সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:             

ফরাসিরা বলেন - “আতেন লু ক্যুরর পা এস্তোমা” বা হৃদয়ে পৌঁছবার সহজতম রাস্তা উদর দিয়ে। সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার এখনও অজানা, ফলে সিন্ধু সভ্যতা একটা প্রহেলিকা। হরপ্পার আদি বাসিন্দাদের অনেক তথ্যই আমাদের অজানা। কিন্তু তাদের খাদ্যাভ্যাস জানার জন্য বিজ্ঞানীরা হরপ্পার প্রাগৈতিহাসিক মাটির বাসনকোসনে লেগে থাকা এঁটোকাঁটার দিকে সম্প্রতি নজর দিয়েছেন। 

 অসংখ্য ভেষজ এবং মশলার মিশ্রণে দক্ষিণ এশিয়ায় যে বৈশিষ্ট্যমূলক রান্না বহুযুগ ধরে প্রচলিত তা বিচিত্র স্বাদ ও গন্ধের জন্য জগৎবিখ্যাত। আমাদের রান্নার প্রক্রিয়া, সেটা যে প্রদেশেরই হোক না কেন, বেশ জটিল। ভেষজ এবং মশলায় সমৃদ্ধ আমাদের প্রত্যেকের রান্নাঘরই তার প্রমাণ।

স্পেনের ‘স্প্যানিশ ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল’ ও ‘ইনস্টিটিউশন মিলা ওয়াই ফন্টানেলে’র (IMF-CSIC) অন্যতম প্রত্ন-উদ্ভিদবিদ ডক্টর জুয়ানজো গার্সিয়া-গ্র্যানেরো বলেছেন - “আমরা কী খাবার খাই এবং কীভাবে রান্না করি তা আমাদের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে নিরূপণ করে”। 

গবেষণার কাজে গার্সিয়া-গ্রানেরো এই ধরণের গুপ্ত ঐতিহ্যের সন্ধানে বিশ্বের কয়েকটি প্রাচীনতম সভ্যতার প্রাচীন রান্নাশালে উঁকি দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন - “প্রাগৈতিহাসিক খাদ্যপথগুলি (খাদ্যপথ হল মানুষ, অঞ্চল বা ঐতিহাসিক সময়ের খাদ্যাভ্যাস এবং রন্ধনপ্রণালী) অন্বেষণ করলে আমরা প্রাচীন সভ্যতার রীতি রেওয়াজ বুঝতে পারি এবং সেগুলি এখনও টিকে আছে কিনা ধারণা করতে পারি”। 

অন্বেষণের এই অদম্য আগ্রহই গার্সিয়া-গ্রানেরোকে আধুনিক গুজরাটের তিনটি প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নস্থান, দাত্রানা, লোটেশ্বর এবং শিকারপুরে আকর্ষিত করেছিল যাতে অন্তত চার-পাঁচ হাজার বছরের পুরনো হাড়িকুঁড়ির টুকরোগুলিকে গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারেন। আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি টীমকে সঙ্গে নিয়ে গার্সিয়া-গ্রানেরো প্রাচীন বাসনপত্রে খাবারের অবশেষগুলি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যাতে হরপ্পার লোকেরা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে কী খেত আর কীভাবে রান্না করতো তা সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা হয়। প্রারম্ভিক গবেষণার ফলাফল ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন জার্নাল’-এ প্রকাশিত হয়েছে।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে সিন্ধু উপত্যকার আদি বাসিন্দারা অনেক রকম জটিল প্রক্রিয়ায় খাবার তৈরি করত। গার্সিয়া-গ্রানেরো জানিয়েছেন - “আমরা দেখেছি যে সমস্ত উপাদানগুলি মাটির হাড়িকুঁড়িতে তৈরি এবং/অথবা খাওয়া হয়নি। বিভিন্ন উপাদানগুলি বিভিন্ন রান্নাবান্নার প্রক্রিয়ায় অনেক রকম পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়েছিল - কিছু জিনিসকে ভাজা বা গুঁড়ো করা হতো আবার অন্যগুলো অনেকরকম খাবারের অংশ ছিল”। 

গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে শুয়োর, পাখি বা খরগোশের মতন সর্বভুক প্রাণীর চর্বির সঙ্গে বাজরা, ডাল, গম, বার্লি এবং আদা ওই মাটির পাত্রগুলিতে রান্না করা হয়েছিল। কিন্তু এই পাত্রগুলিতে ডেয়ারি বা মাছের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি - এটা খুব আশ্চর্যজনক আবিষ্কার কারণ মাছ ধরা এবং গবাদি পশুপালন এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চালু ছিল বলে আগে সবার ধারণা ছিল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালবিয়ন কলেজের নৃতাত্ত্বিক-প্রত্নতত্ত্ববিদ ব্র্যাড চেজ, যিনি সিন্ধু সভ্যতা সমেত অনেক প্রাগৈতিহাসিক সমাজ গবেষণা করেছেন কিন্তু এই প্রকল্পে জড়িত ছিলেন না, বলেছেন - “সত্যি বলতে কি এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ কারণ ফলাফলগুলি খানিকটা বিভ্রান্তিকর। একদম মৌলিক স্তরে, এই গবেষণাটি ভারতবর্ষের রন্ধনপ্রণালীর ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে”।

খাদ্যের অবশিষ্টাংশ বিশ্লেষণ

গত কয়েক দশক ধরে প্রত্নতাত্ত্বিকরা গবেষণা করে দেখছেন যে সিন্ধু উপত্যকার আদি বাসিন্দারা কীভাবে গম, যব, বাজরা, চাল, ছোলা, মটর ডাল এবং কুলত্থ কলাইয়ের মত খাদ্যশস্য এবং ডাল ব্যবহার করত। তাঁরা গবাদি পশু, মোষ, ভেড়া, ছাগল, জংলী হরিণ, নীলগাই এবং মিষ্টি জলের এবং সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি প্রাণীজ খাবার নিয়েও চর্চা করেছেন। স্পেনের ‘ইউনিভার্সিটাট পম্পিউ ফ্যাব্রা’-র একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং এই গবেষণা পত্রের একজ সহ-লেখক, অক্ষেতা সূর্যনারায়ণ বলেছেন - “যে বিষয়টি এখনও কম চর্চিত সেটি হল এই উপাদানগুলি কিভাবে খাবারে বা রন্ধনপ্রণালীতে এসে হাজির হয়েছিল”।

গবেষকরা তিনটি প্রত্নস্থান থেকে খননে প্রাপ্ত বিভিন্ন পাত্র, ফুলদানি, কটোরা এবং বয়াম সমেত মোট ২৮টি চীনামাটির পাত্র বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। এরমধ্যে ১১টি ছিল শিকারপুরের ব্রোঞ্জ যুগের অবিসংবাদী হরপ্পার মৃৎপাত্র এবং ১৭টি ছিল দাত্রানা ও লোটেশ্বরের তাম্র যুগের আধা-যাযাবর ও পশুপালকদের বানানো মৃৎপাত্র। 

গবেষকরা মৃৎপাত্রের নমুনাগুলির ছোট ছোট টুকরো নিয়েছিল, তারপর সেগুলো পরিষ্কার করে, মিহি ভাবে গুঁড়ো করে এবং “অবশিষ্ট” হিসেবে পড়ে থাকা লিপিড (চর্বি অণু) নিষ্কাশন করেন। অক্ষেতা বুঝিয়ে বলেছেন - “মৃৎপাত্রগুলি বহুরন্ধ্র, তাই তাদের মধ্যে যে খাবারগুলি ঢেলে রাখা হত সেগুলির খানিকটা পাত্রে শোষিত হত এবং কালক্রমে মাইক্রোবিয়াল ক্ষয় থেকে অনেকাংশে সুরক্ষিত ছিল”।

একবার লিপিড বার করা হয়ে গেলে গবেষকরা ‘মাস স্পেক্ট্রোস্কোপি’ ব্যবহার করে এগুলির মধ্যে উপস্থিত বিভিন্ন ধরণের অণু চিহ্নিত করেন। অক্ষেতা বলেছেন - “এইভাবে আমরা আধুনিক গাছপালা এবং প্রাণীদের সঙ্গে যা পাই তা তুলনা করতে পারি এবং প্রত্নতাত্ত্বিক পাত্রে পণ্যের ধরন সম্পর্কে অনুমান করতে পারি”। 

এরপরে গবেষকরা একটি মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে মৃৎপাত্রের টুকরোগুলিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখেন যাতে শস্য, বীজ, ফল, কন্দ ইত্যাদির মত ভোজ্য উদ্ভিদের অংশে পাওয়া স্টার্চ দানার উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়। সিন্ধু উপত্যকার আদি বাসিন্দাদের খাদ্যাভাসের রীতি নির্ধারণ করতে এই গবেষণাটিতেই সর্বপ্রথম দুটি পদ্ধতি একসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে। 

বিভিন্ন রন্ধনপ্রণালীর ব্যবহার

গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যায় তাম্র এবং ব্রোঞ্জ যুগে প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধানে সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা একইরকমভাবে উদ্ভিজ্জ এবং প্রাণীজ উপাদান প্রক্রিয়াজাত এবং রন্ধন করেছিল। তারা বিভিন্ন শস্য এবং ডালের চাষ করত, সংগ্রহ করত এবং ক্রয় করত, কিছু অন্যান্য জায়গা থেকেও আমদানি করত। যেমন, দাত্রানাতে ৯৯% পাত্রে গম এবং যবের পরিবারের অন্তর্গত স্টার্চ দানার উপস্থিতি দেখা গেছে। 

অবশ্য এই উদ্ভিদগুলি গুজরাতে জন্মাত না, ফলে বোঝাই যায় যে এগুলিকে অন্য জায়গা থেকে আনা হয়েছিল। এই তিনটি প্রত্নস্থানেই, বাজরার ছোট ছোট দানাকে জাঁতাতে পেষাই করা হত আর ডাল শস্যকে সাধারণত রান্না করা হত। একটি আকর্ষণীয় তথ্য হল, গবেষকরা হাঁড়িকুঁড়িতে আদার চিহ্নও খুঁজে পেয়েছেন, যা বোধহয় প্রথমে থেঁতলে নিয়ে তারপর রান্না করা হয়েছে।

হাঁড়িকুঁড়িতে পাওয়া লিপিডের রাসায়নিক বিশ্লেষণে ক্ষয়িত প্রাণীজ চর্বি পাওয়া গেছে - সম্ভবত শুয়োর থেকে - যা এই অঞ্চলে চাষ করার কথা জানাও ছিল না। শুধুমাত্র কয়েকটি পাত্রে গবাদি পশু বা মোষের মত প্রাণীর চর্বি পাওয়া গেছে।

যদিও অন্যান্য গবেষণায় তামা ও ব্রোঞ্জ যুগে রোমন্থনকারী পশুদের ব্যাপকভাবে লালনপালনের প্রমাণ পাওয়া গেছে কিন্তু গবেষকরা মনে করেন যে তাদের মাংস অন্য ধরনের পাত্রে রান্না করা হত যা এখনও বিশ্লেষিত হয়নি। এই একই মন্তব্য দুধ এবং মাছের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য কারণ এগুলি এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত বলে জানা যায় কিন্তু বিশ্লেষণে পাত্রগুলিতে এগুলির কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

গার্সিয়া-গ্র্যানেরো আরও বলেছেন - “এটি এবং একই ধরণের যে গবেষণাগুলি সম্প্রতি সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নস্থলগুলিতে করা হয়েছে সেগুলি থেকে আমরা জানতে পারি যে এই জায়গার বাসিন্দারা কীভাবে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যকে রান্না করতো এবং কোনও খাবারগুলি বেশি পছন্দ করতো। এর থেকে তাদের বিশেষ রন্ধনপ্রণালী বেছে নেওয়ার পছন্দের কারণগুলি আমরা সম্ভাব্যভাবে জানতে পারব”। 

ভারতবর্ষে যখন মানুষের পছন্দের বা ঐতিহ্যবাহী খাবার নিয়ে ক্রমশ বিতর্ক হিংস্রভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে সেখানে এই সাম্প্রতিক গবেষণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে ভারতের প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা বৈচিত্র্যময় খাবার খেতেই অভ্যস্ত ছিল।

চেজ বলেছেন - “সিন্ধু সভ্যতার অনেক বর্তমান পাঠ্যপুস্তকের বিবরণগুলি এই সভ্যতার একজাতীয়তার ওপর যে জোর দেয়, সেটা প্রায়শই আমার বিশ্বাস যে একটি সাংস্কৃতিকভাবে একজাতীয় বর্তমানের আধুনিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তলায় তলায় সমর্থন করার জন্য। (গার্সিয়া-গ্র্যানেরোদের)এই ধারার গবেষণা প্রমাণ করবে যে সিন্ধু সভ্যতা সাংস্কৃতিকভাবে কতটা বৈচিত্র্যময় ছিল”।

(www.theoffnews.com Harappan Indus valley archaeological kitchen utensils food)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours