সুস্মিতা পাল, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কলকাতা: 

আলোর ওমে, নিকষ ছায়ায়

আলতো আঙুল-ছোঁয়া মায়ায়,

জড়িয়ে রেখেও অনেক দূরে

অপেক্ষাতে ইমন সুরে,

চিনি তবু অচেনা কেউ,

ডাক পাঠালে আকুল সে ঢেউ,

দর্পণেতে দেখছি কাকে?

আঁধার এসে আলোয় ঢাকে।

আইনক্সের পর্দায় তখন ভালোবাসারা টুপটাপ ঝরে পড়ছে  - 

তুই আমার হয়ে যা

খুব নিজের হয়ে যা

আমি আসব ফিরে আবার নিজেতে।

গ্রামের সোঁদা মাটি আর শহুরে বাতাসের ঘ্রাণ মিলেমিশে মায়াবী মূর্চ্ছনা ছড়িয়ে দিচ্ছে দর্শকের বুকে। 'বহুরূপী'তে ঋতাভরী অনেক কিছু মনে করিয়ে দিলো। অভিনয় ভালো কি মন্দ - সেই বিচার করতে বসিনি আমি। বলছি বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কথা। 

আপাতত কিছু মানুষের মুখ ছলকে উঠল মনের ভিতরঘরে। দিব্যি চাকরি বাকরি করেন, সুভদ্র মানুষ। কখন যে মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ওলটপালট হয়ে ঝাপটা দিতে থাকে। বৌ, মেয়ে টিঁকতে পারে না, অসহ্য হওয়ায় কতবার চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে। আবার হাতে পায়ে ধরে ফিরিয়ে এনেছেন। যখনই কোথাও বেড়াতে গেছেন, কারও না কারও সঙ্গে প্রবল ঝুটঝামেলা বাঁধিয়ে ফিরেছেন। তারপর বিষাদে ডুবে থাকা অন্ধকার কয়েকটা দিন। ওষুধ চলে, কিছুটা সামলে থাকেন। এভাবেই তো কেটে গেল প্রায় সারাটা জীবন। ভয় বুকে নিয়ে বাঁচতে বাঁচতে স্ত্রী কেমন গুটিয়ে গেছে। মেয়ে বাবা মার অশান্ত দাম্পত্য দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছে, বিয়ের প্রতি অনীহা জন্মেছে।

বড়ো ভয় লাগে। বিষাদে ডুবে যাওয়ার কারণ তো কমবেশী আমাদের সবার ভাঁড়ারেই মজুত। যদি, কখনও নিজেকে ডুবতে দিই সেই অতলে! এমনটাই হয়ে যাব না তো! জানি, এ কোনও বিলাসিতা নয়। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতার অভাবের জন্যই বেশিরভাগ মানুষ একে আর পাঁচটা অসুখের মতো দেখে না। মাত্রা ছাড়ালে পাগলামি বলে দেগে দেওয়াটা খুব সহজ। 

তখন মনে হয় সেভেনে পড়ি। পাড়ায় এক কাকুর বিয়ে হলো। গোলগাল মিষ্টি মুখের টুকটুকে ফর্সা বৌ। কাকিমাকে কোনদিন জোরে কথা বলতেও শুনিনি। ফুটফুটে একটা মেয়েও হলো দুবছরের মাথায়। আরও কিছু বছর পরে সমস্যার শুরু। মানে বাইরের লোকেদের বুঝতে পারার মতো সমস্যা। ঠিক 'বহুরূপী'র চরিত্রটি যেন। সারাক্ষণ কাকুকে কাছে দেখতে চায়। না পেলে অধৈর্য্য হয়ে চিৎকার। সন্দেহ,  বিষোদগার। আপাতদৃষ্টিতে, সে সবের কোনও ভিত্তি নেই। অনেক ট্রিটমেন্ট হয়েছে। দিনেদিনে অস্বাভাবিক স্থূল চেহারা নিয়ে হাঁটাচলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। কাকু অবসর নেওয়ার পরে স্নান, খাওয়া পর্যন্ত কাকুকে ছাড়া করতে চাইত না। শেষমেশ ঘরে বন্দী করে রাখতে হত। কিছুদিন আগে বাধ্য হয়ে মানসিক হাসপাতালে পাঠাতে হয়। আর ফেরেনি। শেষ কটা দিন শুধু বাড়ি ফেরার জন্য দাপাদাপি করেছিল। 

সব মনে পড়ে গেল সিনেমা দেখতে দেখতে। কি এক অজানা কারণে বুকভরা তেষ্টা নিয়ে কোনও কোনও নৌকা ডুবে যায়। অগাধ গভীর লোনা জলে। আর ডুবতে চাই না বলে আমি প্রাণপণে বিষাদকে দূরে ঠেলে সরাই। এই আমি আর ওই আমির মাঝখানে এক সূক্ষ্ম দেওয়াল। তার এপারে আমি অন্ধকার ফুঁড়ে এগোই। সারি সারি প্রদীপ জ্বালি। পথ চিনে 'আমার নিজেতে' ফিরে আসি। আলোর রোশনাইতে দেওয়ালের এদিকে দীপাবলির রাত ঝলমল করে। দেওয়ালের অন্যদিকের মানুষগুলো পথ ভুলে ফিরতে পারে না। সেদিকে ঘন আঁধার, প্রদীপ জ্বালাতে চাইলেও দমকা হাওয়ায় বারবার নিভে যায়। তাই হয়তো অমাবস্যা আর দীপাবলি একই রাতে আসে।

(www.theoffnews.com bipolar disorder)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours