সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

দুর্গাপুর নামকরণটি অর্বাচীন কালের হলেও এই জনপদের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। দুর্গাপুরের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ রূপে বোঝার জন্য মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে - প্রাগৈতিহাস, মধ্যযুগীয় ইতিহাস এবং আধুনিক ইতিহাস। 

রাজ্যে পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মানসপুত্র দুর্গাপুর ষাটের দশকে ‘ইস্পাতনগরী’ বলে পরিচিতি পেয়েছিল। নব্বই-এর দশক থেকে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় দুর্গাপুর ‘শিক্ষানগরী’ হিসেবেও পরিচিত হয়েছিল। তারপরে ‘(শপিং)মলনগরী’ ও অধুনা বিভিন্ন অত্যাধুনিক স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রের দৌলতে ‘স্বাস্থ্যনগরী’ হিসেবে বিখ্যাত।

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পাশের বাঁকুড়া জেলার জগন্নাথপুর গ্রাম থেকে গোপীনাথ চট্টোপাধ্যায় দুর্গাপুরের দামোদরের কাছে নডিহা গ্রামে স্থায়ী বসবাসের জন্য চলে আসেন। গোপীনাথ তাঁর একমাত্র মেয়ে আনন্দময়ীকে নডিহা গ্রামের ভূসম্পত্তি দান করেন এবং তাঁর দৌহিত্র মুখোপাধ্যায় বংশ এখনও নডিহা গ্রামে বসবাস করছেন। গোপীনাথের কনিষ্ঠ পুত্র দুর্গাচরণের নামে দুর্গাপুরের নামকরণ হয়েছে এমনটা অনুমান করা হয়।  

শুধুমাত্র প্রত্নপ্রেমীরাই জানেন যে ১৯৫৪ এবং ১৯৫৭ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ-এর সংযুক্ত মহানির্দেশক অধ্যাপক ব্রজ বাসী লাল নডিহা এবং বীরভানপুরে খনন করে ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ের নবপলীয় যুগের নবাশ্মীয় সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেছিলেন। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার নডিহা এবং বীরভানপুরকে আন্তর্জাতিক প্রত্নস্থলের মানচিত্রে জায়গা করে দিয়েছে। পরিতাপের বিষয় দুর্গাপুরের অধিকাংশ নাগরিক এই গুরুত্ব পূর্ণ ঐতিহ্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নন এবং এখানে আবিষ্কৃত প্রস্তর আয়ুধের একটি নিদর্শনও দুর্গাপুরে নেই। নডিহার তদানীন্তন জমিদার অজিতকুমার মুখোপাধ্যায় বীরভানপুরে প্রথম প্রস্তরায়ুধটি সংগ্রহ করেছিলেন এবং যাঁর ঐকান্তিক আগ্রহে বি বি লাল এখানে খনন করেছিলেন এবং মাটির তলা এবং ওপর থেকে প্রায় আড়াই হাজার প্রস্তরায়ুধ, পুঁতি ইত্যাদি সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁর কৃতী পুত্র ডঃ শ্যামল মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানা গেছে যে ওই সব সংগ্রহ তিনি কলকাতার কোনও সংগ্রহালয়ে দান করেছিলেন তবে সেখানেও পরে তিনি সেগুলির কোন হদিশ পাননি। নডিহার ‘দক্ষিণায়ন’ নামে যে জায়গায় খনন হয়েছিল পরে সেটি সংরক্ষিত স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের পর বাংলাদেশী শরণর্থীরা এখানে বসবাস শুরু করেন এবং সেই সংরক্ষিত স্থানেও আধুনিক ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে। ডিপিএল-এর কর্মী আবাসনের মধ্যে অবস্থিত ‘উড ইন্ডাস্ট্রি’-র ভেতর খনন কাজের একটি ট্রেঞ্চ ছিল, সেটিরও কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। বি বি লাল দুর্গাপুরে যে প্রাচীন মানব সভ্যতার দাবী করেছেন তা যদি সত্যি হয় তাহলে এই সভ্যতা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতা থেকে বহু প্রাচীন কারণ এখানে অনেক ধরণের প্রত্ন অবশেষ পাওয়া গেলেও মৃৎপাত্রের কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি। বি বি লাল অনুমান করেছিলেন যে নডিহা এবং বীরভানপুরে পাথরের অস্ত্র বা যন্ত্র তৈরির কারখানা ছিল, প্রাগৈতিহাসিক শিকারীরা এখান থেকে সেগুলি বিনিময় প্রথার মাধ্যমে নিয়ে যেত। দুর্গাপুরের অনতিদূরে পান্ডু রাজার ঢিবি ও গোস্বামীখন্ডের রাজডাঙ্গায় অজয় নদ দিয়ে যে বাণিজ্য চলত তা আজ প্রমাণিত। লৌহ-প্রস্তর যুগে দুর্গাপুরে লোহা গলানো হতো তার প্রমাণ দুর্গাপুরের নির্জন স্থানে কিছুদিন আগেও পাওয়া যেত। ইতিহাসের এমন মজা, বহু হাজার বছর পরে আধুনিক দুর্গাপুরে ইস্পাত এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতির কারখানা হয় এবং এখান থেকে উৎপাদিত দ্রব্যাদি দেশে-বিদেশে চালান যায়।

ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলকে সুহ্মদেশ, রাঢ়-দেশ, বর্ধমান ভুক্তি, বজ্জভূমি, কর্ণসুবর্ণ, ক-জঙ্গল, গোপভূম, শেরগড় পরগণা প্রভৃতি বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে দুর্গাপুরের মুচিপাড়া থেকে চার মাইল উত্তরে আঢ়া বা আড়রা গ্রামই রাঢ়াপুরী (দুর্গাপুরের ইতিহাস – প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়)। আঢ়া বা আড়া গ্রামে রাঢ়ের অধীশ্বর রাঢ়েশ্বর শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দুর্গাপুরের মুচিপাড়া থেকে মলানদীঘি হয়ে শিবপুর যাওয়ার পথে আড়া গ্রাম। আনুমানিক ১২শো শতাব্দীতে নির্মিত উড়িষ্যা রেখ দেউলের আদলে তৈরি রাঢ়েশ্বর শিবমন্দির একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য। এটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কর্তৃক সংরক্ষিত। আড়া গ্রাম অত্যন্ত প্রাচীন গ্রাম। গ্রামের অভ্যন্তরে এখনও কিছু বৌদ্ধ ও জৈন মূর্তির ভগ্নাবশেষ এবং কয়েকটি প্রাচীন মন্দির আর একটি দর্শনীয় জমিদার বাড়ি আছে যার নাম চার আনির জমিদার বাড়ি।

মধ্যযুগে জগন্নাথধাম বা দাক্ষিণাত্য যাওয়ার পথে দুর্গাপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলে পরিগণিত হতো। ভৌগোলিক কারণে দুর্গাপুর আশেপাশের অঞ্চল থেকে উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় এটি কৌশলগত কারণেও প্রাগৈতিহাসিক মানুষ থেকে শাসক, বণিক, তীর্থযাত্রী, ব্রিটিশ সার্ভেয়ার সবার কাছে আকর্ষণীয় ছিল। জৈন ধর্মের ২৪তম তীর্থঙ্কর মহাবীর, যাঁর অপর নাম বর্ধমান, রাঢ় অঞ্চলে ধর্ম প্রচার করেছিলেন ফলে এই অঞ্চলে জৈন ধর্মের প্রাবল্য বেশি। পশ্চিমা ব্যবসায়ীদের আধিক্যও এর প্রচারের একটা কারণ। সপ্তগ্রাম বন্দর বৌদ্ধদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই দুর্গাপুর ও তার আশেপাশের অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এখনও বিদ্যমান – রাঢ় অঞ্চলে ধর্ম্মরাজ পুজো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। কাঁকসা তহশীলের বিদবিহার গ্রাম এবং বুদবুদ থানার ভরতপুর বৌদ্ধবিহার এই প্রমাণকে আরও দৃঢ় করেছে। দুর্গাপুর থেকে বাঁকুড়া হয়ে দাক্ষিণাত্য যাওয়ার যে রাস্তা তার ওপর নির্দিষ্ট দূরত্বে জৈন বা বৌদ্ধ মন্দির এবং ভান্ডার স্থাপিত হয়েছিল তীর্থযাত্রী ও বণিকদের সুবিধার্থে যেমন শের শাহের আমলে স্থাপিত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে নির্দিষ্ট দূরত্বে ‘চটি’ স্থাপিত হয়েছিল।

বৌদ্ধধর্মের ক্ষয়িষ্ণু পর্বে ইলামবাজার ও সন্নিহিত অঞ্চলে তন্ত্র সাধনার জোয়ার আসে। জয়দেব-কেন্দুলী এবং সন্নিহিত অঞ্চলে আউল-বাউল আখড়ায় এর রেশ এখনও পাওয়া যেতে পারে। দুর্গাপুরের বর্তমান মানচিত্রের বাইরে বৃহত্তর দুর্গাপুরের দিকে যদি নজর দেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গের অনেক অঞ্চলের মত এখানেও প্রত্ন ও পুরাসম্পদের কোন অভাব তো নেই-ই বরং বহু বিখ্যাত জায়গার থেকে বেশিই আছে। স্বাধীনতা লাভের পর ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ-এর কাজের পরিধি কমেছে কিন্তু কাজের প্রসারতা বা গুণগত মান বৃদ্ধি পায়নি। এই অঞ্চলে প্রাচীন স্থাপত্যের বহু নিদর্শন কিছুদিন আগেও দৃশ্যমান ছিল কিন্তু অনাদরে অবহেলায় বেশির ভাগ নিদর্শনই হারিয়ে গেছে বা ব্যক্তিগত সংগ্রহে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে। একেবারে হালে সিটি সেন্টারে ভাগ্যক্রমে আবিষ্কৃত সুড়ঙ্গটির কথাই ধরা যাক। আধুনিক যুগের এই আবিষ্কার সাধারণ মানুষের মনে দারুণ উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল। আপামর জনসাধারণকে পুরাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ব সম্বন্ধে আগ্রহী করে তোলার এই ছিল সুবর্ণ সুযোগ। একজন ছদ্ম ইতিহাসকার দুর্গাপুরের ইতিহাস লিখে উপকার করতে গিয়ে একটি প্রাকৃতিক গুহাকে উত্তরবঙ্গের ভবানী পাঠকের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে যে অতলান্তিক ভুল করলেন সেটা অন্তত শোধরানো যেত। কিন্তু আদতে কি হল? ভারতবর্ষে যা এখন দস্তুর তার থেকে আলাদা কিছু নয়। দন্ডমুন্ডের কর্তাদের সঙ্গে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কয়েক কোটি টাকার হাতবদলে সুড়ঙ্গটারই হাতবদল হয়ে গেল! হায় রে দেশীয় ঐতিহ্য, হায় রে দেশপ্রেম! রং বদলায়, স্বভাব বদলায় না। এক প্রয়াত ঐতিহাসিক দুর্গাপুরের একটি প্রাচীন পুকুর খনন করিয়ে একটি প্রাচীন বিষ্ণুমূর্তি পেয়েছিলেন, কালক্রমে সেটি একটি ইস্কুলে ঠাঁই পায়। ভাগ্যের এমন পরিহাস সেই ইস্কুলের তদানীন্তন হেডস্যার অবসর গ্রহণের সময় ওইটিকেও বিদায়কালীন উপহার মনে করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রেখেছেন। অত্যন্ত বেআইনী কাজ, কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে, ইত্যাদি। অমূল্য জাতীয় সম্পদের প্রতি আমাদের প্রবাদপ্রতীম উদাসীনতাই এর জন্য দায়ী। আমরা আত্মবিস্মৃত জাতি এবং আমাদের ঐতিহ্যের প্রাচুর্য আমাদের চোখে ঠুলি পরিয়েছে।

দুর্গাপুরস্থ এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে অবিশ্বাস্য রকম প্রাচীন ঐতিহ্য ও উৎসব এখনও বিদ্যমান যা ‘হেরিটেজ ট্যুরিজম’ জমিয়ে দিতে পারে, স্থানীয় ভাবে এবং সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির হাল ফেরাতে পারে। বামুনাড়া, গোপালপুর, আড়া, কুলডিহা, মলানদিঘী, ইছাই ঘোষের দেউল, শ্যামারূপার গড়, নডিহা, বীরভানপুর, সগড়ভাঙ্গা প্রভৃতি গ্রামে প্রাচীন স্থাপত্য ও ধর্ম্মরাজ পুজো, চড়ক-গাজন ইত্যাদি অবশ্য দ্রষ্টব্য।

 দুর্গাপুরের দু’টি প্রাচীন মূর্তি-ভাস্কর্যের কথা বলে এই আলোচনায় দাঁড়ি টানতেই হবে। বামুনাড়া (বামুন-আড়া) গ্রামের মাঝখানে ভুবনেশ্বর মন্দির সংলগ্ন একটি পুকুরের পাড়ে কয়েকটি ভগ্নমূর্তি রয়েছে যার মধ্যে আকর্ষণীয় হলো নৃত্যরত অষ্টভূজ নটরাজের মূর্তি। একটি আয়তাকার ল্যাটেরাইট পাথরে খোদিত অপূর্ব এই মূর্তি, যার আয়তন ৭৫ সেমি X ৪২ সেমি। পাদপীঠে বৃষ লাঞ্ছন, নৃত্যরত মূর্তির ওপরের হাতদু’টি যোগমুদ্রায় মুষ্টিবদ্ধ; আর নিচের হাতে রয়েছে ডমরু ও অক্ষমালা। ডানদিকের একটি হাত কনুই থেকে ভাঙ্গা – মনে হয় এই হাতে ছিল ত্রিশূল। বাঁ দিকের সবথেকে নিচের হাতে রয়েছে কমন্ডুল এবং তার ওপরের হাত দুটি ভাঙ্গা। বৃষের দু’পাশে শিবের দুই অনুচর দাঁড়িয়ে। শিবমূর্তির মাথায় জটাজুট ও গায়ে বিচিত্র অলংকার। ফলকের ওপরের দু’পাশে দু’টি উড়ন্ত গান্ধর্ব মূর্তি খোদিত। বিশেষজ্ঞরা শিল্পরীতির বিচারে এটিকে গুপ্তোত্তর যুগের বলে অনুমান করেন। 

বীরভানপুরের শঙ্খেশ্বরীতলায় রয়েছে দুর্গাপুরের অন্যতম আকর্ষণ – ব্যাসাল্ট পাথরে তৈরি একটি প্রাচীন সূর্যমূর্তি – একটি অত্যন্ত পুরনো লতানে তমাল গাছের নিচে ৩`৬`` x ২`২`` x ১`৯`` মাপের মূর্তিটি রাখা আছে। মূর্তিটিকে যত্ন নিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে বিভিন্ন ভগ্নাংশ জুড়ে এটিকে একটি সম্পূর্ণ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে – অনুমিত মূর্তির ওপরের অংশটি একটি বিষ্ণুমূর্তির অংশ এবং বাকি অংশটি সূর্যমূর্তির অংশ।

[ঋণ স্বীকার: সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের দুর্গাপুরবাসী, রাজীব গরাই, সন্ধিৎসা সম্পাদক সুভাষ ঘোষাল, ডঃ ত্রিপুরা বসু, রথীন রায়, ডঃ গোপেশ কুমার দত্ত, তারাপদ সাঁতরা, ডেভিড ম্যাকাচ্চন, যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়]

{ছবি সৌজন্যে লেখক স্বয়ং}

(www.theoffnews.com - Durgapur archaeology)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours