সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:
নন্দীগ্রাম তখন রক্তস্নাত। বুদ্ধদেব তখন ওরা আমরার রনংদেহী স্রষ্টা। মমতাও যে বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদেনী। বুদ্ধ বলতে বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্র বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যিনি গতকাল প্রয়াত হয়েছেন। আর মমতা বলতে বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি বর্তমান বঙ্গের প্রশাসনিক প্রধান। মাঝের সময় ভূমিতে বয়ে গেছে কত কত ঘটনা প্রবাহের উথালপাথাল অনিবার্য রাজনৈতিক স্রোত।
সেই সময় আমি কর্মরত আনন্দবাজারে। দুর্গাপুর ব্যুরোর সাংবাদিক হিসেবে। আমাদের উপর কড়া অলিখিত নির্দেশ ছিল পত্রিকার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের, যা ঘটবে ঘটুক, যত রক্ত ঝড়বে ঝড়ুক, কিন্তু কোনও ভাবেই বামফ্রন্টের চলমান শিল্পনীতির বিরুদ্ধে একটা অক্ষরও লেখা যাবে না খবর লেখার সময়। আনন্দবাজারের এই 'সত্যকে অস্বীকার করে খবর পরিবেশন' এর মাশুলও গুনতে হয়েছে অনেক। তাৎক্ষণিক ভাবে। এক ধাক্কায় পেপারের সার্কুলেশন নেমে আসে কল্পনাতীত পর্যায়ে। রাতারাতি। আমাদের অভ্যন্তরীণ মিটিংয়ে খবর বিভাগের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক থেকে স্বীকারও করে নেওয়া হয়েছিল, আমাদের গৃহীত লাইন ভুল। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের নার্ভ নিরপেক্ষ সংবাদ প্রত্যাশা করছে আনন্দবাজারের মতো গৌরবান্বিত পত্রিকার কাছ থেকে। তবুও বাংলার পুঁজিনিবেশের কথা ভেবে সেই সময় বামফ্রন্টকে খুল্লাম খুল্লা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে ছিল আনন্দবাজার। সেই নির্ভেজাল সমর্থন এতোটাই গভীরে পৌঁছে ছিল যে বুদ্ধদেবকেও ক্ষেত্র বিশেষে সেন্সরড করতে দ্বিধা করেনি তখনকার পত্রিকা সম্পাদকের নিজস্ব কোটারী।
সেই অপ্রকাশিত ঘটনার কথা আজকে প্রথম প্রকাশ্যে বলতে খুব ইচ্ছে করছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই গোপন কাহিনী হঠাৎ এতকাল পরে এখনইবা কেন প্রকাশের বাসনা?
আসলে বুদ্ধদেববাবু গতকাল মারা গেছেন। ওই সময়ের সিপিএমের দাম্ভিকতার তীব্র বিরোধিতা করলেও তথাপি আমি বুদ্ধদেববাবুর শিল্পনীতির চরম সমর্থক ছিলাম। কারণ বাংলার হাল যখন তিনি ধরেন তখন সিপিএমের জঙ্গি আন্দোলনের কুফলে বঙ্গ জুড়ে সৃষ্টি হয়েছিল শিল্প বন্ধ্যা। এটা এককথায় মানতেই হবে রাজ্যবাসীকে, বুদ্ধদেবের জমানায় যা শিল্পধর্মী পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছিল তা বিধানচন্দ্র রায়ের শাসনকালের পরবর্তী সময়ে, এই কৃতিত্বের দৃষ্টান্ত আর দ্বিতীয়বার ঘটেনি এযাবৎ। তাই বুদ্ধদেব ছিলেন আমার মনের শ্রদ্ধার আসনের এক অনন্য আইকন। চোখের সামনে দেখেছি মৃত শিল্পনগরী দুর্গাপুরকে কিভাবে তিনি পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। একদম নিজস্ব মুন্সীয়ানায়। তাই তাঁকে একদা সবার অলক্ষ্যে সেন্সর করা হয়েছিল এটা আমি সেদিন কেন আজও মেনে নিতে পারিনি। আজ তিনি নেই আমাদের মাঝে। তবু তাঁর নিখাদ সততার স্বপ্নময় শিল্পনীতির বিষয়ে কিছু একটা অক্ষর চাষ করতে আজ মনটা খুব ছটপট করছে। কি লিখি তাই ভাবছি সকাল থেকে। সবই তো সবার জানা। নতুন আর কিইবা লিখি, এমনটাই ভেবে কূল পাচ্ছি না। হঠাৎ মনে পরে গেল এই সেন্সরডের কথাটা। তাই আগোছালো ভাবেই আর দ্বিতীয় কিছু না ভেবেই আমার এই লেখার প্রচেষ্টা মাত্র।
সময়টা ২০১০ সাল। তখনও বিধানসভা নির্বাচন হতে এক বছর বাকি। বিভিন্ন শিল্প বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের কর্মযোগ্যে তিনি তখন এই শিল্পতালুকে হরদম যাতায়াত করতেন খানিকটা ডেলি প্যাসেঞ্জারের মতো। আমরাও তাঁকে প্রায় প্রতিবারই ছেঁকে ধরতাম। স্কুপ খবরের তাগিদে। এদিকে রাজ্য জুড়ে তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। মমতার সিঙুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তোলপাড় সারা রাজ্য। সত্যকে অস্বীকার না করেই বলবো, সেদিন আমিও মনেপ্রাণে ব্যক্তিস্তরে পরিবর্তনপন্থী ছিলাম। একইসঙ্গে বুদ্ধদেবের শিল্পায়ণের অন্ধ সমর্থকও ছিলাম একজন সাংবাদিক হিসেবে।
এমনই একদিন সকালে বুদ্ধদেববাবুর কলকাতা থেকে সড়কপথে দুর্গাপুর আসার কথাও। আমরা সব সাংবাদিকেরা নির্দিষ্ট গেস্ট হাউসে অপেক্ষা করছি। একাংশ প্রশাসনিক আধিকারিকেরাও যথারীতি হাজির সেখানে। তখন আমার সঙ্গে দুজন সহকর্মী চিত্র সাংবাদিকও সেখানে অপেক্ষারত। হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠলো। মোবাইলে ভেসে উঠলো রাজ্য পুলিশের এক অন্যতম উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তার নাম। ফোন ধরতেই তিনি আমাকে অফ দি রেকর্ড বললেন, "মুখ্যমন্ত্রী ট্রেনে আসছেন। একদম শেষ মুহূর্তে উনার গাড়ির সফর বাতিল করা হয়েছে। নিরাপত্তার কারণে। চ্যাপ্টারটা কিন্তু খুবই গোপনীয়।" ফোন বন্ধ করতেই বুঝলাম ট্রেন দুর্গাপুর আসতে মিনিট কুড়ি বাকি। এটাও অনুধাবন করেছিলাম, উপস্থিত কোনও সাংবাদিক উনার ট্রেনে আসার খবরটা এখনও কেউ পায়নি। আমি তাই সবার কাছে টয়লেট যাবার নাম করে একটু দূরে সরে গিয়ে আনন্দবাজারে কর্মরত একজন চিত্র সাংবাদিককে সেখানে স্ট্যান্ড বাই রেখে অন্যজনকে ইশারায় কাছে ডেকে নিলাম। চুপচাপ কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চললাম রেলস্টেশন দুজনে। নিজস্ব গাড়িতে। বিষয়টা এতোটাই গোপনীয়তা রক্ষা করেছিলাম তখন যে সঙ্গের সঙ্গীকেও পথিমধ্যে কিছু বলিনি। যদিও সে হতবাক হয়ে আমার কাছে বারবার জানতে চাইছিল, আমরা কোথায় ও কেন চলেছি এভাবে।
যাইহোক, অবশেষে সকাল নটার কাছাকাছি সময়ে দুর্গাপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বুদ্ধদেববাবু পা রাখলেন। আমিও তাঁর কাছে যাবার চেষ্টা করছি। কিছুটা জবরদস্তি করেই। এদিকে নাছোড় উনাকে বৃত্তাকারে ঘিরে থাকা কর্মরত সুরক্ষাকর্মীরা। এটা দেখেই আমাকে উনি চিনতে পারলেন। এর আগে বহুবার উনার প্রেস ব্রিফিংয়ে সামনাসামনি উপস্থিত থাকার সুবাদে। বললেন, "আপনি তো আনন্দবাজারের সাংবাদিক। উনাকে আসতে দিন।" যতক্ষণে কাছে এলাম তখন আমরা সবাই সিঁড়ি বেয়ে উঠছি। উনিও তরতরিয়ে উঠছেন। বুঝলাম হাতে সময় নেই সাংবাদিক হিসেবে উনাকে একা এভাবে পাওয়ার। মওকা বুঝে সরাসরি তাই প্রশ্ন করলাম। কাটোয়ার প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কি? উনি তখন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, "স্থানীয় মানুষ জমি না দিলে বিদ্যুৎ কারখানা হবে না। চেষ্টা চলছে প্রশাসনের তরফে। জমি মালিকদের বোঝানোর। কিন্তু নেতিবাচক রাজনীতি মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছে। যাঁরা আত্মঘাতী হতে চায় সেখানে কিছু হবে না। কাটোয়াকে বাদ দিয়েই শিল্পায়ন চলবে। স্থানীয় মানুষ না চাইলে কাটোয়াতে বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়বো না।"
এমন এক্সক্লুসিভ ক্যাচলাইন বুদ্ধদেববাবুর কাছে পাবো, আমি ঘুণাক্ষরেও আশা করিনি। খুব খুশি মনেই আমি খবরটা লিখেছিলাম যে কাটোয়ার বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে আসতে আগ্রহী হতাশ বুদ্ধদেব। ভাবলাম পরের দিন সবাইকে হতবাক করে খবরটা প্রকাশিত হবে। কিন্তু সন্ধ্যা গড়াতেই আশার থালায় পড়লো নিরাশার ভাত। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ আমাকে কলকাতা অফিস থেকে আমার উর্ধ্বতন বস্ (যিনি গত বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর হয়ে কিছু ভিডিও ইন্টারভিউ নিয়ে ছিলেন একাধিক সেলিব্রেটিদের।) ফোন করে বললেন, "সুবীর তুমি একি কপি পাঠিয়েছো। এর জন্য তোমার চাকরি তো যাবেই একইসঙ্গে আমার চাকরিও আর থাকবে না কাল সকাল থেকে। এই খবর ছাপা সম্ভব নয়।" তৎক্ষণাৎ আমি বিণীত প্রতিবাদ করে বললাম, "এটা আমার বহু কষ্টের অর্জিত এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ। খবরটা এযাবৎ কোনও মিডিয়া পায়নি। এটা তো আক্ষরিক অর্থেই নির্ভেজাল খবর।" প্রতুত্তরে বললেন, "আজ সন্ধ্যাতেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে প্রেস কনফারেন্স করেছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। তিনি বলেছেন, "কাটোয়াতে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে হলেও বিদ্যুৎ কারখানা নির্মাণ করা হবেই।" সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, "তাতে কি হয়েছে দুটো খবরই ছাপা হোক। কিন্তু আমার অনুরোধে সায় দিলেন না আমার বস্ সেদিন। তিনি বললেন, "মানছি খবরে যা লিখেছো তা তোমাকে বুদ্ধদেববাবু অক্ষরে অক্ষরে সেটাই বলেছেন। কিন্তু এটাতো সিপিএমের পার্টি লাইন বিরোধী বক্তব্য। বিমানবাবুর বক্তব্যে তা পরিস্কার। কাল খবর প্রকাশিত হবার পর পার্টির চাপে মুখ্যমন্ত্রী যদি পাল্টি খান তখন তুমি কি জবাব দেবে? যদি উনি আগামীকাল ব্রিফ দেন, আমার বক্তব্যকে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তখন তো পেপারের সম্পাদকের মুখ পুড়বে।" আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, "তাই বলে বুদ্ধদেববাবু প্রকাশ্যে মিথ্যা কথা বলবেন, এটা আমি কল্পনাও করতে পারছি না। আমি সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে বলছি, আপনারা খবরটা প্রকাশ করার জন্য আরও একবার রিথিঙ্ক করুন। ফোনের ওপার থেকে এবার ভেসে এলো, "খবরটা অভীকবাবু নিজে দেখেছেন। উনি বারণ করেছেন এটা ছাপতে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী এমন কথাই তোমাকে বলেছেন মানছি, তবু তাঁর বক্তব্য পার্টি লাইনের বিরুদ্ধে। তাই শিল্পায়ন বিরোধী কোনও খবর আনন্দবাজার এই মুহূর্তে প্রকাশ করবে না। আমাদের স্ট্যান্ড তো তুমি ভালো ভাবেই জানো।" রাগে দুঃখে আমি বলেই দিলাম, "আমি এমন একটা পেপারে কাজ করছি যেখানে মুখ্যমন্ত্রীর এক্সক্লুসিভ বক্তব্য সম্বলিত সত্য খবরের কোনও মূল্য নেই। আমাদের পেপারটা কি সিপিএম পার্টির মুখপত্র? শেষে আপনারাও কিনা বুদ্ধবাবুকে সেন্সরড করলেন?" ফোন ছিন্ন হবার আগে বস্ স্বগতোক্তি করলেন, "তোমার মতো একজন সাংবাদিক হয়ে আমারও এসব বলতে খারাপ লাগছে। আমার কিছুই এখানে বলার নেই। হুকুম যে আমাকে মানতেই হবে। সরি সুবীর।"
সরি বুদ্ধদেববাবু আপনার কাছেও। সেদিন ভরসা করে কাছে ডেকে আমাকে একান্তে একটা স্কুপ লাইন দিয়েছিলেন। যেটা কর্মসূত্রে আমার আবদ্ধ তদানীন্তন পত্রিকা ছাপলো না ওইদিন। আপনার ঘোর সমর্থক হয়েও আপনাকে বিশ্বাস করতে পারেননি পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। আপনাকেও সেন্সরশিপ থেকে তাই রেহাইও দেননি সেদিনের আনন্দবাজারের কর্তাব্যক্তিরা। অথচ সেদিন যে আপনি কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সত্য নির্ভর ছিলেন তা কাটোয়ার ওই জনপদ আজও চুড়ান্ত সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে নির্জন একলব্যের অনুকরণেই।
(www.theoffnews.com Buddhadeb Bhattacharjee Anandabazar Patrika)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours