সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
সম্প্রতি তামিলনাড়ুর ভেলোরের থান্ডালাই কৃষ্ণপুরমে (টি কে পুরম) প্রথম বারের জন্য আয়ানার দেবের একটি পাথরের মূর্তি পাওয়া গেছে। কয়েকদিন আগে টি কে পুরমের বাসিন্দারা তাদের এলাকায় একটি রাস্তা তৈরির জন্য একটি ফাঁকা মাঠের আশেপাশে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করার সময় ওই বিরল দর্শন মূর্তিটি দৈবাৎ খুঁজে পান। তাঁরা তৎক্ষণাৎ স্থানীয় হেরিটেজ প্রেমী সি তামিলভানানকে জানান যদিও তাঁদের সন্দেহ ছিল যে মূর্তিটি তাঁদের গ্রামের নিজস্ব না, এখানে কেউ ফেলে গিয়েছিল। ইতিহাস প্রেমী সি তামিলভানানের মতে “ভেলোরে এই ধরণের মূর্তি এই প্রথম পাওয়া গেল। রাস্তা তৈরির জন্য একটা মাঠ পরিষ্কার করার সময় জেসিবি অপারেটর এটাতে ঠোক্কর খেয়েছিল আর সে যেহেতু আমাকে ফেসবুকে ফলো করে তাই সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবরটা জানায়। আমি সেখানে একটা হিরো স্টোন দেখতে পাবার আশায় গিয়েছিলাম কিন্তু দেখলাম সেটি আয়ানারের একটি মূর্তি, দেহাতি অঞ্চলে গ্রামের ঢোকার মুখে এই মূর্তি গ্রামের রক্ষাকর্তা হিসেবে রাখা থাকে”। তামিলভানানের মূর্তিটি পরীক্ষা করে মনে হয়েছে যে “মূর্তিটি খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর পল্লব যুগের শেষের দিকের। আইয়ানার মূর্তি এবং মন্দিরগুলি গ্রামীণ তামিলনাড়ুর গ্রামের বাইরে পাওয়া যায়। আইয়ানার হয়তো একজন প্রাক্তন যোদ্ধা বা সেনাপতি থেকে উদ্ভূত হয়েছিলেন এবং সময়ের সাথে সাথে একজন অভিভাবক দেবতায় বিকশিত হয়েছিলেন এবং কেউ কেউ তাকে তাদের পারিবারিক দেবতা হিসাবেও পূজা করেছিলেন। কিন্তু তামিলনাড়ুর রাজস্ব কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে এটার বয়েস আর উৎপত্তি জানার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক এবং স্থানীয় জাদুঘর বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করানো হবে। মূর্তিটিতে আয়ানারকে ‘আগমে’ বর্ণিত 'মহারাজা লীলাসন' নামে একটি বিশেষ ভঙ্গিতে একটি পাথরের সিংহাসনে বসানো রয়েছে এবং তাঁর হাতে ‘সেন্দু’ (বাঁকা লাঠি) রয়েছে। মূর্তিটির নিচের অংশে একটি কুকুর এবং একটি শুয়োর দেখা যাচ্ছে। মূর্তিটি পরিষ্কার করতে গ্রামবাসীদের দেড় ঘন্টা সময় লেগেছিল। তারপরে এটির আসল রূপ দেখে তারা এর পুজো করতে শুরু করে দেয় এবং সকলে মিলে ঠিক করে যে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মূর্তিটিকে সেখানে স্থাপন করবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন যে ১৮৭৮ সালের ‘ইন্ডিয়ান ট্রেজার ট্রোভ অ্যাক্ট’ অনুযায়ী মাটির ১ ফুট নিচের গভীরতায় যা কিছু পাওয়া যায় তা সরকারি সম্পত্তি এবং এই মূর্তিটি জেলা কোষাগারে কালেক্টরের কাছে জমা হওয়া উচিৎ। সেই কারণে ভেলোরের সরকারি জাদুঘর এই মূর্তিটির বিষয়ে ভেলোরের ‘ট্রেজারি’ এবং চেন্নাইয়ের ‘ডাইরেক্টর অফ ম্যুজিয়ামস’কে একটি রিপোর্ট পাঠাবে।
আমাদের কাছে ‘আয়ানার’ তামিল দেবতার নামটি অপরিচিত, কিন্তু গ্রাম বাংলায় এবং খোদ কলকাতা শহরে ‘পঞ্চানন ঠাকুর’ বা ‘পাঁচু ঠাকুর’ একটি অত্যন্ত পরিচিত লোকদেবতা যাদের চেহারায় এবং কাজকর্মে দারুণ মিল। পঞ্চানন বা পঞ্চানন্দ বা পাঁচু ঠাকুর লোকবিশ্বাসে মহাদেব শিবের এক অর্বাচীন রূপ; অন্যমতে, ইনি শিবের পুত্র। মূলত গ্রামরক্ষক, শিশুরক্ষক রূপে পঞ্চানন পূজিত হন। তবে সন্তানদাতা, শস্যদেবতা হিসাবেও বাঙালি হিন্দু সমাজে তার পূজার প্রচলন আছে। রক্তবর্ণ পঞ্চাননের মুণ্ড-মূর্তি ও ঘট প্রতীক পূজিত হয়। [সূত্র: বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ , দুলাল চৌধুরী, আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা: ৭০০০৯৪, প্রথম প্রকাশ:২০০৪, পৃষ্ঠা: ৪৮৬] পঞ্চাননের গাত্রবর্ণ লাল এবং চোখমুখের ভঙ্গি রুদ্ররূপী, বেশ বড় গোলাকার ও রক্তাভ তিনটি চোখ ক্রোধোদ্দীপ্ত। প্রশস্ত ও কালো টিকালো নাক, দাড়ি নেই, গোঁফ কান অবধি বিস্তৃত। মাথায় পিঙ্গল বর্ণের জটা চূড়া করে বাঁধা এবং তার মধ্যে জটা কিছু বুকে পিঠে ছড়ানো। কানে ধুতুরা ফুল। গায়ের ওপর দিকে কোনও পোশাক থাকে না, নিচের দিকে বাঘ ছাল পরা। তবে গলায় ও হাতে বেশ বড় পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ মালা থাকে। হাতে ত্রিশূল ও ডমরু, পায়ে খড়ম এবং মাথায় বা দেহের উপর সাপ বিদ্যমান। পাশে থাকে পঞ্চরংয়ের বা পাঁচমুখো গাঁজার কলকে। এঁর অনুচর হলেন লৌকিক দেবতা জরাসুর ও ধনুষ্টংকার নামক দুজন অপদেবতা। এঁর সঙ্গে থাকে মামদো ভূত, ঘোড়া, বাঘ প্রভৃতি।
তামিল দেবতা ‘আইয়ানার’ বা ‘আয়ানার’ দক্ষিণ ভারত আর শ্রীলঙ্কার দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর পরম পুজনীয় লৌকিক দেবতা। কোনও কোনও গবেষক মনে করেন যে অতীতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতেও আয়ানারের পুজো হত। তামিলনাড়ুতে তাঁর পুজো মূলত হয় গ্রামের অভিভাবক হিসেবে। আয়ানারের মন্দিরগুলোতে তাঁর এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের খুব রংচঙে মূর্তি দেখা যায় যাদের বাহন হাতি বা ঘোড়া।
(www.theoffnews.com Vellore Ayyanar statue)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours