সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ: 

'বিপ্লব' ও 'সন্ত্রাস'

উপরের দুটি শব্দের মধ্যে ফারাকটা কি?

ফারাক হয়তো এটাই:

সংঘটিত হতেই হবে শাসকের বিরুদ্ধে জঙ্গি আন্দোলন। লুঠপাটের অধিকার। অবাধ রক্তহোলি। ভাঙচুরের যথেচ্ছ লাইসেন্স। অগ্নি সংযোগে উল্লাস। খুনের আত্মশ্লাঘা। সড়কে লাগামহীন অবরোধ। বিকল্প কন্ঠের টুঁটি চেপে ধরা, কাঙ্খিত স্তব্ধ প্রশাসন।

এহেন আন্দোলন বামপন্থীরা পরিচালিত করলে তার সংজ্ঞা 'বিপ্লব'। তাই তো?

এরূপ আন্দোলন দক্ষিণপন্থীরা সংঘটিত করলে তাকে বলে 'সন্ত্রাস'। ঠিক তো?

জীবনের চৌত্রিশটা বছর ধরে দেখেছি বাম জমানা। ভরপুর জেনেছি বামপন্থার মৌতাত। তবে দূরত্ব বজায় রেখে।

ট্রাম পোড়ানোর বিপ্লব পরখ করেছি। টাটার সিঙ্গুরে সন্ত্রাসও উপলব্ধি করেছি। হোলটাইমার কমরেডদের ঘরে ঘরে জনপিছু গৃহিণীর ছাপ্পা ভোট স্টাইলে নিরঙ্কুশ শিক্ষিকার চাকরি হতে দেখেছি। দেখেছি তাঁদের পরিজনদের সরকারি চাকরি পাওয়ার একচেটিয়া আস্ফালন। আসলে এটাইতো বঙ্গীয় বিপ্লবীদের নৈতিক অধিকার বলে কথা। এসব চিরকুট অধিকারের প্রমাণ আবার কি? প্রমাণ নেই তো বাছাধন। আরে এটাইতো সাংগঠনিক বিপ্লবের আসলি ভেল্কি। মানে রাজনৈতিক বেশাতির নির্লজ্জ যাদুটোনা।

তাই বামসূত্র মতে বঙ্গের একদা বিরোধী নেত্রীর তদানীন্তন আন্দোলন তো সন্ত্রাসের তকমা পাবেই পাবে তখন। তা স্বয়ং বসুবাবু থেকে ভট্টাচার্য মহাশয়ের ধারাবাহিক উবাচেই এসব প্রতিষ্ঠিত।

তবে এটাও এক আশ্চর্য রূপান্তরের উল্টোগাঁথা। সেদিনের বিরোধী নেত্রী তথা অধুনা বঙ্গেশ্বরীর কন্ঠেও আজকাল কেন যেন অগ্রজের শেখানো 'তোতা কাহিনী' কবিতার আবৃত্তি লাগাতার শোনা যায়। হয়তো এটা হতেই পারে 'যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ' ব্যাকটেরিয়ায় বন্দ্যোপাধ্যায় ম্যাম প্রবলভাবে সংক্রামিত হয়ে পড়েছেন ইতিমধ্যেই। তবে একটা অনুরোধ, ভুল বললে নিজ গুনে ক্ষমা করে দেবেন কেমন, এই কলমচি অধমকে।

শৈশব কাল থেকে এই ষাটোর্ধ্ব বয়সেও একটা জিনিসের কিন্তু পরিবর্তন দেখলাম না। আজও না। পাড়ায় পাড়ায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে। পয়লা মে দিবস পালন অনুষ্ঠান। কোথার থেকে হাজির হয়ে যায় বিপ্লবী কুলপতিরা সেদিন। দলে দলে। সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে। মাঝখানে একটি বাঁধানো লাল রঙের বেদী। তার কেন্দ্রে আকাশ মুখী একটা লোহার সরু পাইপ। তাতে পতপত করে উড়ছে লাল নিশান। পাইপের ঠিক নিচে একটা টেবিলে কোথাও থাকে মার্কস বা লেনিনের ছবি ফ্রেমে বাঁধানো অবস্থায়। আবার কোথাও ফুলের মালায় শোভিত হয় চে থেকে ফিদেলের প্রতিচ্ছবি। মাইকে গান তো যথা নিয়মে ট্র্যাডিশনালি বাজবেই, 'ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না পল রবসন'। উপস্থিত ওই মহাগুরুগণের বাংলা ক্লোন শাবকেরা তখন সব শেয়ালের এক হুক্কা হুয়ার মতো সমস্বরে বলতে শুরু করে, 'কমরেড তোমায় আমরা ভুলিনি ভুলবো না'। অথচ এমন ক্লোন কমরেডরাই যে এই পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জনপদে সাধারণ মানুষকে তাঁদের মনের গান গাইতে দেয়নি। একদিন বা এক মাস নয়। টানা চৌত্রিশ বছর ধরে কোনও বেসুরো একচিলতে আওয়াজও তুলতে দেয়নি। অন্য গান কাউকে গাইতে দেওয়া হতো না ওই ক্লোন চারা পোনাদের শাসনকালে। শুনে রাখুন সদা শ্রদ্ধেয় রবসন, আপনার গান যাদের মেকি গলায় গাওয়ার স্বঘোষিত একমাত্র পেটেন্ট একদা বিলি হয়েছিল, ওই তারাই অন্য কাউকে অন্য গান গাইতে দেখলে চালাতো বারুদে ঠাসা তাজা কার্তুজ। নির্বিচারে। তা না হলে আজও ২১ শে জুলাই শহীদ দিবস হিসেবে কেন পালিত হয় ধর্মতলার বুকে? বিপ্লবের পরিণতির কি মহিমা বলুন তো!

এ মহিমার না আছে আদি না রয়েছে অন্ত। এ যে অনন্ত। তখন আমি স্কুলের ছাত্র। আজও স্পষ্ট মনে আছে। কত কত নানান এলাকায় একচেটিয়া দেওয়াল লিখন। সেই তথাকথিত বামেদের দৃশ্য দুষণের এক তরফা দৃষ্টান্ত ছাড়া এগুলোকে আর কিইবা বলি। সে যাই হোক। ওই দেওয়াল লিখনের ভাষাগুলো আজও স্পষ্ট মনে আছে। কোনটাতে লেখা থাকতো, 'ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের নায়ক সাম্প্রদায়িক কংগ্রেস নিপাত যাক।'  আরেকটি দেওয়াল লিখনে দেখতাম 'প্রধানমন্ত্রী ডাইনি ইন্দিরা গান্ধীর কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।' বিপ্লবীরা ভাবতেই পারেন, জনগণের স্মৃতি ক্ষণিকের। ভুল ভুল ভুল। ইতিহাসের সবকিছু কিন্তু ঠিক মনে রাখে এই জনগণ। অনন্তকাল যাবৎ। তবে বিপ্লবীরা বারে বারে ভুলে যায় তাঁদের অবস্থানের ছদ্মবেশ ধারণ কথা। যুগ যুগ ধরে। স্বার্থের সার্কাসের উলঙ্গ তাগিদে। আজকে এই বঙ্গভূমিতে একি অপরূপ পরিহাস উদযাপন চলছে নৈতিকতার মাথা মুন্ডু বিসর্জন দিয়ে। দেশভাগের জনক কংগ্রেস এখন তাঁদের ভোটের প্রিয়তমা সম প্রিয় আসনসঙ্গী। কালের ধান্দাবাজি তুলসীপাতার ছোঁয়ায় এখন আর সাম্প্রদায়িক হিসেবে অস্পৃশ্য নয় কংগ্রেস। অন্তত তাদের হাবেভাবে সেটাই প্রকট। ছোট্টু রাহুল নিজেকে পর্যায়ক্রমে বিদেশে খ্রিস্টান, স্বদেশে হিন্দু ঘোষণা করলেও, সম্প্রতি অবশ্য তাদের নিরিখে, কংগ্রেস সম্প্রীতি বহনকারী দল। এমনকি ডাইনি ইন্দিরা হয়ে উঠেছেন তাদের কাছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আদর্শগত আইকন। ভোট যে বড়ই বালাই। নাতো আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কুশীলবদের মুর্শিদাবাদের একদা রবিনহুডের পা এখনও চাটতে হয়! 

তা ফলাফল যা প্রত্যাশিত তাই হলো? গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপ্লবীদের ভিক্ষের ঝুলিতে একটিও পরিষদীয় আসন ছিটকেও পড়লো না। কি হাস্যকর, অনিলায়নের আমলে একটা ডায়লগ খুব চলতো একসময়ে, দরকারে বিরোধীদের আমরা ভোট প্রার্থী ধার দিতে পারি। আর এখন তারাই ভোট ময়দানে অসহায় করুণ করুণার পাত্র। তবু এদের আজও এতো কিছুর পরেও শিক্ষা হলো না। আসলে স্বভাব যায় না মলে। এতো কিছুর পরেও এরা আব্বাসের সঙ্গে বিগ্রেডে হাত মিলিয়েও অন্যকে উচ্চকন্ঠে সাম্প্রদায়িক বলে। কারণটা হলো, এরা যে বিদেশী বিপ্লবীর লেবাররুম থেকে খালাস হওয়া দেশীয় আঁতুরঘরে লালিত ছানাপোনার দল। এরাই তো আবার ভারতের একমাত্র বিপ্লবের স্বঘোষিত কারিগর।

তাইতো নবতম রাজনৈতিক অভিধানে বিপ্লব শব্দের সমার্থক হলো 'ধান্দাবাজি', 'সুবিধাবাদী', 'স্বার্থপর', 'রঙ পাল্টানো গিরগিটি', 'যখন যেমন তখন তেমন', 'নীতিহীন'...

(www.theoffnews.com politics CPM left movments)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours