সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
Latin American Folktales (pp.181) 47. The Mad King (Florida)
কুচুটে এক রাজা একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলই খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে। তারপর সিদ্ধির সরবত-টরবত খেয়ে মনমেজাজ বশে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে ফতোয়া জারি করে দিল যে তার রাজত্বে বুড়োদের স্থান নেই। তার রাজত্ব বৃদ্ধ শূন্য রাজত্ব হবে। এরপরেই সৈন্যদের ডেকে সে হুকুম দিল – “পাকা মাথা দেখলেই ঘ্যাচাং ফু”।
যথা সময়ে হুকুম তামিল হল। এক বুড়ো বাদে সব পাকা চুলোদের গর্দান নেওয়া হল। ওই ভাগ্যবান বুড়োটা একটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে ছেলের খামারে লুকিয়ে পড়েছিল বলে রক্ষে পেয়েছিল। তার ফেরার হওয়ার ফিসফিসানি রাজসভায় এসে পৌঁছাল। রাজার কানে যেতেই রাজা তৎক্ষণাৎ সেই সুদূর দেহাতে সৈনিকদের পাঠিয়ে দিল খবরটা সত্যি কিনা যাচাই করার জন্য আর যদি সত্যি হয় তাহলে একমাত্র পিছলে যাওয়া বুড়োটাকে দয়ামায়া না করে একেবারে কঠোরতম শাস্তি দেওয়ার জন্য।
বুড়ো বাবা যেখানে লুকিয়ে ছিল বলে খবর ছিল সেই খামারে এসে সৈন্যদল পৌঁছাল। তারপর তারা তো বাড়ি ঘরদোর তছনছ করে তন্নতন্ন করে খুঁজল কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হল না। পাখি ফুড়ুৎ। ছেলেটা বাবাকে গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটা সুরক্ষিত গর্তের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল।
সৈন্যরা বিফল মনোরথ হয়ে খালি হাতে রাজসভায় ফিরে এল। “মহারাজ, বৃথা চেষ্টা। বুড়োটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এইকথা শুনে রাজা প্রচণ্ড রাগে খেপে গিয়ে ছেলেটাকে প্রাসাদে ধরে নিয়ে আসতে বলল। তার সামনে ছেলেকে হাজির করার পর সে সবকিছু অস্বীকার করল। রাজা কুচুটে হতে পারে কিন্তু বোকা মোটেই নয়, সে বলল, “তুই জঙ্গলে থাকিস?”
“হ্যাঁ, মহারাজ”।
“তাহলে আমাকে সর্বরোগহরঔষধি খুঁজে এনে দে। কালকের মধ্যে যদি না আনতে পারিস তাহলে জ্যান্ত অবস্থায় তোর চামড়া ছাড়িয়ে নেব”।
ছেলেটা নিরুপায় হয়ে খামারে ফিরে গেল আর তার বৌকে রাজার আদেশ জানাল – বৌ বলল – “সব চাইতে ভাল তোমার বাবাকে জিগ্যেস করা”। ছেলেটাতো একছুটে বাবার লুকনো জায়গায় চলে গেল – “বাবা, আমাকে সর্বরোগহরঔষধি খুঁজে পেতেই হবে”।
বৃদ্ধ বললেন – “এটা আর কী এমন শক্ত কাজ!” তারপর তিনি তাকে বুঝিয়ে দিলেন ওই গাছটা কোথায় গেলে পাওয়া যাবে আর সে সেটাকে প্রাসাদে রাজার কাছে নিয়ে গিয়ে হাজির করল – তখনও সেটা তরতাজা – রাজার সন্দেহ আরও দানা বাঁধল। সে চিন্তা করল, “একজন বৃদ্ধই কেবলমাত্র জানতে পারেন সর্বরোগহরঔষধি কোথায় পাওয়া যাবে।” তারপর তাকে যাচাই করার জন্য আরও একটা ফন্দি আঁটলেন।
“আমাকে সব-পাখির-সেরা-রাজা-পাখি এনে দাও, কালকে ঠিক এই সময়ের মধ্যে, না হলে তোমাকে শূলে চড়ান হবে”।
ছেলেটি আবার ছুটে জঙ্গলে ফিরে গেল। সে বলল, “বাবা, আমাকে সব-পাখির-সেরা-রাজা-পাখি ধরতেই হবে না হলে ওরা আমাকে শূলে চড়াবে”।
বৃদ্ধ বললেন। “আরে ওতো খুব সোজা”। তিনি আবার ছেলেকে বুঝিয়ে বললেন পাখিটাকে কোথায় পাওয়া যাবে আর সে একদম সঠিক সময়ে পাখিটাকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে হাজির হল।
এবারে রাজা বুঝতে পারল যে ছেলেটা তাকে মিথ্যে বলেছিল। একজন বয়স্ক মানুষই শুধু সব-পাখির-সেরা-রাজা-পাখির সন্ধান জানতে পারেন। হার না মেনে রাজা ছেলেটাকে হাতেনাতে ধরার জন্য একেবারে মোক্ষম একটা চাল দিল। সে আবার আদেশ দিল, “কাল আর একবার এসো। যখন আমি তোমাকে দেখব, তোমাকে প্রাসাদের ভেতরে বাইরে একসঙ্গে একই সময়ে থাকতে হবে। অন্যথায়, মৃত্যু”।
ছেলেটি যখন বাবার গোপন ডেরায় গিয়ে পৌঁছাল সে বলল, “বাবা, আমি একইসঙ্গে প্রাসাদের ভেতরেও থাকব আবার বাইরেও থাকব, এটা কী করে সম্ভব?” বাবা বুঝিয়ে বললেন সেটা কীভাবে করা সম্ভব, আর পরের দিন ছেলেটি যখন রাজার সামনে হাজির হল, তখন সে একটা দড়ির এক প্রান্ত প্রাসাদের ছাদের ধারে বেঁধেছিল আর একপ্রান্ত বেঁধেছিল তার নিজের কোমরে আর দোল খেতে খেতে একবার রাজদ্বারের ভেতরে ঢুকছিল আবার বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে রাজা বলল, “কাল তোর বউ আর কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে আয়”। পরেরদিন যখন তারা এসে পৌঁছাল, রাজা ছেলেটার হাতে একটা চাবুক তুলে দিল আর তাকে হুকুম দিল কুকুরটাকে চাবুক দিয়ে মারতে যতক্ষণ না সেটা তার বাবার গোপন ডেরার হদিস দেয়। মালিক অগত্যা চাবুকের ইস্তেমাল করল কিন্তু বাফাদার কুকুর মুখে টুঁ শব্দটি করল না। তখন রাজা হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, “তাহলে তোর বউটাকে চাবুক পেটা কর।” কিন্তু কিছু করার আগেই বউটা বলে উঠল, “সে তো গর্তের ভেতরে লুকিয়ে আছে!”
যত শীঘ্র সম্ভব সৈন্যরা বৃদ্ধ লোকটিকে রাজার সামনে পেশ করল আর রাজা বুড়ো মানুষটির কাঁধে দু’হাত রেখে বলল, “আপনি খুব ভাল একটি ছেলে মানুষ করেছেন”। তারপরে সে তার কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করল, শান্ত হয়ে গেল আর বৃদ্ধ বাবাকে মাফ করে দিল। তারপর বাবা, ছেলে, বৌমা আর কুকুরটি জঙ্গলের মধ্যে তাদের খামারে ফিরে গেল আর তাদের বাকী জীবনটা সেখানেই সুখে শান্তিতে কাটিয়ে দিল।
(www.theoffnews.com Latin American Folk Tales)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours