সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

দুপুরের রক্তে কুকুরের নেশা। দুপুরের বাবারও তাই। দুপুরের মা বলে “বংশাবলীর ধারা”। দুপুর বোঝে ওর জিনে কুকুর-ভক্তের ডিএনএ পোক্ত ভাবে ঢুকে গেছে। আর কিছু করার নেই। “এ নেশা সর্বনাশা, কচ্ছপের কামড়ের থেকেও খারাপ, হিমালয়ের নেশার থেকেও ভয়ঙ্কর” - দুপুরের জ্যাগো [মানে জ্যাঠামণি-গো – দুপুরের আদরের ডাক] বলেন। আরও বলেন “বাবার ছিল, এবার ছেলের হলো, একা রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব দোসর”।

দুপুর কিছুতেই বুঝতে পারে না বড়দের সমস্যাটা কোথায়। মা ভালোবাসে সোয়েটার বুনতে, বাবা কুকুর ছাড়াও ভালোবাসে মুরগির ছানা বড় করতে, কলকাতা থেকে নামকরা শিল্পীদের এনে প্রোগ্রাম করাতে, জ্যাগো ভালোবাসে পাড়ার লোকদের জুটিয়ে ফি বছর শীতকালে দুটো করে নাটক করতে আর গুচ্ছের বই কিনতে, তাদের ঘনো চাকর ভালোবাসে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোতে, শুধু তার বেলাতেই দোষ! কুকুর বলে কি মানুষ নয়! ওর মামার বাড়িতে গল্প শুনেছে যে পুরুলিয়ায় কোন জায়গায় কয়েকটা ছেলে একটা কুকুরকে ঢিল মারছিল, একটা বুড়ি তাদেরকে বলে “মারছিস ক্যানেরে! কুকুর বলে কি ও মানুষ নয়?” আসলে ও বোঝাতে চেয়েছিল কুকুর হলেও তার বোধ আছে, মারলে লাগে। বুড়িটাকে নিয়ে সকলে খুব হাসাহাসি করত, কিন্তু জগদীশ বোসও তো তাই বলেছেন। একটা পড়াশুনো না জানা গ্রামের বুড়ি যেটা হৃদয় দিয়ে বুঝেছে, শিক্ষিত বড়রা সেটা বুঝতে পারে না! 

মুরগির ছানা ভালো, হাঁসের ছানাও ভালো, আরও ভালো খরগোসের ছানা বা সাদা ইঁদুরের ছানা কিন্তু সবচাইতে ভালো দেখতে, ভালোবাসতে জুড়ি নেই কুকুরের ছানার। দুপুরের এমনিতে খুব সুনাম - শান্তশিষ্ট, সভ্যভব্য, লেখাপড়ায় ভাল, কোন বায়নাক্কা নেই, কিন্তু শীতকাল এলেই দুপুরের মন উচাটন। জীবনে যেসব জায়গায় একলা কখনও যাবে ভাবেনি কুকুর বাচ্ছার খবর পেলেই হলো, রেল কলোনীর কালভার্টের ভেতর, যে কোনও পাড়ায় চেনা-অচেনা লোকের বাড়ি, এমন কি একবার বেলেগড়ের পাড়ে সাঁওতাল পল্লীতে চলে গিয়েছিল, কে ওকে বলেছিল, মাঝিদের কুকুর খুব তেজি হয়। মাঝিরা তো তেড়ে এসে প্রায় মারে আরকি! বাবুদের ‘ছিলা’ বলে কোন খাতির করেনি।  কুকুর বাচ্ছার মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাড়িতে হয়তো আনা গেল কিন্তু সেখানে মায়ের চোখকে ফাঁকি দেবে কি করে! বহু কষ্টে হয়ত অনুমতি পাওয়া গেল কিন্তু জ্যাঠামণির চোখে পড়লেই বলবে – আদর তো করবে দু’দিন, তারপর সেই মায়ের ঘাড়েই তো চাপবে! কুকুর বাচ্ছা আনার সব থেকে বড় ঝামেলা সেটাকে রাখার। মুরগির ঘরে তাকে রাখা যাবে না – মুরগিরা ভয় পাবে। ইঁট দিয়ে ঘর করে তাকে সন্ধ্যেবেলায় ঢুকিয়ে রাখা হলো, সকালে উঠেই একছুটে বাগানে গিয়ে দুপুর দেখল ইঁট ফেলে দিয়ে তার সাধের কুকুর বাচ্ছা নর্দমার ফাঁক গলে পগাড় পার। আর মন খারাপ করে কি হবে! ঢাল নেই তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার। কুকুর বাঁধার একটা ছোট চেনও নেই। যেটা আছে, সেটা ভুতু-র ছিল। ভুতু ছিল দাদুর ন্যাওটা কুচকুচে কালো বিশাল বড় এক এলসেশান, এখন যাকে জার্মান শেফার্ড বলা চল হয়েছে। ভুতু নাকি আদতে ছিল দুপুরের মামার বাড়িতে, বাবার পছন্দ হওয়াতে রাঁচি থেকে নিয়ে চলে আসে। সেও এক কীর্তি! বাচ্ছাটা মামাতো ছোড়দার এতো পছন্দের ছিল যে ভুতুর গায়ের একটু লোম কেটে রেখে দেয়, অনেকদিন পরে মামীমাকে দেখায়। যাইহোক, ভুতু সারাদিন দাদুর সঙ্গে লেপটে থাকত, দাদু যখন ঘুমোত খাটের তলায় সেও ঘুমোত, দাদু যখন বিকেলে বাইরে রোয়াকে বসত, ভুতু তার পাশে ফুল অ্যাটেনশানে বসে থাকত। ঝামেলা হতো কারখানার মর্নিং শিফট আর নাইট শিফটের লোকদের নিয়ে। ভুতু রাস্তায় নেমে তাদের রাস্তা আটকে দাঁড়াত। তারা আবার দাদুকে ডাকত, দাদু ভুতুকে হাঁক দিয়ে ডেকে নিলে তারা হাঁফ ছেড়ে কারখানা বা বাড়ির রাস্তা ধরত। দাদু মারা যাওয়ার সাত দিনের মধ্যে ভুতুও পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে সুস্থ শরীরে হটাৎ চলে যায়।

দুপুরের এসব ভেতো নাম পছন্দ ছিল না। তার সব পোষ্যের নাম ছিল রেক্স। অরণ্যদেব কমিকসের অবধারিত প্রভাব আরকি! ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় অদ্ভুত ভাবে দুপুর একেবারে খোদ জ্যাঠামণির কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে গেল। সেবারও একটি কুকুর বাচ্ছা জোগাড় হয়েছে, একটি মাপসই চেনও কেনা হয়েছে, কিন্তু রাত্রিবেলায় বাড়ির ভেতরে রাখার অনুমতি পাওয়া যায়নি। জ্যাঠামণির ঘোর আপত্তি। খাটে উঠবে, গা চাটবে, ওসব সাহেবি আদবকায়দা এ বাড়িতে চলবে না। কে বোঝাবে যে যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহণের সময় শেষ পর্যন্ত একটা কুকুরই তাঁর সঙ্গে ছিল এবং সে কুকুরটা ছিল একটা পাহাড়ি নেড়ি কুকুর! যাইহোক বাচ্ছা রেক্স অকুতোভয়ে একা বাইরে থেকে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। দুপুরের ভয় ও চুরি না হয়ে যায়! ইলেভেনের অনেক পড়া, দুপুর অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করে। কয়েকদিন পর হটাৎ রাত্রি প্রায় বারোটার পর দুপুর শুনল রেক্স ডাকছে, ডাকটা কিন্তু সাধারণ কুকুরের ডাকের মতো নয়, একদম অন্য রকম। দুপুরের মনে হল কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। বাড়ির সবাইকে ডাকল। সবাই মিলে নিচে নেমে এল। বাড়ির দাওয়াটা রাস্তা থেকে অনেকটা উঁচুতে। চারটে সিঁড়ি উঠে লম্বা একটা সিমেন্টের জায়গা তার পরের ধাপে রোয়াক। ওই লম্বা জায়গাটায় একটা কিছুকে ঘিরে রেক্স বৃত্তাকারে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরছে আর মুখে ওই অদ্ভুত আওয়াজের ডাক ডাকছে। কাছে গিয়ে টর্চের আলোয় দেখা গেল তার মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে একটি বড় চন্দ্রবোড়া সাপ যেটিকে ও নিজের জীবন বিপন্ন করেও কিছুতেই রকের ওপরে উঠতে দেয়নি। ব্যাস্‌, ওই এক কীর্তিতেই রেক্স সকলের মন জয় করে নিল। রাত্তিরে বাড়ির ভেতরে ঢোকার পারমিশানও পেয়ে গেল জ্যাঠামণির কাছে। দুপুরের পড়ার ঘরের এক কোণে মা রেক্সের জন্য কাঠের পাটার ওপর গদি দিয়ে বিছানা বানিয়ে দিল, সারা রাত পাহারা দিয়ে সকালে দরজা খুললেই রেক্স তীর বেগে ছুটে গিয়ে ওই বিছানায় টানা ঘুম দিত।

বাগানে একবার দু’জন সাঁওতাল কাজ করছিল। রেক্স রকের ওপরে শুয়ে ছিল। ওর তখন অভ্যাস হয়েছিল মাকে রুটির সঙ্গে রসগোল্লার রস মাখিয়ে দিতে হবে, তবে বাবু খাবেন। খেতে দিতে দিতে মা মুখে নানা রকম আদরের কথা বলছিল, রেক্স বেশ উপভোগ করছিল। দুপুরকে কাছে পেয়ে মাঝি দু’জন শুধলো “তোর মা উয়াকে খুব ভালবাসে, লয়?” দুপুর প্রথমে বুঝতে পারেনি, তারপর দ্রুত মাথা নেড়ে বলল “হ্যাঁ, হ্যাঁ”। দুপুর দেখল ওরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে রেক্সের আদর খাওয়া দেখছে। সাঁওতালরা যে ওর মতই কুকুর ভালোবাসে, ওদের পরিবারের একজন মনে করে।

(www.theoffnews.com dog story)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours