সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:
সাঁঝের আগমনীতে যেখানে গোধূলি ঘোমটা পরে চুপিচুপি বিদায় নিল সবে, সেই প্রান্তিক নক্সা নিটোল অজানা উঠোনে প্রজ্জ্বলিত চলচঞ্চল প্রদীপ শিখা। মাটি দিয়ে বাঁধানো তুলসী তলায়। আদুল গায়ে পরণের লাল পাড় ওই যে সাদা শাড়িটা, যা একটু আগেও অতি যত্নে তোমার শয়নকক্ষের আলনাতে ঝুলছিল, যৌবনদীপ্ত দুই হাতে তালুবন্দি করা ছোট্ট শঙ্খটা বাজাচ্ছিলে। একমনে। একযোগে। একবার। দুইবার। তিনবার। তোমার মাথার মিশমিশে কালো চুলের খোঁপায় লেপটে ছিল একগোছা তাজা টগরফুল। রঙটা গোলাপি। গোলাপি মানেই তো প্রেমের পোশাকি জানান দেওয়া। পায়ের নম্র পাতায় আলতার কি নিপুণ স্পর্শকাতরতা। আলতা সেতো লাল। আর লালের সংজ্ঞায় রাঙা পরশ তো শরীরী ভাষায় মদিরতা অনিবার্য। রূপালী নুপুর জোরাটাও কি অদ্ভুত রকমের রিমঝিমিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাককে কেমন যেন ম্রিয়মাণ করে তুলেছে। দিয়ার সলতের আগুন আলেয়ায় তোমার সোহাগী ঠোঁট হয়ে উঠেছে ভোরের চুমু কুসুম রৌদ্দুরে চড়ুইয়ের চকমকি চঞ্চু।
মাথার উপর শরতের আকাশ আমায় শুধালো, দেখো দেখো আমার কোলে ডাগর চাঁদ উঠেছে। কত তারা কত নক্ষত্র মিটমিট করছে আমার সর্বাঙ্গের আনাচে কানাচে।
কিন্তু আমি শুনতে পেলাম কই? আমার চোখ যে তখন অর্জূনের পাখি সম দৃষ্টি নিবদ্ধ শুধু তোমার টানা টানা কাজল পরা হরিণী চোখেই।
গ্রামের কিনার ঘেঁষে বয়ে যাওয়া ওই যে অখ্যাত নদীটা। আমায় ডেকে বললো, কিগো একটি বার চেয়ে দেখ আমার তন্বী জলজ শরীরে কত কত উথাল পাথাল লাস্য বাঁক। কি তার উরুময় ছলাৎ ছলাৎ দুরন্ত তরঙ্গ।
কি বলি বলতো তোমায় হে যুবতী স্রোতস্বিনী, আমি যে স্বপ্ন বিভোর হেঁটে যাওয়া ওই রমণীর দেহজ সর্পিল বিভঙ্গ দর্শনে। আমি বিহ্বল। আমি যে এখন উর্বশী তৃষিত বিশ্বামিত্র।
একটু দূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে এক অতিকায় প্রাচীন বটগাছ। সেও আমাকে ডাকছিল। বলছিল, কি দেখতে পাচ্ছো আমার অজস্র বেনুনী ঝুড়ি? কি চমৎকার কুন্তল ধুম্রজটা না? শুনতে পাচ্ছো ঘর ফেরা অগুণতি পাখির সমবেত কলতান? আমার সবুজ চরাচর ডালে। এও যে এক মনমুগ্ধকর অবিশ্রান্ত কাকলির ইমন রাগের কিচিরমিচির, তাই না?
হয়তো ঠিক। তবু আমি যে স্থবির। আমার স্বপ্নালোকের মানসীর বাজানো পবিত্র শঙ্খধ্বনিতে। এ যেন মনে হয় মহা জাগতিক বিশ্বে একমাত্র মহাকালের শব্দ তরঙ্গ, যা দূর থেকে ভেসে আসা একটু আগের ওই কান পাতা সান্ধ্য নিনাদ। কানের আর কি দোষ? এই শঙ্খ যে আমার মনন পূজার একমাত্র মন্ত্র মগ্নতা।
সেই বিকেল থেকে আমার সঙ্গ নিয়েছে বাল্যবন্ধুটি। বাবুন তার নাম। ছোটবেলায় ফুটবল, ক্রিকেট, ডাংগুলি, লুকোচুরি কতই না খেলতাম ওর সঙ্গে। প্রতিদিন। তারপর? আমরা যে যার মতো বড় হয়েছি ঠিকই। কিন্তু বন্ধুত্বের হরিহর আত্মায় এক মুহুর্ত খামতি কিন্তু মোটেও ঘটেনি আমাদের। সে জিজ্ঞেস করলো, কিরে তখন থেকে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেছিস। কি হয়েছে তোর? কি ভাবছিস বলতো? কোনও কথা বলছিস না যে! তুই তো কথার উত্তরটুকু দিবি তো নাকি?
কি আর বলি বাবুন তোকে, আচ্ছা একটা কথা বলবি, রবিঠাকুরের লেখা 'মরণে রে তুঁহু মম শ্যাম সমান' মানেটা আসলে কি? হতবাক হয়ে সে জানালো, শোন আমি অত কঠিন কঠিন তত্ত্বকথা জানি না রে। চল বাড়ি যাওয়া যাক। আমিও সায় দিয়ে বললাম, চল তাহলে। ঠিক তখনই পিছন ফিরে অস্ফুট স্বরে হঠাৎই বলে উঠলাম, হে অভিসারিণী মম মনপ্রিয়া কৃষ্ণকলি, তুঁহু মম রাধে রাধে।
এরপর এগোতে এগোতে এগোতে একটা হিন্দি গান মনে পড়ে গেল--
'লিখে জো খত তুঝে
উও তেরি ইয়াদ মে
হাজারোঁ রঙ কে
নজারে বান গ্যায়ে..'
তবে আমার এই এখনকার আত্ম উপলব্ধিটা বলতে, মম রাধে রাধে স্মরণে মননে স্বপনে সাধনে এই আকস্মিক একাত্ম বিহ্বলতার কারণ কি? প্রশ্নটা করলাম নিজেই নিজেকে। মনে মনে। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে।
নিজের বিবেক উত্তরও দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। বন্ধুটির সঙ্গে যেতে যেতে যেতে।
'হয়তো এটাই ভালোবাসা। এটাই হয়তো বা প্রেম।'
(www.theoffnews.com eternal love)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours