সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
(জনপ্রিয় লোককথা অবলম্বনে)
রামুকাকা ছিল আমাদের পাটশ্যাওড়া গাঁয়ের পোস্টাপিসের পিয়ন। লোকের চিঠি, মানিঅর্ডারের টাকা পৌঁছাতে প্রায়ই আমাদের পাড়াতে আসত। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত মোতিয়ারি খুড়িমা। খুড়িমার অনেক বয়স। ছেলে বাইরে কাজ করে। স্বামীর অনেক দিন আগেই ইন্তেকাল হয়েছে। তাই খুড়িমা বাড়িতে একাই থাকত। আর রোজ বিকেলবেলা হলেই খুড়িমা বাড়ির বাইরে দাওয়ায় বসে থাকত আর সামনের রাস্তা দিয়ে কেউ পেরিয়ে গেলে তাদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলত।
সেদিনও খুড়িমা যথারীতি তার নির্দিষ্ট জায়গায় বসে ছিল। এমন সময় রামু কাকা তার কাছে এসে সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে বলল - “আম্মা, তোমার ছেলে মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠিয়েছে”।
তাকে দেখেই খুড়িমার চোখ চকচক্ করে উঠল।
খুড়িমা বলল - “আগে আমাকে আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দাও…!”
মোতিয়ারি বিবি রামুকাকার দিকে খুব আশা নিয়ে তাকিয়ে রইল কিন্তু রামুকাকা তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে বলল - “আম্মা, আমার হাতে অত সময় থাকে না যে প্রত্যেকবার তোমার ছেলেকে ফোন করতে পারব”।
সে বারবার এড়িয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু মোতিয়ারি খুড়িমা তাকে অনুনয় করেই যেতে লাগল। সে বলল - “বাবা! খালি তো একটুখানি সময় লাগবে”।
“আম্মা, প্রত্যেকবার ফোন করার জন্য জিদ ধরে থেকো না”। এই বলে খুড়িমার হাতে তার মোবাইল ফোনটা দেওয়ার আগে একটা নাম্বার ডায়াল করতে লাগল। তারপরে মোবাইল ফোনটা খুড়িমার হাতে দিয়ে সাবধান করে বলল - “এই নাও কিন্তু বেশি কথা বলো না”। মোতিয়ারি খুড়িমা তার হাত থেকে মোবাইলটা নিল। মাত্র এক মিনিট কথা বলেই খুড়িমা খুব খুশি হল। তার বলিরেখাগ্রস্ত মুখে আকর্ণ বিস্তৃত দন্তহীন হাসি ফুটে উঠল।
পিয়ন দশটা একশ টাকার নোট তার হাতে দিয়ে বলল - “আম্মা, এই হাজার টাকাটা রাখো”।
টাকাগুলো গুনে নিয়ে খুড়িমা একটা একশ টাকার নোট বার করে পিয়নের দিকে বাড়িয়ে বলল - “বাবা, এটা তুমি রাখ”।
পিয়ন অবাক হয়ে জিগ্যেস করল - “কেন আম্মা?”
মোতিয়ারি আবার তার ফোগলা হাসি হেসে বলল - “মানিঅর্ডার দেওয়া ছাড়াও তুমি আমাকে আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলিয়ে দাও - তার জন্য তো তোমার খরচা আছে। তাই না? তাই তুমি এটা রেখে দাও”।
রামু তো কিছুতেই টাকাটা নেবে না আর খুড়িমা দেবেই। শেষে খুড়িমা জোর করে তার হাতে টাকাটা গুঁজে দিল আর আল্লার কাছে তার জন্য অনেক দোয়া মেঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।
সেখান থেকে রামুকাকা কয়েক পা মাত্র গেছে এমন সময় হঠাৎ তার পিঠে কেউ টোকা মারল। পিছনে ফিরে দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে গোলাম আম্বিয়া, যে ওই গ্রামে একটা মোবাইলের দোকান চালায়।
রামুকাকা তাকে জিগ্যেস করল - “ভাই, তুমি এখানে হঠাৎ? কী ব্যাপার?” গোলাম বলে - “আমি এখানে একজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম কিন্তু তোমাকে একটা কথা শুধানোর আছে। ভাই, তুমি প্রতি মাসে এটা কেন করো?”
রামুকাকা ঘাবড়ে গিয়ে বলল -“আমি কী করি?”
গোলাম বলল - “প্রত্যেক মাসে খুড়িমাকে তুমি নিজের জেব থেকে টাকা দাও। শুধু তাই নয়, তুমি আমাকে টাকা দাও খুড়িমার ছেলে হয়ে কথা বলার জন্য! কিন্তু কেন?”
পিয়ন কাকা গোলামের প্রশ্নের উত্তর দিতে খানিকক্ষণ ইতস্তত করে। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে বলে - “আমি মোতিয়ারি খুড়িমাকে টাকাটা দিই না। আমি দিই আমার মা'কে”। গোলাম এ’কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। রামুকাকা বলতে থাকে - “আম্মার ছেলে দুবাই গিয়েছিল রোজগারের চেষ্টায় আর প্রতি মাসে মানিঅর্ডার করে এক হাজার টাকা পাঠাত, কিন্তু একদিন টাকার বদলে আম্মার নামে তার ছেলের এক বন্ধুর একটা চিঠি এলো”। গোলাম রহস্যের গন্ধ পেয়ে রামুকাকা পিয়নের কাছ ঘেঁষে এসে বলল - “কী রকমের চিঠি? চিঠিটায় কী লেখা ছিল?” “একটা সংক্রামক রোগে তার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। এই কথাটা আমি সাহস করে কিছুতেই আম্মাকে বলতে পারিনি কারণ প্রতি মাসে কয়েকশো টাকার জন্য সে অপেক্ষা করে থাকে আর ছেলের মঙ্গল কামনায় আল্লার কাছে দোয়া মাঙ্গে। তাই প্রতিমাসে আমি আম্মার জন্য সেই মানিঅর্ডার নিয়ে আসি” - পিয়ন সব কথা খুলে জানায়।
“কিন্তু খুড়িমা তো তোমার নিজের মা নয়…” - গোলাম বলে ওঠে। রামুকাকা ধীরে ধীরে বলে - “আমিও আমার মা'কে হাজার টাকা করে পাঠাতাম, কিন্তু মা আর নেই” - এই কথা বলার সময় রামুকাকার চোখ জলে ভরে ওঠে। গোলাম, যে প্রতিমাসে রামুকাকা পিয়নের কাছ থেকে মোতিয়ারির ছেলে সেজে কথা বলার জন্য টাকা নিত, একথা শোনার পর একেবারেই চুপ করে গেল।
(www.theoffnews.com mother folk tales)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours