সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

অতি সম্প্রতি প্রাচীন কিছু ফুলের গুচ্ছ নমুনা বর্তমান মায়ানমারে আবিষ্কৃত হয়েছে যা নিখুঁতভাবে অ্যাম্বারে সংরক্ষিত ছিল। অ্যাম্বার বা তৈলস্ফটিক হল জীবাশ্মে পরিণত হওয়া গাছের রজন বা তেল। নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে এগুলি রঙ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রশংসিত হয়ে আসছে। যেহেতু এটি একটি নরম ও আঠালো অবস্থায় গাছের রজন হিসেবে উদ্ভূত হয় সেইজন্য অ্যাম্বারের আঠায় (যা বহু বছর পর জীবাশ্ম হয়) মাঝে মাঝেই প্রাণী, কীটপতঙ্গ এবং গাছে বিভিন্ন অংশ আবৃত থাকে। ফুলগুলির বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে ওই গবেষণা থেকে জানা গেছে যে এই ফুলগাছগুলি প্রায় ১০ কোটি বছর ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। 

সাধারণত ফুলের কোমল প্রকৃতির কারণে প্রাচীন ফুলের নমুনা পাওয়া দুষ্কর। পূর্ণতা পাওয়ার পর ফুল ফলে পরিণত হয় এবং তারপর প্রাকৃতিক কারণেই সেটির মৃত্যু হয়। পলকা গঠনের জন্য তারা প্রস্তরীভূত না হয়ে চিরতরে হারিয়ে যায় বা বিনষ্ট হয়। চার্লস ডারউইন সপুষ্পক উদ্ভিদের বিবর্তনকে প্রাকৃতিক ইতিহাসের সবচেয়ে উদ্ভট ঘটনাগুলির মধ্যে একটি বলে মনে করেছিলেন এবং এটিকে “একটি জঘন্য রহস্য” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। কবি একেই বলেছিলেন - “ফুল যে আসে দিনে দিনে, বিনা রেখার পথটি চিনে, এই যে ভুবন দিকে দিকে পুরায় কত সাধ।”

ইংল্যান্ডের ‘ওপেন য়ুনিভার্সিটি’র ‘স্কুল অফ এনভায়রনমেন্ট, আর্থ অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সায়েন্সেস’-এর একজন এমেরিটাস অধ্যাপক এবং এই গবেষণা পত্রের লেখক রবার্ট স্পাইসার বলেছেন - “পাতা সাধারণত ফুলের চেয়ে বেশি সংখ্যায় উৎপন্ন হয় এবং তারা অনেক বেশি শক্তপোক্ত হওয়ায় তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনাও অনেক বেশি। একটি পাতার কার্যকরী জীবন শেষ হয়ে গেলে ‘যে অবস্থায় আছে’ সেভাবেই বাতিল হয়ে যায় কিন্তু একটি ফুল একটি ফলে রূপান্তরিত হয়, যা পরে খাওয়া হয় অথবা বীজ বিচ্ছুরণের প্রক্রিয়া হিসেবে কাছেপিঠে ছড়িয়ে পড়ে”। 

গবেষণায় আরও বলা হয়েছে যে ফুলের বিবর্তন পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় কারণ বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়, স্তন্যপায়ী প্রাণী, উভচর প্রাণী এবং পাখিদের মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে সাহায্য করে এবং ভূভাগে একটা বিশাল পরিবর্তনের সূচনা করে যাতে সমুদ্রের নীচের থেকে স্থলভাগে প্রাণী বৈচিত্র্যের প্রাচুর্য বহুগুণে বেশি চোখে পড়ে।

স্পাইসার আরও বলেছেন - “সপুষ্পক গাছগুলি অপুষ্পক গাছের তুলনায় অনেক দ্রুত বংশবিস্তার করে, ফুলেদের বিশাল বৈচিত্র্য রয়েছে, তাদের আরও জটিল প্রজনন পদ্ধতি আছে, যেমন প্রায়শই পরাগায়নকারীদের সঙ্গে ফুলেদের ঘনিষ্ট ‘সহযোগিতা’ লক্ষ করা যায়। এর ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণীর ‘পারস্পরিক সহবিবর্তন’কে বংশের পর বংশ ধরে চালিত করে ইকোসিস্টেমকে মজবুত করেছে।

গবেষকরা অশ্মীভূত একটি ফুলের নাম দিয়েছেন ‘ইওফিলিকা প্রিস্কাটেলাটা’ এবং অন্যটির ‘ফিলিকা পিলোবারমেনসিস’ যেটি বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকার দেশীয় প্রজাতি। 

১০ কোটি বছরের প্রাচীন ফুল পৃথিবীতে প্রাণের বিবর্তনের প্রাচীন রহস্যের ওপর আলোকপাত করেছে। ডারউইন ১৪ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে ক্রিটেসিয়াস যুগে সপুষ্পক উদ্ভিদের অবর্ণনীয় উত্থানে স্তম্ভিত হয়েছিলেন। বিজ্ঞানীরা এখনও সপুষ্পক উদ্ভিদের  সঠিক উৎস নির্ধারণ করতে পারেননি কিন্তু স্পাইসার বলেছেন যে অ্যাম্বারে সংরক্ষিত এই ফুলগুলি অনেক নতুন তথ্য প্রকাশ করেছে। নমুনাগুলিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ফিনবোসের মতো দাহ্য অঞ্চলের সমৃদ্ধ ফুলগুলির অনুরূপ গুণাবলী রয়েছে। ফিলিকা প্রজাতি এই এলাকার স্থানীয় গাছ আবার অ্যাম্বারে সংরক্ষিত আধপোড়া গাছপালাও পাওয়া গেছে। 

তিনি জানিয়েছেন - “এখানে রেজিনে আদি পর্বের এমন একটি ফুলের সমস্ত অংশ সংরক্ষিত হয়েছে যে সময়ে ফুলের গাছগুলো বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল এবং ঋতু অনুসারে শুকনো পরিবেশের অনুকূলে দুরন্ত অভিযোজন দেখায় যে পরিবেশে গাছগুলি ঘন ঘন দাবানলের সংস্পর্শে আসত”। স্পাইসার বুঝিয়ে বলেছেন - “যদি এই ধরণের আধ-শুকনো এলাকাগুলোতে প্রচুর সংখ্যায় প্রাচীন ফুল দাবানলের কবলে পড়ে তাহলেই এটা ব্যাখ্যা করা যায় যে কেন অ্যাঞ্জিওস্পার্ম বিবর্তনের প্রারম্ভিক পর্যায়গুলি জীবাশ্ম-রেকর্ডে এত কম পরিমাণে পাওয়া যায় - কারণ এই ধরণের আধ-শুকনো পরিবেশে সাধারণত ফসিল তৈরি হয় না।”

(www.theoffnews.com Amber Fossil flower Myanmar)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours