রণজিৎ গুহ, লেখক ও সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:
(লেখক একজন গর্বিত প্রাক্তন ইস্পাত কর্মী)
পুরাণকথা বা মহাকাব্য ইতিহাস নয় ঠিকই কিন্তু মহাকাব্য রচয়িতা বা পুরাণকার প্রজ্ঞাবানরা গল্পকথার আড়ালে মানবজীবন এর সাধারণ দৈনন্দিন ইতিকর্তব্য বিষয়ে অনেক প্রয়োজনীয় এবং জরুরি পরামর্শ লিপিবদ্ধ করেছেন। রামায়ণ কথায় রামচন্দ্র রাবণ এর সাথে যুদ্ধে এঁটে উঠতে না পেরে দশপ্রহরধারিনী দুর্গার শরণাপন্ন হলেন।বসন্ত ঋতুতে পুজ্য দুর্গাকে আবাহন জানালেন শরৎকালে। তার আগে প্রস্তুতি পর্বে স্মরণ করলেন পূর্বজদের। তাঁদের প্রণাম জানালেন। এক আশ্বিন অমাবস্যায় তর্পণ করলেন। তুষ্ট করলেন পূর্বজদের।আনুষ্ঠানিক অনুমতি প্রার্থনা করলেন দুর্গা আবাহনের।
মহাভারতে এক উপাখ্যান জানাচ্ছে মহাবীর কর্ণ স্বর্গচ্যুত হয়েছিলেন কারণ তিনি কর্ম ব্যস্ততায় মা বাবাকে অন্নজল দেননি। পুনরায় মর্তে এসে প্রয়াত উর্ধতন প্রজন্মকে সম্মান শ্রদ্ধা স্মরণ করে তবেই স্বর্গবাসের অধিকার পেয়েছিলেন। এই হল আমাদের পুরাণ মহাকাব্যর অনন্য শিক্ষা। শত ব্যস্ততাতেও পুর্বজদের ভুলো না। সকল শুভ কাজের আগে পুর্বজদের স্মরণ কর। কৃতজ্ঞতা জানাও।
তর্পণ করা মানে তৃপ্ত করা। সন্তুষ্ট করা। সনাতন ধর্ম বিশ্বাস মতে প্রয়াত পরিবার সদস্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শ্রদ্ধা সম্মানের প্রতিক্ষায় থাকেন।লোকাচার ও দেশাচার অনুযায়ী জলদান তিলদান করে এই প্রতীকি শ্রদ্ধা সম্মান জানানো হয়। অগ্রপথিক পূর্বজদের কৃতজ্ঞতা জানাতে উত্তরপুরুষ সশ্রদ্ধায় উচ্চারণ করেন 'ওঁ দেবা যক্ষাস্তুথা নাগা গন্ধর্ব্বাপ্ সরসোহসুরাঃ। ক্রূরাঃ সর্পাঃ সুপর্ণাশ্চ তরবো জিহ্মগাঃ খগাঃ। বিদ্যাধরা জলাধারা স্তথৈবাকাশগামিনঃ। নিরাহারশ্চ যে জীবাঃ পাপে ধর্ম্মে রতশ্চ যে। তেষামাপ্যায়নায়ৈতদ্ দীয়তে সলিলং ময়া।'
'ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যান্ত ভুবনত্রয়ম, আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্যন্তং তৃপ্যন্তু'
ঐতিহ্যগত এবং আবহমানকাল ধরে আচরিত বিশ্বাসগুলিকে আমরা আধুনিকতার আলোকে নিছক কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতেই পারি। পুর্বপুরুষদের জল দান তিল দান অবৈজ্ঞানিক ও নেহাৎই হাস্যকর বলে আত্মশ্লাঘা লাভ করতে পারি। কিন্তু সনাতন ধর্মের প্রবক্তারা এই তর্পণ মন্ত্র উচ্চারণে এক বৃহৎ বিশ্বের ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তর্পণ মন্ত্রে বলা হচ্ছে প্রয়াত পূর্বজগণ, দেব, যক্ষ, নাগ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর, জন্তু, সর্প, পক্ষী সরীসৃপ, পক্ষী, কিন্নর, জলচর, খেচর, ভূত ধার্মিক, পাপী, বন্ধু, শত্রু এমনকি গাছ গাছালি সকলেই আমার অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রক। সকলেই তুষ্ট থাকো।
ইউরোপ আমেরিকা অনুকরণে আমরা মাদার্স ডে ফাদার্স ডে খুব আড়ম্বরে পালন করতে উদ্যোগ নিই অথচ পুর্বজদের স্মরণ শ্রদ্ধা জানানোর দেশজ পন্থা তর্পণ অনুষ্ঠানকে অবহেলা করি। প্রয়াতজনের কাছে তিল জল কিভাবে পৌঁছায় তা নিয়ে ঠাট্টা করি। প্রয়াত অগ্রজদের স্মরণ করা শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানকে নিছক কুসংস্কার বলে হেলাফেলা করাকে বিজ্ঞান সচেতনতা বলে দাবী করব? স্মরণ অনুষ্ঠানের আন্তরিকতা উপলব্ধি করব না? পরম্পরাগত লোকাচার সবই মেধাহীন এবং অবৈজ্ঞানিক এমন ভাবনা বড়ই একপেশে। অতীতকে সম্পুর্ণ অস্বীকার করলে ভবিষ্যৎ কাঠামো জোরদার হয় না।
(www.theoffnews.com Mahalaya Tarpan)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours