পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

ওষুধের দোকানে ওষুধ নেওয়ার পরে বিলটা খতিয়ে দেখছি। হঠাতই কানে এল একটা হাহাকার। “এত কিছুর পরেও সবকটাতেই জিতে গেল তৃণমূল। ছিঃ ছিঃ মানুষ কি কিছুই দেখে না। কি করে ভোট দেয় এদের?” বুঝতেই পারলাম সদ্য প্রকাশিত উপনির্বাচনের ফলের কথা বলেই তিনি এই ক্ষেদ বা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। দোকানে উপস্থিত আরও দুই তিনজন তার কথাতেই সায় দিলেন প্রকাশ্যেই। এত দিনে একটা বিষয় পরিস্কার, এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী মানুষের অভাব নেই। রাস্তা ঘাটে নানান আলোচনা থেকে সোস্যাল মিডিয়ায় অসংখ্য মমতাকে কটাক্ষ করে মিম দেখে তা বোঝা যায়। আরও বোঝা যায় ইউটিউবে মমতা বা তৃণমূল বিরোধিতা করে ভিডিওগুলির চুড়ান্ত জনপ্রিয়তা দেখে। শুধু মমতা বিরোধীতা করেই এখন অসংখ্য ইউটিউবার রীতিমত সেলিব্রিটি হয়ে গিয়েছে। এগুলি শুধু বিজেপির আইটি সেলের কেরামতি বলে মানা যায় না। মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ না হলে তারা এভাবে এই ভিডিওগুলিকে গ্রহণ করতেন না।

এবারেই আসে আসল প্রশ্ন। এত মানুষ মমতা বা তৃণমূল বিরোধী, তা স্বত্বেও একের পর এক নির্বাচনে তৃণমূল নিরঙ্কুশ জয় পাচ্ছে কি করে? মমতাই বোধহয় দেশের একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী যাকে নিয়ে, যার কথাকে নিয়ে উপহাস, না না ঠিক উপহাস নয় বলা ভাল খিল্লি করেন, সবচেয়ে বেশি মানুষ। এত দুর্নীতি, এত অভিযোগ, এত ঘৃণা, তা স্বত্বেও পটাপট নির্বাচন এলেই জিতে যাচ্ছে তৃণমূল, কেন? অনেকেই বলবেন মহিলা ভোট ব্যাঙ্কের উপরে ভিত্তি করে। আমাদের রাজ্যে গত বিধানসভা থেকে সদ্য হওয়া ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র বিধানসভা সবেতেই প্রমাণিত হয়েছে যে মহিলারা তাদের অনুদান পাওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন ভোটে ভরিয়ে দিয়ে। আগামীতে এটাই হয়তো নিয়ম হয়ে যাবে, ভাতা দাও ভোট নাও। তুমি চুরি কর, ডাকাতি কর, লুট কর, কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু আমাদেরও তোলা দিয়ে থুড়ি ভাতা পৌঁছে দিয়ে যা খুশি করতেই পারো। গত কয়েক বছরে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভোট গণনার প্রথম দিকে শাসক দল মূলত পিছিয়ে থাকছে। গত লোকসভাতেও তাই দেখলাম, আমাদের রাজ্যে বিধানসভাতেও তাই দেখেছি। অর্থাৎ প্রথম দিকে মূলত পোস্টাল ব্যালট গোনা হয়। পোস্টাল ব্যালটে ভোট কারা দেন? মূলত সরকারী কর্মী, খুবই অসুস্থ মানুষ, যারা ভোটের কাজে ব্যস্ত থাকেন তারা। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত সরকারী কর্মী। তারা তথাকথিত শিক্ষিত, কিছুটা সচেতন তাই তাদের ভোট প্রতিষ্ঠান বিরোধী হয়েছে। এদের অধিকাংশই কিন্তু ভাতা পান না। কিন্তু তার পরেই আসে অনুদান প্রাপকদের ভোট। সেখানেই উল্টে যায় পাশা। শাসককে কৃতজ্ঞতায় ভরিয়ে দেন মানুষ। এর থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই, যদি না আগামীতে কেউ আরও বেশি করে ঘুষ দেওয়ার থুড়ি অনুদান দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। অর্থাৎ শাসক বা শাসিত, সকলেই এখন ঘুষের ভক্ত।

অনেকেরই আশা ছিল আরজিকর কাণ্ডের পরে এই উপনির্বাচনে তৃণমূল গো হারা হেরে যাবে। এমন স্বতঃস্ফুর্ত গণ আন্দোলন তৃণমূলের ভিত নড়িয়ে দেবে। কিন্তু তারা আবেগে ভেসে এই আশা করেছিলেন, যুক্তিতে নয়। আচ্ছা বলুন তো রোজই পালং শাক ভাত খেয়ে খেয়ে আপনি ক্লান্ত, বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। এমন সময় আপনাকে কেউ আপনাকে নটে শাক নিয়ে এসে বলল দারুণ পরিবর্তন এনে দিলাম। আপনি কি খুশি হবেন। আপনি তো চাইছিলেন, মাছ ভাত বা মাংস ভাত নিদেন পক্ষে পনিরের তরকারি। কিন্তু সেই বিকল্প আপনার কাছে নেই, অতএব পালং শাকই ভাল। বাংলার হাল এমনই, তৃণমূলকে হারাতে চাই ভাল বিকল্প, সেটা কোথায়? আপাতত প্রমাণিত বিজেপিকে বাংলার মানুষ তৃণমূলের ভাল বিকল্প ভাবে না। সিপিএম বা কংগ্রেস তো আলোচনাতেই আসে না। তাহলে? হাতে রইল পেনসিল। অগত্যা নিরঙ্কুশ জয় শোষকের, থুড়ি শাসকের। উপ নির্বাচনে আরও একটা বিষয় কাজ করে। এই উপনির্বাচনে ছটি আসনে তৃণমূল যদি হেরেও যেত তাহলে কিছুই যায় আসত না তাদের। সরকার যেমন চলছে তেমনই চলত। মাঝখান থেকে বিরোধীকে ভোট দিয়ে সেখানকার মানুষ প্রমাণ করে দিতেন তারা তৃণমূলের পাশে নেই। ফলে এই এলাকায় সরাসরি উন্নয়নের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াত তৃণমূল। ছয় বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটাররা এই ভুল করতে চাননি। অকারণ জেনেশুনে কে সরকারের চক্ষুশূল হতে চায় বলুন?

একটা বিষয় আপনি মানুন বা না মানুন অস্বীকার করবার উপায় নেই, সেটা হচ্ছে এই মুহূর্তেও মমতা একজন জনপ্রিয় নেতা বা নেত্রী। কেরালা গিয়ে কিম্বা গুজরাট গিয়ে অথবা উত্তরাখণ্ড গিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করুন পশ্চিমবঙ্গের কোনও নেতা বা নেত্রীর নাম। সে একবাক্যে মমতার নাম ঠিক বলে দেবে। বাকি আর কোনও নেতার নাম শোনার আশাও করবেন না। অন্য রাজ্যে কেন, এ রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামে যান, সেখানেও মমতা ছাড়া আর কোনও দলেরই রাজ্যস্তরের নেতার নাম অনেকেই জানেন না। শুভেন্দুর বিরোধী দলনেতা তার নামও বহু মানুষ শোনেননি। মমতার এই ক্যারিশমাকে কমিয়ে দেওয়ার মত কোনও নেতা আপাতত এই বাংলাতে চোখে পড়ছে না। সেই জন্যই কোনও ঠিকঠাক বিকল্পও নজরে আসছে না। অর্থাৎ খাটের তলা থেকে রাশি রাশি টাকা পাওয়া যাক অথবা রাতে মহিলাদের পিঠে বানাতে ডাক দেওয়াই হোক। জমি জবর দখলই হোক বা তোলাবাজিই হোক। অভিযোগ যাই থাক এই মুহূর্তে পালং শাকের বিকল্প মাছ মাংস তো দূরের কথা নটে শাকও নয়। আপনি আমি খিল্লি করি, মিম দেখি, তৃণমূল বিরোধী ইউটিউবারদের বড়লোক বানাই, ওদিকে মাঠে মাঠে বেড়ে উঠুক সবুজ শাক থুড়ি ঘাসফুল। একেই বলে চুপচাপ ফুলে ছাপ, তবে খুব এক্ষেত্রে বলি চুপ থাকলেই কম চাপ।

(www.theoffnews.com Mamata Banerjee opposition TMC, BJP, CPIM, Cong)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours