সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
(কাশ্মীরি ভাষায় মূল লেখক আবদুল গনি বেগ আথার)
[ইংরেজি ভাষায় অনুবাদক নীরজা মাটু]
{বাংলা ভাষায় অনুবাদক সোমনাথ রায়}
হাঁটতে হাঁটতে ভারতীয় সেপাইদের চেকপোস্টটা পেরলাম। তখন প্রায় দুপুর। চারদিক শুনশান। হয়ত তারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বা আলসেমি করছে। তারা কল্পনাও করতে পারবে না কোন মা কা লাল প্রকাশ্য দিবালোকে বর্ডার পার হবার সাহস দেখাতে পারে। ঘামে চুবচুবে হয়ে ট্রেন ইঞ্জিনের গতিতে ছুটছিলাম। ভাইয়ের মুখটা আমার চোখের সামনে নাচছিল। যে লোকটা খবর নিয়ে এসেছিল সে বলেছিল ভাইয়ের অবস্থা খুব বাড়াবাড়ি। নীলম নদীর ধারে আমার ভাই যে লোকালয়ে থাকে সেখানে তার আপনজন কেউ নেই।
আমি নদীর অন্য ধারে থাকি আর আমার কপালে ইন্ডিয়ার ছাপ মারা আছে আর সরু নদীটার ঠিক উল্টোদিকে তার কপালের ওপর পাকিস্তানের ছাপ মারা আছে। লোকটা আরও বলেছিল – “বিকারের ঘোরে সে শুধু তোমার নাম বিড়বিড় করছে”। ওই খবর শোনার পর আমি কী করে ঠিক থাকতে পারি? যাই ঘটে যাক না কেন, রক্তের সম্পর্ক!
আথমুকুয়াম ব্রীজে পৌঁছলাম। সামনে নদীর পাড়েই ওর কুঁড়ে ঘর। ওখানে পৌঁছতে আমার ঠিক পাঁচ মিনিট লাগবে। চোরের মত চারপাশটা দেখলাম, তারপর হাতগুলো মুঠো করে তীরের মত ছুটতে শুরু করলাম। কয়েক পা যেতে না যেতেই হটাৎ একটা প্রচন্ড জোর চীৎকার – “হল্ট!” আমি স্থাণুবৎ নিশ্চল হয়ে গেলাম। চোখ তুলে তাকাতেই তাদের দেখতে পেলাম – দুজন ঢ্যাঙা সেপাই রাইফেল তাক করে লম্বা লম্বা পা ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
আমার কপালের ছাপটা তারা নিরীক্ষণ করে দেখল আর তাদের একজন ঘোষণা করল – “ইন্ডিয়ান”। অন্যজন বলল – “গ্রেফতার কর”। “না, না, স্যার, আমি ইন্ডিয়ান নই। আমি পাকিস্তানিও নই। আমি শুধু একজন কাশ্মীরি। স্যার কেরানে ওই কাঠের ঘরটা দেখতে পাচ্ছেন? ওইটা আমার বাড়ি। আর অন্য পাড়ে ওই কাঠের ঘরটা দেখতে পাচ্ছেন? ওটাতে আমার ভাই থাকে। ও খুব অসুস্থ স্যার আর আল্লাহ্ ছাড়া ওর নিজের লোক বলে ওর কাছে কেউ নেই। স্যার, দয়া করে আমাকে শুধু আধ ঘন্টা মঞ্জুর করুন – আমি শুধু ওকে জিগ্যেস করব ও কেমন আছে, কিছু ওষুধ জোগাড় করে দেব, আর সম্ভব হলে একটু খাবার জল”।
একটা রাইফেলের কুঁদো এসে আমার ঘাড়ে সজোরে গুঁতো মারল – আমার পায়ের তলার মাটি নড়ে গেল। তারা আমাকে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে তাদের বাঙ্কারে নিয়ে এল। আরও সেপাই হাজির হলো – তারাও ছাপটা দেখল আর একই কথা আওড়াল – “ইন্ডিয়ান। শত্রুপক্ষের খোচর”। এরপর তারা টর্চার করতে শুরু করল। আমাকে বলা হলো আমি যেন সোজাসুজি কবুল করে নিই যে আমি একজন ইন্ডিয়ান স্পাই আর পাকিস্তানের শত্রু।
আমার কী কবুল করার ছিল? - যে আমি আমার ভাইয়ের শত্রু?
আমাকে হেড কোয়াটার্সে নিয়ে যাওয়া হল, সেটা আমার ভাইয়ের কুঁড়ের পাশেই। আবার আমি তাদের কাছে কাকুতিমিনতি করে বললাম – “প্লিজ স্যার, আমার ভাই এই পাশের কুঁড়ে ঘরেই আছে। ওর ভীষণ শরীর খারাপ। একটু দয়া করুন – আমাকে ওর কাছে যেতে দিন – আমি তো হাতকড়া পরে আছি – শুধু ও কেমন আছে সেটা শুধোব”।
কিন্তু ওরা আমার কথায় কর্ণপাত করল না। তারা আমার নখগুলো উপড়ে ফেলল, আমার ক্ষতগুলোতে নুন ছিটিয়ে দিল আর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। জ্ঞান ফিরলে দেখলাম আমার ভাই আমার পাশে শুয়ে আছে – একটু বাতাসের জন্য খাবি খাচ্ছে – জলের জন্য হাহাকার করছে – আর আমি – হাতকড়া আর শিকলে বাঁধা, একফোঁটা জলও নজরে পড়ল না। একটা হাতকড়ার তীক্ষ্ণ ফলা আমার বাঁ হাতে বিঁধে গেল আর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। আমার ডান হাতের গন্ডুষে তরলটা সংগ্রহ করলাম ভায়ের তেষ্টা মেটাতে তার মুখের কাছে এগিয়ে দিতে গেলাম - কিন্তু চেনে বাঁধা আমার হাত তার শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে পৌঁছতে পারল না। শেষে একফোঁটা জলের জন্য একটা মরিয়া আকুল আর্তনাদ, একবার হিক্কা তোলা আর তারপরই গলায় মরে যাওয়ার ঘড়ঘড় আওয়াজ। আমার গলা ফেটে চীৎকার বেরোল – “সব শেষ, পুরো খতম, মানুষের মন, তার চিন্তা-ভাবনা – যেটা ঈশ্বরের রাজত্বকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে আর একজন ভাইকে তার নিজের ভাইয়ের শত্রু বলে”।
আমি চমকে জেগে উঠলাম আর দেখতে পেলাম মোচওয়ালা সেপাইদের চোখ থেকে জল পড়ছে।
তারা আমাকে জানলা দিয়ে দেখতে বলল – আমি দেখলাম – আমার ভাইয়ের লাশ কাফনে ঢাকা অবস্থায় একটা কফিনে রাখা রয়েছে।
“আমাকে যেতে দাও – আমার ভাইয়ের মুখটা দেখতে দাও – শেষবারের মত ওর জন্য প্রার্থনা করতে দাও – ও আমার ভাই – তোমরা জানো?”
তারা জানাল যে তারা খুব ভাল করেই জানে যে মৃত লোকটি আমার ভাই কিন্তু তার দাফন অনুষ্ঠানে যোগদান করার অনুমতি তারা আমাকে দিতে পারবে না। তাদের শেষ কথা – “আমরা অসহায়”।
আমি তাদের অনুনয় করে বললাম – “দয়া করে আপনাদের অফিসারদের কাছে অনুমতি চান”।
“তারাও অসহায়” – তারা জানাল।
“তাহলে অফিসারদের অফিসারদের কাছ থেকে” – আমি মিনতি করলাম।
“তারাও অসহায়” – উত্তর এল।
“তাহলে কে পারে সাহায্য করতে? কার সেই ক্ষমতা আছে?”
“সেটা জানার ক্ষমতা আমাদের নেই”।
(www.theoffnews.com Kashmiri story Abdul Gani Baig Athar)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours