সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

(কানাডার (ক্যুব্যাক) উপকথা অবলম্বনে রচিত ছোটগল্প 'The Boy Who Was Saved by Thoughts')

পূর্ব কানাডার সমুদ্রের কাছে একটি কুঁড়ে ঘরে একটি বাচ্ছা ছেলে নিয়ে এক গরীব বিধবা মা কোনক্রমে দিনাতিপাত করতেন। ছিলেটির নাম ধরা যাক রায়ান। এক দুর্বার ঝড়ের দিনে উপকূল থেকে বহুদূরে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে তাঁর স্বামী ডুবে মারা যান। তখন থেকেই তাঁর ছোট্ট ছেলেটি তাঁর অন্ধের যষ্ঠি। ছেলেটির কোনও ভাইবোন ছিল না – শুধুই সে আর তার মা – তাই তারা দু’জনে সবসময় খুব ভাল বন্ধু ছিল। যদিও সে বয়স আর চেহারায় ছোট্টটি ছিল, কিন্তু তার গায়ের জোর ছিল প্রচন্ড আর পশুপাখি ধরতে পারত একজন বড় মানুষের মতো। প্রতিদিন খাবার সংগ্রহ করে সে তার মা-কে এনে দিত আর এমন একটা দিন আসেনি যে তাদের না খেয়ে থাকতে হয়েছে।

কিন্তু এরপর হটাৎ একদিন হল কী, বিরাট ঈগল যে কিনা তার বিশাল পাখা দুটো দিয়ে ওই অঞ্চলে হাওয়ার সৃষ্টি করত, সে অনেকদিন ধরে যথেষ্ট শিকার না পেয়ে ভীষণ রেগে গেল আর চীৎকার করে বলল, “লোকেরা যদি আমায় খেতে না দেয়, আমিও দেখব তারা কী করে খেতে পায় আর আমার যখন খুব খিদে পাবে তখন আমি এখানকার সব কচি ছেলেপিলেদের খেয়ে শেষ করব। কেন না আমার কচি ছানাগুলোরও খাবার দরকার”। এই কথা বলে সে তার বিশাল ডানা দুটো দিয়ে সমুদ্রের জলকে এমন উথালপাতাল করতে লাগল আর বড় গাছগুলোকে এমন বেঁকিয়ে দিতে লাগল আর ফসল ভর্তি গাছগুলোকে এমন শুইয়ে দিতে লাগল আর কয়েকদিন ধরে পৃথিবীর ওপর এমনসব অলক্ষুণে  কান্ডকারখানা করে লন্ডভন্ড করে দিতে লাগল যে লোকেরা ভয়ে ঘরে সেঁধিয়ে রইল, খাবারের জন্যও তারা বাইরে আসতে ভয় পাচ্ছিল। 

শেষে রায়ান আর তার মায়ের এত খিদে পেল যে সে বলল, “আমাকে খাবার খুঁজে আনতে বেরতেই হবে কারণ ঘরে খাবারের একটু গুঁড়োও পড়ে নেই। খিদে আর সহ্য করা যাচ্ছে না”। সে তার মা-কে বলল, “সমুদ্রের কাছের নদীর পাড়ের ওপর দলদলির মধ্যে একটা মোটাসোটা ছোকরা বীভার কোথায় বাড়ি বানিয়ে থাকে সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে। আমি ওকে মেরে নিয়ে আসব, ওর মাংসে আমাদের অনেকদিন চলে যাবে”। তার মায়ের মোটেই ইচ্ছে ছিল না যে সে এই বিপজ্জনক কাজে যায়, কেন না বিরাট ঈগল তখনও ওখানেই ছিল।

কিন্তু রায়ান মা-কে বলল, “আমি চলে গেলে তুমি সব সময় আমার কথা ভাববে আর আমিও তোমার কথা ভাবব। আর আমরা যতক্ষণ দুজন দুজনকে মনে রাখতে পারব, আমার কোন বিপদ হবে না”। তাই, তার শিকারের বড় ছুরিটা নিয়ে বাচ্ছা বেরিয়ে পড়ল সমুদ্রের ধারে নদীর তীরে দলদলের মধ্যে বীভারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কোনও অঘটন ছাড়াই সে পৌঁছে গেল সেখানে আর দেখল বীভারটা ঘুমে একেবারে কাদা। সে জলদি তাকে মেরে ফেলল আর বীভারের শরীরটাকে কাঁধের ওপর ফেলে বাড়ীর দিকে রওনা দিল। “বেশ তাগড়া একটা চর্বি-মাংসের পুঁটলি পাওয়া গেছে”, সে নিজের মনেই বলল, “আর এই বীভারের সেঁকা মাংস দিয়ে এখন অনেকদিন পেট পুরে খাওয়া যাবে”।

কিন্তু যখন সে মরা বীভারটাকে পিঠের ওপর চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, বিরাট ঈগল দূর থেকে তার ওপর নজর রাখছিল। তারপর আচম্বিতে তার ওপর হামলা করল। রায়ান ছুরি দিয়ে তাকে প্রত্যাঘাত করার আগেই বিরাট ঈগল রায়ানের কাঁধ দুটো বড় বড় নখে খামচে ধরে বীভারের দেহ সমেত তাকে নিয়ে অনেক দূরে আর অনেক উঁচুতে উড়ে গেল। রিয়ান বারংবার চেষ্টা করল তার ছুরিটা ঈগলের বুকে ঢুকিয়ে দিতে কিন্তু সেটার পালকগুলো ছিল ভীষণ মোটা আর পুরু আর তার শরীরেও এত জোর ছিল না যে সেগুলো ভেদ করে ছুরিটা বসাতে পারবে। অসহায় অবস্থার মধ্যে যতটুকু ভালো ভাবা যায় সেটা ছাড়া তার আর কিছু করার ছিল না। রায়ান নিজের মনকে শক্ত করার জন্য বললো, “পালাবার একটা উপায় অবশ্যই মাথায় আসবে আর আমার মায়ের শুভ চিন্তা আমাকে রক্ষা করার জন্য সব সময় আমার সঙ্গে থাকবে”।

শিগ্গির ঈগল তার বাসাতে পৌঁছে গেল। বাসাটা সমুদ্র সৈকত থেকে শত শত ফুট ওপরে সমুদ্রের দিকে মুখ করা উঁচু খাড়াইয়ে বারান্দার মত বেরিয়ে থাকা পাথরের চাতালে তৈরি হয়েছে যেখানে বহুদূর থেকে গড়িয়ে আসা ঢেউয়ের গর্জনও শোনা যায় না। বাসার ভেতরে কিলবিল করছিল ঈগলের বাচ্ছারা, সবাই গলা ফাটিয়ে খাবার চাইছিল। বিরাট ঈগল রায়ানকে বাসার একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একদম নড়াচড়া না করে ওখানেই বসে থাকতে বলল। তারপর সে বলল, “প্রথমে আমরা বীভারটাকে খাব, তারপর ওটা শেষ হয়ে গেলে তোকে খাব পেট ভরে”। এরপর ঈগল বীভারটাকে ধারালো ঠোঁট দিয়ে টুকরো টুকরো করে কয়েকটা টুকরো খাওয়াল তার ছানাপোনাদের।

কয়েকটা দিন রায়ান প্রাণভয়ে নিস্পন্দ অবস্থায় ঈগলের বাসায় শুয়ে রইল, সারাক্ষণ শুধু পালাবার ফন্দি আঁটতে থাকল। তার মাথার ওপর দিয়ে পাখিদের উড়ে যেতে দেখল, দেখল সমুদ্রের অনেক দূর দিয়ে বড় বড় জাহাজকে যেতে – কিন্তু কোনও জায়গা থেকেই তার সাহায্য পাবার কোন আশা ছিল না – সে বুঝতে পারলো মরা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। এদিকে তার মা তার ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে ছিল, দিনের পর দিন পেরিয়ে গেল কিন্তু রায়ান ফিরে এল না। মায়ের মন বলল ছেলেটা নিশ্চয়ই মারাত্মক বিপদে পড়েছে নয়তো মারাই গেছে। একদিন মা বসে বসে কাঁদছে তার হারিয়ে যাওয়া ছেলের জন্য, এমন সময় এক বুড়িমা এসে শুধোল, “কাঁদছো কেন গো?”

কাঁদতে কাঁদতে মা বলল, “আমার ছেলে অনেকদিন হল শিকার করতে গেছে। আমার মন বলছে ওর নিশ্চয় কোনও ক্ষতি হয়েছে। আমার গোষ্ঠীর লোকেরা ওকে খুঁজতে গেছে। যে বা যারা ওকে জোর করে আটকে রেখেছে সেই অশুভ শক্তিকে ওরা নিকেশ করবে কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে আমার ছেলেকে আমি আর জীবিত অবস্থায় দেখতে পাবো না”। একথা শুনে বুড়িমা বলল, “তোমার গোষ্ঠীর লোকেরা তোমার কচুপোড়া উপকার করবে। তোমার শুভ চিন্তা দিয়ে ওকে তোমাকে সাহায্য করতে হবে, কেন না এ জগতের জিনিষ দিয়ে কিছু হবে না। আমি তোমাকে সাহায্য করবো কারণ পাহারের ছোট্ট মানুষরা আমাকে অনেক ক্ষমতার অধিকারী করেছে”। একথা শুনে মা তার সুচিন্তা আর সদিচ্ছা দিয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা শুরু করলো।

সে রাত্তিরে রায়ান ঠাওর করল যে বীভারটাকে চেটেপুটে খাওয়া হয়ে গেছে। জন্তুটার আর এককুচি মাংসও অবশিষ্ট নেই। সে হাড়ে হাড়ে টের পেল যে এখনই কিছু করতে না পারলে কালকেই তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। সে ভাল করেই জানতো বিরাট ঈগল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্তিশালী ঠোঁট আর নখের আঘাতে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেবে। কিন্তু সে যখন ঘুমিয়ে পড়ল, স্বপ্নে তার মা-কে আবার দেখল – মা বলছে, “কাল যখন বিরাট ঈগল তার বাসা থেকে বেরবে তুই তোর ছোরাটাকে ওপর দিকে মুখ করে পাহাড়ের ওপর ঠেস দিয়ে শক্ত করে ধরে থাকবি। ও যখন ফিরে এসে তোকে মারবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে তখন ওর বুকটা ছোরাটায় এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে আর ওটা চিরকালের মত খতম হবে। তোর গায়ে এত জোর নেই যে ওর পালক ভেদ করে ওকে ছুরি দিয়ে মারতে পারবি কিন্তু নিজের গায়ের জোরেই ও নিজের মরণ ডেকে নিয়ে আসবে”। 

পরের দিন সকালে যখন বিরাট ঈগল বাসা থেকে উড়ে বেরলো, রায়ান রাতের স্বপ্নাদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। পাথরের ওপর ঠেস দিয়ে তার শিকারের ছোরাটাকে ওপর মুখো করে নিস্পন্দ অবস্থায় বসে অপেক্ষা করতে লাগল। একসময় সে শুনতে পেল ঈগল ছানাদের তারস্বরে চীৎকার আর সকালের খাবারের জন্য প্রাণপণ কান্না। সে জানতো যে সেই মহাক্ষণ আগত। বাছাদের চিল চিৎকার শুনে বিরাট ঈগল ছেলেটাকে মারবার জন্য বাসায় ফিরে এল। ভীষণ চিৎকার করতে করতে সে রায়ানের মাথার ওপর পাক খেতে লাগল আর তারপর ভীমবেগে তার দিকে ধেয়ে এসে সজোরে ঝাঁপ দিল তার ঠোঁট আর নখ দিয়ে মেরে ফেলার আশায়। কিন্তু হা- হতোস্মি! সে পড়ল গিয়ে পাথরের ওপর উঁচিয়ে রাখা ছোরাটার ওপর। ছুরিটা তার বুকটাকে প্রায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল আর একটা গগনবিদারী বিকট মরণ আর্তনাদ করে সে বাসার মধ্যে মরে গড়িয়ে পড়ল। রায়ান এরপর ঈগলের ছেলেপিলেগুলোকে নিকেশ করল আর অনুভব করল যে খানিকটা সময়ের জন্য সে নিরাপদ।

কিন্তু ঈগলের বাসা থেকে সে কীভাবে নিস্তার পাবে সেটা তার জানা ছিল না কারণ বাসাটার পেছনে রয়েছে খাড়া দেওয়াল যেটা দিয়ে তার পক্ষে ওঠা অসম্ভব আর বাসাটা সমুদ্র সৈকতের অনেক ওপরে পাহাড় থেকে তাকের মতো বেরিয়ে আছে। মই বানাবার কোন উপায় তার কাছে নেই আর ঢেউয়ের অবিশ্রান্ত গর্জনের জন্য তার চিৎকার কারও কানে যাবে না। তার মনে হল সে না খেতে পেয়েই মারা যাবে। সেই রাত্রে রায়ান স্বপ্নে আবার তার মা-কে দেখতে পেল। মা বলল, “তুমি একটা বোকা ছেলে। আমি যে চিন্তাগুলো পাঠাচ্ছি সেগুলো তুমি কাজে লাগাচ্ছো না কেন? কাল ঈগলটার ছালটা ছাড়াও আর ওটার ভেতরে গুঁড়ি মেরে ঢুকে যাও। যদি ওর বড় পাখনাগুলো ঈগলকে বাতাসে ভাসিয়ে রাখতে পারে তাহলে তোমাকেও পারবে। খাড়াই থেকে ঝাঁপ দাও, সাগর বেলার বালির ওপর নিরাপদে নেমে আসবে”।

পরের দিন মায়ের স্বপ্নাদেশ মত রায়ান কাজে লেগে গেল। খুব সাবধানে ছেলেটি মহাকায় ঈগলের ছালটা ছাড়াল - তারপরে গুঁড়ি মেরে চামড়ার ভেতরে ঢুকে গেল আর পাখনা দুটোর ঠিক ওপরে তার হাত দুটোকে বের করে রাখল যাতে সে হাত দুটোর নীচে পাখনাগুলোকে সোজা করে ধরে রাখতে পারে। এবার সে প্যারাগ্লাইডিং করার জন্য প্রস্তুত হল। কিন্তু রায়ান যখন খাড়াইটার নীচে মুখ বাড়িয়ে দেখল তার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে গেল। নীচের দৃশ্য দেখে তার মাথা ঝিম্‌ঝিম্‌ করতে লাগল। সমুদ্র তটের ওপর মানুষগুলোকে পোকার মত দেখাচ্ছিল কারণ তারা এতটাই দূরে ছিল। কিন্তু স্বপ্নে পাওয়া নিশ্চিত আশ্বাসের কথা তার মনে পড়লো। তখন সে খাড়াই থেকে ঝাঁপ দিয়ে নীচে পড়তে লাগলো। মহাকায় ঈগলের ডানাগুলো তাকে বাতাসে আলতো করে ভাসিয়ে নিয়ে এলো আর রায়ান তটের বালির ওপর নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে নেমে এলো। চামড়ার ভেতর থেকে সে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এলো আর সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এটা ছিল একটা লম্বা সফর কেন না বিশাল ঈগল তাকে বহুদূরে নিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্ত সন্ধ্যে নাগাদ রায়ান নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে গেল আর তার মা তাকে বাঁধনহারা আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরল।

এরপর রায়ান তার বিপদসঙ্কুল অভিযান নিয়ে সবার সামনে বড়াই করতে লাগল – কীভাবে সে বিশাল ঈগলকে নিকেশ করল, কীভাবে গায়ে আঁচড়টি না লাগিয়ে ওই দুরূহ খাড়াই থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে এল। তার নিজের বল আর বুদ্ধি নিয়ে খুব গর্বের সঙ্গে নিজের ঢাক নিজেই পেটাতে লাগল। কিন্তু সেই পাহাড়ের পরীদের ‘ছোট্ট মানুষদের দেশ’ থেকে যে বুড়িমা এসেছিল সে তখনও ছেলেটির মায়ের সাথেই ছিল। সে বলল, “ওহে দেমাকী ছোঁড়া, ফাঁকা কলসীর আওয়াজ বেশি। নিজের ঢাক নিজে অত পিটিও না। তোমার গায়ের জোর কিছুই নয়, তোমার বুদ্ধিও ফাঁপা। এসব কিছুই তোমার প্রাণ বাঁচায়নি, বাঁচিয়েছে আমাদের চিন্তার ক্ষমতা, যখন সব কিছু ব্যর্থ হয় তখন এগুলিই একমাত্র টিঁকে থাকে আখেরে সফল হয়। আমি তোমাকে জাগতিক সব জিনিষের অসারতা নিয়ে শিক্ষা দিয়েছি, যেগুলো শেষে ছাই বা ধুলো ছাড়া কিছুই নয়। শুধুমাত্র আমাদের চিন্তাগুলো আমাদের অন্তিম কাল পর্যন্ত সাহায্য করে কারণ চিন্তাই কেবলমাত্র অনন্ত”। রায়ান নিঃশব্দে ‘ছোট্ট মানুষদের দেশ’ থেকে আসা বুড়িমার কথা শুনল আর ভাবতে থাকল কিন্তু আর কখনও তার ক্ষমতা নিয়ে বড়াই করেনি।

(www.theoffnews.com Canada folk tales)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours