সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:
কথায় বলে, অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।
আরে এতো বাংলা প্রবাদ। হঠাৎ এমন প্রবাদ এখানে প্রাসঙ্গিকতা পেল কি করে?
আসলে কলকাতার একাধিক হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে রসিকতার সঙ্গে এমনই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন পার্থ রঞ্জন দাস। হাস্যরস যোগ করে তিনি বলেন, ডালহৌসি স্কোয়ারে বহু ঐতিহ্যশালী বিল্ডিং আছে। যেখানে সঙ্কীর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য দমকল প্রয়োজনে সঠিক ভাবে প্রবেশ করতে পারবে না। তবু এসব ক্ষেত্রে দমকল বিভাগের অনুমোদন লাগবে সংস্কারের দরকারে। এর উপর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ব্যুরোক্রেসির লাল ফিতের অনর্থক দীর্ঘসূত্রিতা তো রয়েছেই। এক্সট্রা পাওনা হিসেবে আদালতে মামলা তো থাকবেই। সেখানে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন কিভাবে সঠিক সময়ে ওই সব স্থাপত্যের প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজে উদ্যোগ নিতে পারবে? তাঁর সংযোজন, আমরা বাইরে থেকে অনায়াসেই রাজ্য হেরিটেজ কমিশনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ঠুঁটো জগন্নাথ বলতেই পারি, কিন্তু ভিতরে অবস্থানগত পর্দার আড়ালে থাকা অজস্র সংশ্লিষ্ট জায়গা থেকে কি পরিমান বাধা রাজ্য হেরিটেজ কমিশনকে সামলাতে হয় তা সাধারণ মানুষের অনেকটাই অজানা।
চলতি বছরের তারিখটা ছিল ২২ অক্টোবর। বিকেল বেলায় বসেছিল একটা জমাটি আলোচনাচক্র। কলকাতার ভারত চেম্বার অফ কমার্স ভবণে। উক্ত বণিকসভা ও তার লেডিস ফোরামের যৌথ উদ্যোগে। আলোচনার বিষয়বস্তু বস্তু ছিল, 'কলকাতার স্থাপত্য এবং তার ঐতিহ্য ও স্থায়িত্ব।'
উদ্যোক্তাদের তরফে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেন নরেশ পাচিসিয়া ও রেণুকা শাহ।
মূল আলোচনায় অংশ নেন পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের সদস্য তথা মহানগরের নামজাদা স্থপতি পার্থ রঞ্জন দাস। মনোগ্রাহী স্লাইড শোয়ের মাধ্যমে তিনি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকান ভূখণ্ডের বিভিন্ন ঐতিহ্যময় স্থাপনের অপার কারুকার্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। পাশাপাশি ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাংশের একাধিক ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নান্দনিক দৃষ্টান্তও উপস্থিত অতিথিদের সামনে পরিবেশন করেন। পাশাপাশি কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঐতিহ্যমন্ডিত ভবণের উপরেও আলোকপাত করেন। তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, জোড়াসাঁকো এখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিশ্বখ্যাত হলেও সেই চিরাচরিত ভবণের সাবেকিয়ানা এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এর সংস্কার কার্য বিতর্ক সৃষ্টি করেছে নানা মহলে। এমনকি কলকাতাতেই অবস্থিত ভারতীয় যাদুঘর ভবণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারা পৃথিবীর মধ্যে এই যাদুঘরটি নবমতম প্রাচীন মিউজিয়াম। অথচ এর বহুতল মেরামত করতে গিয়ে যে ইস্পাত ও কাঁচ ব্যবহার করার প্রক্রিয়া চলছে তাতে ভবণের প্রকৃত স্থাপত্যের পরিপন্থী ঘটবেই অনিবার্য ভাবে। তিনি আরও মন্তব্য করেন, এই শহরের উত্তর ও দক্ষিণ যেন স্থাপত্যের দুই মধুময় বৈচিত্র্যের দুই মেরু। উত্তর কলকাতায় রয়েছে বনেদি চিহ্নিত বিল্ডিং ও হোটেল। আর দক্ষিণ কলকাতায় গড়ে উঠেছে আধুনিকতার চোখ ধাঁধানো লেটেস্ট স্থাপত্য। একইসঙ্গে তাঁর আক্ষেপ, অথচ এই দুয়ের মেল বন্ধন কলকাতায় ক্রমশঃ নষ্ট হতে বসেছে এই শহরের সৃষ্ট দূষণ জনিত কার্বণের নিরন্তর প্রভাবে।
এই মনোজ্ঞ আলোচনায় বক্তব্য পরিবেশন করেন কলকাতার অপর খ্যাতনামা স্থপতি মনিকা খোসলা ভার্গব। তিনিও স্লাইড শোয়ে পার্ক স্ট্রিটের প্রাচীন ও নব্য ঐতিহ্যময় স্থাপত্যের নানান চমকপ্রদ দিক উপস্থাপনা করেন। কিভাবে পুরাতন পার্ক স্ট্রিটের প্রাচীন ভবণগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্য ঘটিয়ে একাধিক অপরূপ শৈলীর বিল্ডিং পরবর্তী ক্ষেত্রে যেভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বিগত কয়েক দশকে, তা সত্যি বিস্ময়কর। পুরনো ও নতুন স্থাপত্যের এই যৌথ সংমিশ্রণে এলাকায় গড়ে উঠেছে খ্রীষ্টানদের জন্য উদযাপিত বড়দিন উৎসবের এক অনন্য পীঠস্থান। এই সবের পাশাপাশি পুরাতন কলকাতাকে টেক্কা দিতে বিগত সত্তরের দশকে গড়ে উঠেছে তিলোত্তমা নগরীর উপকন্ঠে নবরূপে সল্টলেক। ধর্মতলা চত্বরে যে সমস্ত বিশ্ববন্দিত হেরিটেজ বিল্ডিং রয়েছে তার সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিয়ে সল্টলেকে গড়ে উঠেছে বহুবিধ দৃষ্টিনন্দন নির্মাণ শৈল্পিক কংক্রিট ভবণ। বিশ্বের অত্যাধুনিক পরিকল্পিত শহরগুলির সঙ্গে সল্টলেক তাই অবশ্যই সমতুল্য। যা সামগ্রিক কলকাতার এহেন সংমিশ্রিত স্থাপত্য অবধারিত এক নস্টালজিক ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠিত উপমা বলেই তিনি উল্লেখ করেন।
(www.theoffnews.com Kolkata architecture heritage sustainability)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours