সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

আমার বাল্যকালের বন্ধু দোলন। পঞ্চমীর রাত পৌনে দশটা ছুঁই ছুঁই। ঘরে বসে মোবাইল ঘাটছিলাম। কলকাতার অভয়া সংক্রান্ত খবরের লেটেস্ট আপডেট জানতে। ঠিক তখনই হোয়াটসঅ্যাপে একটা ছবি পাঠিয়েছে বন্ধুটি। এক অতি অনাড়ম্বর পুজোর ছবি। আপাতত দৃষ্টিতে বড্ড ম্যাড়মেড়ে। জাঁকজমকের একচুল ছাপ পর্যন্ত নেই পুজোর কোথাও। থাকবেই বা কি করে? সেই সঙ্গতি বা সামর্থ্য যে নেই উদ্যোক্তাদের। অনেকটা অনটনের মধ্য দিয়েই এই পুজোর আয়োজন। মন্ডপের সামনেই কেমিক্যালস ফ্যাক্টরি (ডিসিএল)। রাজ্য সরকারের অধীনস্থ। বছর কয়েক যাবৎ কারখানার কলকব্জাগুলো যেন ধুঁক ধুঁক করছে। উৎপাদন তো অতীতের স্মৃতিহারা মলিন ইস্তেহার। হাতে গোনা  জনা কয়েক শ্রমিকেরাও আজ প্রায় বেরোজগেরে। অন্ন জোগাবে না পুজো করবে? তবু পাড়ার পুজো বলে কথা। বন্ধ করবো বললে তো করাই যায়। কিন্তু ওই যে 'তবু'? এই তবুটার মন তাগিদেই কোনমতে পুজোটা চালিয়ে যাওয়া। বছরের পর বছর।হতাশাগ্রস্ত শ্রমিক থেকে উৎসাহী পাড়াবাসী, বেকার যুবক থেকে অবুঝ বাচ্চারা। সবারই এক রা। পুজোটা যেনতেন প্রকারেণ করতেই হবে। জৌলুসে মারো গোলি। আয়োজনটাই মুখ্য। তা না হলে দুর্গাপুজোর চারদিন সবাই যাবেটা কোথায়? করবেটা কি? ছোট্ট শিশুরা আনন্দই বা করবে কি করে? তাই তো এই পুজোটা আজও বন্ধ হয়নি। গুটি গুটি পায়ে তাইতো পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করেছে এবার। বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের বাহুল্যে। চাঁদার জুলুমবাজির ব্যতিরেকে। স্রেফ সবে মিলি করি কাজ আন্তরিকতার পরম্পরাতে। এই শারদোৎসব।

দুর্গাপুরের কেমিক্যালস কলোনির ইবি টাইপ মহল্লা। চারতলা বিল্ডিং পরপর সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭০ সাল থেকে। আকাশ পানে মাথা উঁচিয়ে। ঠিক তার পাশেই গা ঘেঁষে রয়েছে আর এন দত্ত ঝুপড়ি। অনেকটা জীর্ণতার সাক্ষীতে। কি ভাবছেন? পাশাপাশি ইমারত আর ঝুপড়ি। এতো তেল আর জল। মিশ খায় নাকি কখনও? বাস্তবে এখানে কিন্তু এটাই ব্যতিক্রম। কোয়ার্টারবাস ও ঝুপড়ির সহবস্থান যেন এখানে হরগৌরী মিলনের সার্বিক দৃষ্টান্ত। তাই এখানকার পুজোটাও যতটা বিল্ডিংবাসীর ঠিক ততটাই আর এন দত্ত ঝুপড়ির সহ নাগরিকদেরও। সেই জন্যই এই পুজোর উদ্যোগ পুরোটাই সমবেত। রীতি যাপনের আনন্দটাও একই কারণে সম্পূর্ণ পারস্পরিক ভাগ করে নেওয়ার।

সময়টা ১৯৭৫ সাল। আমার জ্যাঠামনি এলাকায় অনেকের থেকে তখন বয়সে বেশ প্রবীণ। তাই পাড়ার কাকুরা সবাই তাকে একযোগে মুরুব্বী বলে ডাকতেন এবং মানতেনও। তারই সভাপতিত্বে সেবার পুজোর আগে এলাকায় একটা ছোট আকারের মিটিং হয়েছিল। এটুকু মনে আছে সেই মিটিংয়ে হাজির ছিলেন প্রধান কাকু এবং তার দাদা, সাধন বন্দ্যোপাধ্যায় কাকু, কোনার কাকু, সাহু কাকু, চন্দন কাকু, পি কে রায় কাকু, পঞ্চা কাকু, রামেশ্বর কাকু সহ ঝুপড়ি থেকে আগত জনা কয়েক কাকু। অবশ্যই আরও কিছু কাকু সেই আলোচনায় অবশ্যই ছিলেন, যা আজ আর আমার মনে নেই। মিটিংয়ের নির্যাস ছিল এটাই, আর বাইরে গিয়ে আমাদের পুজো দেখা নয়। এবার থেকে এই পাড়াতেই পুজো হবে। ব্যাস যেই ভাবা সেই কাজ। নতুন পুজো কমিটির নামে বিল বই ছাপানো হলো। ডেকরেটর ডেকে প্যান্ডেলের অর্ডার দেওয়া হলো। মূর্তি বায়না করা হলো রাতারাতি। সেকি ব্যস্ততা এলাকার কাকু কাকীমাদের। সবার তৎপরতা দেখে তখন মনে হতো পুজোটা যেন কোনও একটা বৃহত্তর পারিবারিক দুর্গোৎসব। আয়োজনের মাপকাঠি ছোট ছিল ঠিকই। কিন্তু তার উপকরণের ব্যঞ্জনা ছিল সার্বজনীন। অবশেষে একটা নতুন স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে এলাকায় নবরূপে প্রতিষ্ঠিত হলো দশভুজার আরাধনা। যা আজকের ইবি টাইপের পুজো। অর্ধশত কাল বছর ধরে নানা প্রতিকূলতার উৎরাই লঙ্ঘন করে তাই হয়তো আজও মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় উদ্বোধনী প্রদীপটা টিমটিম করে জ্বলেই চলেছে। অদম্য আবেগের সহস্র সহযুদ্ধে। এক একাত্মতার নিরবিচ্ছিন্নতায়। ওই যে একটু আগেই বলেছি, বন্ধ তো করাই যায়। তবু। এই তবুটাই যে এখানকার এলাকাবাসীর পঞ্চাশ বছরের নিরবিচ্ছিন্ন শপথ। পুজো আমাদের চাহিয়েই চাহিয়ে। এবারেও। আগামীতেও।

সে কত কাল আগেকার কথা। গত দুই দিন হয়ে গেছে ডেকোরেটর আমাদের খেলার মাঠে বাঁশ রেখে গেছে। কমসে কম ষাট সত্তরটা তো হবেই হবে। একশো পারও হতেই পারে। সেদিন ভোর চারটের সময় উঠেছি। শরীর চর্চা আর দৌড়াবার নাম করে মাঠে এসে হাজির। ততক্ষণে অন্য বন্ধুরাও উপস্থিত।  সব চুপিসারে কথা বলছি। পাছে বিল্ডিংয়ে কোনও বড়দের ঘুম ভেঙ্গে যায়, এই আশঙ্কায়। আমরাও তৈরি আগের দিন বিকেলের প্ল্যান মাফিক। আর দেরি কেন। শুভস্য শীঘ্রম অপারেশন সাকসেস। মানে ঝপাঝপ গোটা কয়েক বাঁশ ঝেড়ে লুকিয়ে রাখলাম কাছাকাছি ঝোপে। মাস খানেক পড়েই তো সরস্বতী পুজো। ক্লাবের প্যান্ডেল করতে যে লাগবে বাঁশগুলো। সেকারণেই একটু বাঁশ ঝাড়ার কেরামতি আর কি। বাঁশ চুরি প্রকল্পের এই কারবার প্রায় প্রতি বছর চলতো আমাদের যৌবন কালে। মাঝেমধ্যে যে ধরা পড়তাম না এলাকার কাকুদের কাছে এমনটাও নয়। কিন্তু ওই যে চোরা না শোনে ধর্মের কথা। আমাদের হাবভাবটাও ছিল প্রায় ওইরকমই।

আরও একটু ছোটবেলা হবে। বয়স তখন তেরো কি চোদ্দ। পুজোর প্যান্ডেলের স্ট্রাকচার অনুসারে বাঁশ বাঁধা হয়ে গেছে। ত্রিপল টাঙাতে এখনও দু'চার দিন দেরি আছে। পড়াশোনা তখন প্রায় শিকেয় উঠেছে। উফ্ কি মজা। কখন খেলতে যাব এই ভাবনা, সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই আমাকে জাঁকিয়ে বসতো।দেবু, আশিস, টোটা, সাধন, শ্রীরাম, দোলন, আমি সহ আরও অনেকে সেই বাঁশের কাঠামোর উপর কত ঝুলতাম, কত উঠতাম, কত লাফালাফি করতাম। ওই কয়েকটা দিনের জন্য ওই বাঁশের কাঠামোটাই ছিল আমাদের কাছে খেলাধুলার অলিম্পিক স্টেডিয়াম বা বিশ্ব জিমন্যাস্টিকের তাৎক্ষণিক আসর। ওখানেই আমাদের লুকোচুরি খেলা। সেখানেই আমাদের সার্কাস দেখানোর পালা।

প্রথমবারের পুজোর কথা বেশ মনে পড়ে। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। আমি, ভাই, মা, বাবা, জ্যাঠামনি ও কাকু। একসঙ্গে থাকতাম কোয়ার্টারে। সেই বছর আমার ঠাকুরদা মারা গিয়েছিল। ছোটপিসির বিয়েও হয়েছে তার মাস ছয়েকের ব্যবধানে। পড়ে যদিও ওয়েলফেয়ার অফিসার হয়েছিল ঠিক কিন্তু বাবা তখন ওই কেমিক্যাল কারখানার সর্বহারা কমরেড কেরানী মাত্র। একার আয়ে গোটা সংসার। অগত্যা পিসির বিয়ে সম্পন্ন করতে মা তার ষোল ভরি সোনার গয়না তুলে দিয়েছিল বাবার হাতে। হাসতে হাসতে। কিইবা আর করার থাকে। সুতরাং সেবার আমাকে বাবা পুজোয় কিছু কিনে দিতে পারেনি। তাতে অবশ্য বিন্দুমাত্র আক্ষেপ ছিল না। কারণ জ্যাঠামনি আমাকে কিনে দিয়েছিল সাদা হাতকাটা জামা, সাদা হাফ প্যান্ট ও একই রঙের কেডস ও মোজা। ডিসিএল মার্কেটের নির্মলকাকুর দোকান থেকে। ব্যাঙ্কের জমানো তলানি ব্যালেন্সের চেক কেটে। পুজোর সময় কখন যে ড্রেসটা পরবো সেই নিয়েই আমি আনন্দে মেতে ছিলাম বেশ কয়েকদিন। জ্যাঠামনি এগুলো দিয়েছে, এই গর্বেই আমি যেন তখন আত্মহারা। আজ ভাবলে খুব মজা পাই। মনে মনে খুব হাসিও। আসলে অষ্টমীর বিকেলে আমি ওই ড্রেস পরে সবে ঘর থেকে বেরোতে গেছি। মা পরিয়ে দিয়েছিল। আমার মা। প্যান্টের এক পকেটে ক্যাপের তিন চারটে রিল আর অন্য পকেটে টিনের ক্যাপ ফাটানো বন্দুক। সযত্নে রাখা। পাশের বাড়ির দাশগুপ্ত কাকীমা আমাকে দেখেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো, কি সুন্দর লাগছে রে তোকে দেখতে। সব সাদা ড্রেস তোর। অমনি আমি খুশিতে এমন ডগমগ করে উঠেছি যে অদ্ভুতুড়ে কায়দা দেখাতে গিয়ে কাকীমার দিকে বন্দুকে ক্যাপ ফাটাতে ফাটাতে দিলাম মাটিতে বেশ কয়েকটা ডিগবাজি। পরক্ষনেই বুঝলাম আমার সাধের সাদা সমস্ত নতুন পোশাষ মাটির ধুলো ময়লায় একেবারে দফারফা হয়ে গেছে। মাথা থেকে সারা শরীরে ময়লায় একশেষ। সুতরাং কি আর করার। ভাগ্যে জুটলো, তালপাতা পাখার ডান্টির টকমিষ্টি ধোলাই। মায়ের তরফে।

এখানেই শেষ কি করে বলি। কলেজে পড়ি। সেবার পাড়ার কাকুরা বললো, শোন তোরা বড় হয়েছিস। কিছুটা দায়িত্ব নিতে শেখ বুঝলি। অবশেষে সপ্তমীর রাতে ঠাকুর গার্ড দেবার পালা আমাদের উপর বর্তালো। ওই বয়সে এলাকার কিছু দাদা আমাকে তখন ডাকতো কুবুদ্ধির রাজা বলে। খোকনদা তো আমাকে দেখা হলেই ডাইরেক্ট বলতো, কিরে কুবুদ্ধির রাজা কেমন আছিস? রাত গভীর হয়েছে। নিজের নামের সঙ্গে পাড়ায় পাওয়া উপাধির মর্যাদা রাখতেই হয়তো সেদিন দেবুকে আকস্মাৎ বলে বসলাম, হ্যাঁ রে মহিষাসুরের গোঁফটা যদি দুর্গার মুখে লাগিয়ে দেওয়া যায় তবে কেমন মজা হবে বল তো? আর যায় কোথায়। টেক ইমিডিয়েট অ্যাকশন। মহিষাসুরের মুখ থেকে সযত্নে গোঁফ তুলে নিলাম আমি আর ধনা। শরীরে বয়স আন্দাজে লম্বা থাকার সুবাদে সেটা আঁঠা দিয়ে দেবু জুড়ে দেয় দুর্গার মুখমন্ডলে। একেবারে নিপুণ ভাবে। এবার ভেজা বেড়ালের মতো অষ্টমীর সকাল থেকেই মন্ডপে ঘুরঘুর করছি আমরা। যেন কিচ্ছুটি জানি না, বডি ল্যাঙ্গুয়েজটা এমন রাখার প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি সবাই। প্রতি মুহূর্তেই ভাবছি, এই বুঝি বম্ব বাস্টিং কিছু ঘটবে। আমরা যে তারই মজা লোটার দীর্ঘতর অপেক্ষায়। একটু পড়েই সন্ধিপুজো হবে। পুরোহিত উপস্থিত। কাকু কাকীমা ছেলে মেয়ে আসতে আসতে জড়ো হচ্ছে। আচমকা পঞ্চা কাকীমা লক্ষ্য করে বলে ওঠে, দেখো দেখো দুর্গার মুখের অবস্থা দেখো। পাশের আরেক কাকীমা বলে উঠলেন, এমা মহিষাসুরের গোঁফটা গেল কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে তা দেখে নন্দীকাকু বলে উঠলো, কে রে দুর্গার মুখে গোঁফ লাগিয়েছে? এই বলে বিশুদ্ধ (?) ভাষায় যা মুখে আসে তাই বলে ঝড় তুলে ছেড়েছে সমস্ত এলাকা জুড়ে। হৈ চৈ লেগে গেছে। কেউ হাসছে। কেউ গালমন্দ করছে। আবার অনেকে চুড়ান্ত সমালোচনা করছে উচ্চ স্বরে। আমরা বুঝে গেছি ফুল ফ্লেজে রিঅ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। আমরাও আবার সেই আগুনে একটু ঘি ঢেলে বললাম, আমরা রাতে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ তো সবই ঠিকঠাক ছিল। আমরা চলে যাবার পর এটা যে করেছে সে খুব অন্যায় করেছে। তলে তলে তো আমরা খুব হাসছি। নিপাট ফিচেল মুচকি হাসি যাকে বলে। একটু পরে দেখি সামনের মোড়ে প্রধানকাকুর সঙ্গে কথা বলছে দোলন আর বীড়া। আর বুঝতে বাকি রইল না প্রধানকাকুকে এরা আমাদের কুকীর্তি সব ফাঁস করে দিয়েছে। ঠিকই তাই। প্রধানকাকুও লাফাতে লাফাতে তীরের গতিতে এগিয়ে আসছে মন্ডপের দিকে। আর ডাকছে আমাদের তিনজনের নাম ধরে। বিপদ বুঝেই আমরা ক্লাবের পিছনের ঝোপে লুকিয়ে পড়ি তৎক্ষণাৎ। কিন্তু উনি ঠিকই খুঁজে বার করলেন। আর প্রচন্ড বকাবকি শুরু করলেন। কাকীমারা হাসতে হাসতে সস্নেহে বললেন, তোরা তো বড় হয়েছিস। এগুলো কেন করিস বলতো? এমন কখনও করবি না বুঝলি। এসব করতে নেই। সেদিনের কথা আজও মনে পড়ে। এলাকার কাকু কাকীমারা আমাদের নিজের সন্তানের মতো বকতেন, শাসন করতেন, শুধরে দিতেন কিন্তু কখনও ক্ষতি করতেন না। এটাও এখন ভাবি মনে মনে, এসব যদি আজ ঘটতো? হয় ধর্মীয় গোষ্ঠীর তুলকালাম মারদাঙ্গা ঘটতো, কিম্বা রাজনৈতিক সংঘাতে রক্তগঙ্গা বইতো। ধরা পড়লে গণধোলাই তো অবশ্যই জুটতো কপালে। পরিশেষে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হতো দোষীর তকমা। একটা ভুলের জন্য অভিযুক্ত হিসেবে জীবনটাই তছনছ হয়ে যেত অপরাধীর পরিচয়ে (সতর্কীকরণ: এখনকার সময়ে এমন গোঁফ প্রাসঙ্গিক এই কুকর্ম একদম করা অনুচিত। এমনকি আইনের চোখেও এটা গর্হিত অন্যায়)। তবু সেদিন কিভাবেই না পরম মমতায় বড়রা সব সমস্যা মিটিয়ে নিয়েছিলেন অতি অল্প সময়ে। ক্ষণিকের মধ্যে গোটা অ্যাম্বিয়েন্সটাই অদ্ভুতরকম স্বাভাবিক হয়ে গেল। হট্টগোল যেন দূর অস্ত। গোঁফ স্বস্থানে বিরাজ করলো স্বমহিমায়। সন্ধি পুজোর ঢাকের উচ্চ দামামা, আপন তাল ফিরে পেল নিজস্ব ঢঙে। আমরাও পুজোর তদারকিতে যোগ দিলাম যথারীতি। এটাই হলো সেকালের পুজো আর একালের পুজো। সেকালে পাড়ার কাকু কামীমারা ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই আমাদের অভিভাবক। আমরা অন্যায় করলে তারা বকতেন, শুধরে দিতেন, শাস্তিও দিতেন অল্প স্বল্প। নিজেদের সন্তান ভেবে। আর বর্তমানে কোনও পুজোয় পান থেকে চুন খসলেই শুরু হয় রাম, বাম, ঘাস, হাতের পথসভা কিম্বা নিদেন পক্ষে বোমাবাজি। উদ্যোক্তাদের পুলিশি আস্ফালন। ধর্মীয় টিকি দাড়ির দুর্ণিবার ধমক চমক। ধৃতদের আদালতে চালান করে তবেই না খানিক নিশ্চিন্তি। স্লোগান উঠতো এলাকায়, ওরা আসলে সমাজবিরোধী তাই এরকম অপকর্ম করেছে। গালমন্দ দিয়ে বলতো, দেখ কেমন লাগে পুজোর সময় জেলের ভাত খেতে। যুগও পাল্টেছে। ভাবনার ফারাকটাও ডিজিটাল হয়েছে। কর্পুরের মতো আমাদের বিবেকটা আসলে বিলীন হয়ে গেছে কোনও এক অজানা উজানের বড় আর ছোটদের সুসম্পর্কে।

আমরা সেসময় কৈশোরে হাবুডুবু খাচ্ছি। তখন ওই পুজো ছেড়ে কোথাও যেতে চাইতামই না। মন চাইতো না অন্যত্র যেতে। মা বলতো চল এবারের পুজোয় রাঁচীর মামাবাড়ি যাবো। আমিও না না যাব না বলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিতাম। দিনরাত। আসলে পুজোর কটা দিন এখানে যে সন্ধ্যায় ধুনোচি নাচ হবে। নানান প্রতিযোগিতা হবে। ক্যুইজ থেকে মোমবাতি জ্বালানো, শঙ্খ বাজানো। ক্যুইজে কখনও কখনও প্রাইজ পেলেও ধুনোচি নাচের প্রাইজ কোনও বছর কপালে জুটতো না। তবু নাম দেওয়া চাই হরবার। ধুনোচি নাচে প্রাইজ যে পেতাম না সেই আক্ষেপটা আমার আজও রয়ে গেছে। আদতে ছেলেবেলাটা এমনই হয়। কখন ভোলা যায় না। তার নানার অদ্ভুতুড়ে রেশগুলোকে। বেঁচে থাকার অবসরে কখনও কখনও তা ঝিলিক মারবেই মনের কাল্পনিক আকাশে। নক্ষত্র পতনের অনুকরণে। বারংবার। দোলন, দেবু, লাল্টু, ভোঁদারা সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রাইজটা পাবেই পাবে। একবার দীপক তো এমন নাচলো যে সেই নাচ দেখে পাড়ার এক বোন মুগ্ধ হয়ে তার গার্লফ্রেন্ড হয়ে গেল রাতারাতি। ও লাভলি, দীপকের ভাগ্য বটে। আমার আর কিইবা করার ছিল। প্রাপ্তি বলতে নাচের শেষ একটু হাঁপানো সঙ্গে কপালে জমাট ঘাম আর একটা ফোকটা সান্ত্বনা পুরস্কার। কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা। পুজোতে সেখানেই থেকে যাওয়া। বরাবর। সে যেভাবেই হোক না কেন। পরেরবার আবার ধুনোচি নাচে অংশ নেওয়া। সেবার হয়তো সান্ত্বনা পুরস্কারও পেতাম না। তখন খুব রাগ হতো মনে মনে, ধূর এবারও পুরস্কারটা হাতছাড়া হয়ে গেল। ঠিক আছে বস্ পরের বার দেখিয়ে দেবো সবাইকে, ধুনোচি নাচ কাকে বলে? এই ভেবে ঘরে একা একা আয়নার সামনে নেচেও নিতাম কয়েকবার।

বাবা কারখানা থেকে অবসর নিল ১৯৯৪ সালে। নিয়ম মেনে কোয়ার্টার ছাড়তে হলো এপ্রিল মাসে। বছর দুয়েক হলো ততদিনে মা মারা গেছে। সপরিবারে আমরা চলে গেলাম দুর্গাপুরের অন্যত্র। সেবারও এই পুজোতে এসেছিলাম। চারটে দিনই। সাইকেল  চালিয়ে। দাশগুপ্ত কাকীমা বললো, অ্যাই শোন যাবার আগে আমাদের বাড়িতে এসে খেয়ে যাবি। মন ভরে খেলাম ঠিকই। তবু কোথাও যেন মনে খটকা লাগতো। নিজেকে মনে হতো বাইরে থেকে আসা অতিথি। আপনজন নয়। সবাই মনপ্রাণ ভরে আপ্যায়ন করতে খামতি রাখতো না আমাকে। আসলে ওই বাড়তি অ্যাপায়নটাই আমাকে পরতে পরতে ভাবাতো, আমি এখানে এবার থেকে যে বহিরাগত। চব্বিশ চব্বিশটা বছর টানা যেখানে থেকে গেছি এই মাঝের বিল্ডিংয়ের এক তলায়। কই বিগত বছর গুলিতে তো কেউ আমাকে বাড়তি স্বাগত জানাতো না। আসলে এটা কারও দোষের নয়। হয়তো এটাই সামাজিক সৌজন্যতা। তবু কালের নিয়মে ও পরিস্থিতির পরিবেশে মানুষকে আপন থেকে হঠাৎ একদিন পর করে দেয়। সামাজিক যাত্রাপথে এভাবেই হয়তো এগিয়ে যেতেই হয় সবাইকে। কোনও না কোনও পর্যায়ে। অব্যক্ত বেদনাদায়ক হলেও এই অঘোম নিয়তি মেনে যে নিতেই হয়। আমাদের। অনিচ্ছার আপ্তদ্বন্দ্বে।

বয়স যত গড়িয়েছে, ওই পুজোয় আমার অনুপস্থিতি ততই অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল একদা। প্রথম প্রথম স্থানীয় বন্ধুরা অনুযোগ করতো, কি রে এবারের পুজোয় এলি না কেন? একসময় তাও স্তব্ধ হয়ে গেল একদিন। অচিরেই। তবু কোনও কোনও বছর যেতাম সেই পুজো দেখতে। সপরিবারে। সংসারীর বেশে। কিছুটা হলেও অতীতের ফেলে আসা ধূসর আবেগকে নতুন করে খুঁচিয়ে তোলার একরোখা নব্য উৎসাহে। পুজোটা দেখতাম। প্রসাদও খেতাম। কিন্তু প্রতিবারই অনুভব করতাম সেদিনের চেনা চেনা মানুষগুলো কেমন যেন মন্ডপ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। কই আর দেখা পাই না। তাদেরকে? কোথায় গেল সব? সবাই কে কেমন যেন ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল। বুঝি বুঝি, কেউ মাটির মায়া কাটিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। অনেকে তো পৃথিবীর মায়াটাই কাটিয়ে দিয়েছে চিরতরে। এসব ভাবলে, মনটা হু হু করে উঠতো তখন। আসলে চেনা মানুষের রাত্রি অবসানে ভোরের নতুন মানুষের আগমন তো ঘটবেই। এটাই তো কালের যাত্রার ধ্বনির অনিবার্য দস্তুর। প্রতিমা দর্শন শেষে ফিরে যাবার সময় একটাই মনে হতো, এটাই তো ছিল একদিন আমার কাছে বিশ্ব চরাচরের সেরা আপনতর প্রাণময় পুজো। অথচ এখানে আমি আচমকাই কেমন যেন অচেনা হয়ে গেলাম সময়ের বিবর্তনে। চোখের গোপন অশ্রু ভেজা দৃষ্টিতে কেমন যেন আবছা হয়ে আসে ফেলে ফেলে আসা নিজস্ব অতীতগুলো। সেই ট্রাকে চেপে প্রতিমা আনতে যাওয়া। নিরঞ্জনেও ঢাকের তালে নাচের তালে এগিয়ে যাওয়া। আসছে বছর আবার হবে অসীমের প্রত্যাশায়। হায় রে আমার অচেনা আসছে বছর!

বয়সের ঘোড় দৌড়ে আজ আমি ছয় দশক পেড়িয়ে এসেছি মাস ছয়েক হবে। চতুর্থীর সন্ধ্যায় ঠাকুর দেখতে বেড়িয়েছিলাম অটোতে চেপে। কলকাতার রাস্তা বলে কথা। ভিড় যেন থিকথিক করছে। মন্ডপে প্রবেশ করতেই সেকি জনজোয়ার। হাঁটা দায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ষষ্ঠীর সন্ধ্যাতেও নানা মন্ডপ ঘোরাফেরা। শুধুই জনমানুষের নিরন্তর ঢল। আলোকসজ্জায় ঝলমল রঙিন আবহ। প্যান্ডেলের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে দৃষ্টিনন্দন আভিজাত্য। প্রতিমায় থিমের অত্যাধুনিক ফিউশন। এবারেও সশরীরে দেখলাম তেমনই কিছু অভিনবত্বের ঠাকুর। ইতিমধ্যের ফাঁকে ফাঁকে মহানগরীর কিছু অলিতে কিছু রাজপথে। স্বাভাবিকভাবেই মনের থরে থরেও লেগেছে ভাসা পালকের মতো নম্র খুশির ছোঁয়া। কিন্তু যেই মেঘের বজ্রঘন ঝিলিকের অনুররণে হৃদমহলে মনে পড়ে বহু বছরের ফেলে আসা আমার সেই সেই সেই অতি সাধারণ পুজোটার নানান উপকথা। তখনই মনে হয় বালিগঞ্জের খ্যাতনামা রেস্টুরেন্টে জমাটি খাবার তো খেলাম জুৎ করে। কিন্তু গৃহসখার হাতের তৈরি ওই যে আমের চাটনিটা। সেটাই তো হাজার ব্র্যান্ডেড খাবারের নিরিখেও প্রকৃত মধুরেণ সমাপয়েৎ। ইবি টাইপের পুজোটাও আমার কাছে তাই। আজও এর অনুভূতি একইরকমের। পরম মধুময় তামরস সম। অনেক অনেক দূরে বসবাস করেও। এ'জীবনে কম তো পুজো দেখিনি। নিজভূমে। পরভূমে। সহস্রাধিক। কিম্বা সংখ্যাটা তারও অধিক। আমার মননে সেগুলোয় শারদোৎসবের আগমন ঘটে। কিন্তু আমার ওই পুজোয় শারদোৎসবের আগমনী ঘটে। আমার ভাবনায় সেগুলোয় দেবী দর্শন হয়। কিন্তু আমার ওই পুজোয় দেবীর আরাধনা হয়। আমার কল্পনায় সেগুলোয় সন্ধি লগ্নের পুজো চলে আসছে। কিন্তু আমার ওই পুজোয় পুজোর লগ্নে সন্ধি চলে আসছে।

আজও এই বয়সেও খুব খুব মনে হয় ছুটে যাই আমার ওই ছোট্ট অখ্যাত পাড়ায়। যেখানে তিল তিল করে বড় হয়েছি। শৈশবস্থা থেকে। ঠিক সেইখানে। যেখানে পুজোর উপাচার হয় না। হয় উপাসনা। বিজ্ঞাপনের দাপট থাকে না। থাকে নিখুঁত আয়োজনের উন্মাদনা। এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি হয়তো। বাস্তবতার জটিল তত্ত্ব মেনে যদিও বা যাওয়া আর আমার হয়ে ওঠে না সেখানে। পরপর বহু বছর। কিছুটা হয়তো ইচ্ছে করেই। কারণটা রবিঠাকুরের বাণীই তার সাক্ষ্য দেয়। 'মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া, এই দুইয়ের তফাৎ আছে।'

আসলে ওই পুজোর শিশির ভেজা শিউলি মাখা গন্ধ এখনও আমার মনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম শারদ শিরোপা। কিন্তু সেখানে গেলেই নিজেকে বড্ড অচেনা লাগে। ভীষণ অপরিচিত লাগে। নিজস্বতার আমিত্বকে। এটাও যে মেনে নিতে পারি না এই বয়সে এসে। জীবনের ষাটতম আশ্বিন পরিক্রমায় পঞ্চাশ বছরের শারদোৎসব বলে কথা। 'তবু ভরিলো না চিত্ত' নামক জীবন পান্থশালায় এমন শারদীয় অভিযাত্রায় ক্ষণিকের আত্মিক দ্বন্দ্ব তো থাকবেই।

অগত্যা, শরীরী ভাষায় বাবুই পাখির বাসা সযত্নেই থাকুক না হয় তিলোত্তমার কংক্রিট বেসমেন্টে। মন যাযাবর ততক্ষণে সোয়ালো পাখি হয়ে উড়ে যাক ইবি টাইপ মন্ডপের কোনও এক নির্জন কোনে।

(www.theoffnews.com Saradotsav Durga puja)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours