতো।
যেই না একবার উত্তর লিখেছি এরপর থেকে মেয়েটি প্রায় প্রতিদিন আমার ঘরে এসে বই বা খাতার ভিতর চিঠি লিখে রেখে যেত। ওর বয়স আমার থেকে অনেক কম মনে করে পরে একদিন ধমক দিয়ে এসব করতে নিষেধ করলাম। সেদিনের পর আর কখনও চম্পাকে চিঠি লিখেছি বলে আমার মনে পড়ে না। তবে ওকে উদ্দেশ্য করে নিজের খাতার ভিতরই কবিতার আকারে চিঠি লিখতে শুরু করি যা পরবর্তীতে কখনও তাকে দেওয়া তো দূরের কথা দেখার সুযোগও হয়ে ওঠেনি। এসব আলাদা একটি খাতার মধ্যে লিখে, রেখে দিতাম। মেয়েটি আমার অবর্তমানে ঘরে এসে অনুমোদন ছাড়াই সেই খাতা খুলে লেখাগুলো পড়তো। বিষয়টি বুঝতে পেরে পর থেকে খাতাটি আমি কলেজে যাবার সময় অন্য বই-খাতার সাথে নিয়মিত নিয়ে যেতাম। কখনও ঘরে রেখে যেতাম না অন্য কারও হাতে পরতে পারে ভেবে।
আমি এইচএসসি পাশ করে যখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হই তখন নিজের বিভাগের বাইরে অন্য বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের কয়েকজনের সাথে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। ওদের সাথে মিশতে গিয়ে আমার নিজের বেশিরভাগ ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কলেজ বাউন্ডারির বিভিন্ন জায়গাতে আড্ডা দিতাম। একদিন বাংলা বিভাগের সেমিনার কক্ষে বসে সেই বিভাগের কয়েকজনের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় বাংলার শিক্ষক ওবায়দুল আনন্দ আমার সাথে অন্যান্য দিনের মতো বসে আড্ডায় যোগ দিলেন (ওনাকে আমি ভাই সম্ভোধন করতাম)। সেখানে সবাই ছিলেন বয়সে আমার চেয়ে বড়। তাদের সামনে আনন্দ ভাই আমার সেই খাতাটি দেখার আগ্রহ দেখালে প্রথম আমি দেখাতে আপত্তি করি। এর কারণ জানতে চাইলে যখনই বললাম এতে আমার কবিতা লেখা রয়েছে কিছু। তখন অনেকটা জোর করেই খাতাটি তিনি নিয়ে তাতে লেখা কবিতার কিছু পড়লেন।
কবিতাগুলো থেকে কয়েকটি কবিতা পড়ে তার মধ্য থেকে একটি কবিতা দেখিয়ে সেটা কপি করে দিতে বললেন। আমি তার পছন্দেই একটি কবিতা খাতার অন্য পাতায় লিখে কপি করে দেখালে তিনি কবিতার সেই পাতাটি নিজেই টেনে ছিঁড়ে হাসি হাসি মুখ করে পড়লেন। পরে গোঁফের নীচ দিয়ে সাদা দাঁত বের করে খোলা মুখে হেসে উনি কাগজটি ভাঁজ করে তার শার্টের বুক পকেটে ভরে নিয়ে গেলেন। দুই সপ্তাহ পর আবার যখন সেই একই কক্ষে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন একটি বড় পত্রিকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, - নাও, দেখো। এতে তোমার কবিতা ছাপা হয়েছে। শোনার পর কবিতা দেখার আগেই আনন্দে আমার মন নাচতে শুরু করলো।
পত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশের কথা শুনে সেখানে সবাই আমার প্রকাশিত কবিতা দেখার জন্য জোর করছিল। আমি তাদের প্রকাশিত কবিতা দেখার অনুরোধ করা দেখে ও শুনে লজ্জায় লাল হয়ে উঠছিলাম। এ দেখে আনন্দ ভাই নিজেই সেটা খুলে দেখালেন সবাইকে। তাৎক্ষনিক সেখানে উপস্থিত একজন ডিপার্টমেন্টের বয়কে আনন্দ ভাই চা আনিয়ে আমাদের সবাইকে চা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন। চা খেতে খেতে একজন বলেছিল, আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত কবিতার জন্য সেলিব্রেট করছে। যে এই কথা বলছিল সে এখন আমেরিকা প্রবাসী, নাম রওশন। দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল বৈকি। তবে আমরা খুব আন্তরিক ছিলাম একে অপরের, এতে ভুল নেই। রওশন অবশ্য বড় বোনের পরিচিত, তাই সম্পর্কটা বন্ধুর মতো হলে কি হবে ভিতরে বোনের মতোই সম্মান করতাম তাকে।
আনন্দ ভাই আমাকে নিয়ে রসিকতা করতে আবার কিছুটা খিলখিল করে হেসে বলছিলেন - আরে তোমরা শোনো, প্ল্যাসিড প্রেমের কবিতা লিখেছে। ও যে প্রেম করে দেখে তো বোঝাই যায় না। তবে ভালো লিখেছে, তাতে সন্দেহ নেই। বলে, সবার সামনে পত্রিকায় প্রকাশিত আমার কবিতাটি আবৃত্তি করে সবাইকে শোনালেন। আমার নিজের কাছে তখন এমন প্রেমের কবিতা শুনে লজ্জা লাগছিল বেশ। তবে সেদিন আমার কবিতা প্রকাশিত হবার কারণে যেভাবে ওরা আমাকে চা খাইয়ে সেলিব্রেট করেছিল তাতে আমার কাছে খুব ভালোই লাগছিল বলা যায়। সেদিনের সব কথা মনে না রাখলে কি হবে, সেদিনের অনুভূতি আমার স্মৃতির পাতায় এখনও রয়েছে স্পষ্ট ভাবে। এরপর আনন্দ ভাই আমাকে প্রতি সপ্তাহেই কবিতা লিখে দিতে বলে বলতেন, তোমাকে আমি সাংবাদিকতা শেখাবো। পরে যদিও তিনি আমাকে আর সাংবাদিকতা শেখানোর মত কোনও উদ্যোগ নেননি, তবে আমি সাংবাদিক হয়েছি।
তবে এখানে বলে রাখছি, পত্রিকার পাতায় প্রথম প্রকাশিত আমার কবিতাটির নাম ছিল ”চম্পার উদ্দেশ্যে”। প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক আবির্ভাব নামের একটি পত্রিকায়, যা প্রকাশিত হতো পুরাতন ঢাকার ইসলামপুর থেকে। এরপর থেকেই আমি নিয়মিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন এবং বিভিন্ন স্মরণিকায় কবিতা লিখে পাঠাতাম স্বনামে এবং ছদ্মনামে, যা ছাপাও হতো সব।
(www.theoffnews.com Bangladesh poem)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours