রূদ্রাণী মিশ্র, লেখিকা ও কবি, কলকাতা:
আবোল তাবোল কথাটির মধ্যেই আছে অদ্ভুত বা অসম্ভব কথা গুলো। কিন্তু জানেন তো, এই ভুলভাল' কথার মধ্যে অনেক কঠোর সত্যি ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকে। সুকুমার রায়ের আবোল তাবোলেও এরকম সত্যি কথাগুলো লুকিয়ে রয়েছে।
আচ্ছা বিশদে যাওয়ার আগে, একটু দেখা যাক, এই আবোল তাবোলের উৎপত্তি সুত্র। এই লেখা তিনি প্রকাশিত করেছিলেন, উপেন্দ্রকিশোর রায়ের প্রকাশনা U. Ray and sons থেকে প্রকাশিত সন্দেশ পত্রিকায়। গুগল বাবাজি এই নামের ব্যাখা করতে গিয়ে বলেছেন, The weird and absurd - Nonsense rhymes. গুগল কিছু ভুল বলেনি। এটি একশো ভাগ অদ্ভুত এবং অ্যাবসার্ড। তবে একথা বললেও ভুল হবে না, তিনি ইংরেজি ননসেন্স লেখা থেকে কিছুটা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বিশেষ করে, Edward Lear আর Lew's carrol থেকে। তার একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে। তাঁর লেখা হ-য-ব-র-ল ছড়া ক্যারলের "Alice in wonderland" গানটি থেকে দৃশ্যত অনুপ্রাণিত বলে বোঝা যায়।
আবোল তাবোল ছড়াগুলো যে শুধুমাত্র ছোটদের জন্য নয়, এবং তার মধ্যে প্রকৃত উদ্দেশ্যগুলি ছদ্মবেশে লুকিয়ে রয়েছে। তা এতক্ষণে একটু বোঝা গেছে। তাই এই ছড়াগুলোর অন্তনির্হিত অর্থের সন্ধান করতে গিয়ে, আমরা এর মধ্যে কতগুলো ভাগ খুঁজে পাই। সেই ভাগগুলো হল:- ১) সামাজিক, ২) রাজনৈতিক, ৩) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ৪) গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী, ৫) অন্যান্য। এবার এই ভাগগুলো নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করা যাক।
১) সামাজিক :- প্রথমেই এই পর্যায়ের বিশ্লেষণ করার জন্য, খিচুড়ি ছড়াটির উল্লেখ করতে পারি। হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল “হাঁসজারু” কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে – “বাহবা কি ফুর্তি!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।” এর মধ্যে আমরা পাই একটি প্রাণীর সঙ্গে আরেকটি প্রাণীর মিলনের ফলে অদ্ভুত এক চেহারার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ তাদের রূপ খাসা। এখানে মনে করা হয়, তিনি বলতে চেয়েছেন, ইংরেজদের নকল করতে গিয়ে বাঙালি নব্য শিক্ষিত সমাজ নিজেদের হাসির খোরাক বানিয়েছে। আবার দেশীয় পণ্যের উপকারিতা বোঝাতে তিনি লিখেছেন,
"গাছ গাছালি শেকড় বাকল মিথ্যে সবাই গেলে,
বাপ্রে বলে পালায় ব্যামো ছায়ার ওষুধ খেলে।
নিমের ছায়া ঝিঙের ছায়া তিক্ত ছায়ার পাক,
যেই খাবে ভাই অঘোর ঘুমে ডাকবে তাহার নাক।" আবার দেখা যায়, বাঙালি ঝগড়া করার সময় যে ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশিয়ে কথা বলে, তিনি তা নিয়েও তিনি মজা করে লিখেছেন। "ক্যানরে ব্যাটা ইস্টুপিড …"
২) রাজনৈতিক:- সুকুমার রায়ের রচিত, এই ধরনের ছড়াগুলোতে আমরা প্রচ্ছন্ন ভাবে ব্রিটিশ সরকার, জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ আর সরকারি নানান ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর ছড়ায় তুলে ধরা মতামত পাই। যেমন তাঁর ছড়া 'একুশে আইন' -এ তিনি বলেছেন।
শিব ঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছ্লে প'ড়ে
প্যায়দা এসে পাক্ড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার—
একুশ টাকা দণ্ড তার ৷
এটি ইংরেজদের প্রণোদিত রাওলাট এ্যাক্টের বিরোধিতা করে লেখা। এ প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটলের একটি উক্তি তুলে না ধরলে, কথাটা পুরো বলা হবে না। 1941 সালে, Arristotol বলেছিলেন "... a jest is a kind of mockery, and lawgivers forbid some kind of mockery – perhaps they ought to have forbidden some kind of jesting. তাঁর রচিত ট্যাঁশগরু, কুমড়োপটাশ এসবই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা। তাঁর কুমড়োপটাশ ছড়াটিতে তিনি ১৯১৬ সালে ভারতে ভাইসরয় হয়ে আসা, লর্ড চেল্মসফোর্ডকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন। তবে শেষে তিনি একথা বলতেও ভোলেননি, তাঁর ক্ষমতাকে তাচ্ছিল্য করা উচিত নয়। তাই তিনি বলেছেন।
"তুচ্ছ ভেবে এ–সব কথা করছ যারা হেলা,
কুম্ড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা।
দেখবে তখন কোন্ কথাটি কেমন করে ফলে,
আমায় তখন দোষ দিও না, আগেই রাখি বলে।"
৩) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ :- সুকুমার রায়ের ছড়ার মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ও দেখা যায়। গোঁফচুরি, লড়াই ক্ষ্যাপা, গানের গুঁতো, খুড়োর কল প্রভৃতি ছড়াগুলোকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, সুকুমার রায় কতটা নিপুণতার সঙ্গে বিশ্বব্যাপী অস্থির অবস্থাকে তুলে ধরেছেন। দেশীয়দের প্রতি ইংরেজ সরকারের নিচু মনোভাব তুলে ধরতে "জানি কোন কাঠ কিসে হয় জব্দ …"
এখানে কাঠকে সংস্কৃত ভাষায় কাষ্ঠ বলে। যা আমরা ইংরেজি caste শব্দটির সঙ্গে উচ্চারণগত মিল পাই। আর এখানে বুড়োটি যে Risele সাহেব, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার খুড়োর কল কবিতায় উনি বলতে চেয়েছেন। স্বদেশীরা, 'গাজরে'র লোভে ইংরেজদের সন্তুষ্ট করে, কিছু পাওয়ার আশায় দৌড়চ্ছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পাশ্চাত্যের কার্টুনিস্ট W. H. Robinson তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক কার্টুন এঁকেছিলেন। সেগুলোর সংকলন প্রকাশিত হয়, আর কার্টুনিস্ট Rude Goldberg এর আঁকা Goldberg machine এই দুইজন বিখ্যাত কার্টুনিস্টের কার্টুনের উপর ভিত্তি করে তিনি 'খুড়োর কল' ছড়াটি লিখেছিলেন।
গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী :- এই পর্যায়ে যে কয়েকটি ছড়া পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য 'বোম্বাগড়ের রাজা'। তবে এই ছড়াটি নিয়ে বেশ মতভেদ থাকলেও, সম্ভাব্য অধিক গৃহীত মতটি হল। লন্ডনের মে ফেয়ারের রোলস রয়েস শোরুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়, মহারাজ জয়সিংহ গাড়ির প্রদর্শন চলেছে দেখে তিনি দোকানে ঢুকে পড়েন। তাঁর গাড়ির খুব শখ ছিল। গাড়ি দেখার সময় দোকানের কর্মচারী সাধারণ পোশাকের অপরিচিত লোক দেখে বিশেষ পাত্তা দেয় না। জয়সিংহ মনঃক্ষুন্ন হন। তিনি দোকানের ভিতরে ঢুকে সাতটি গাড়ি কেনেন। তবে তাঁর শর্ত ছিল, গাড়ির সঙ্গে ওই কর্মচারীকে পাঠাতে হবে। কর্মচারী বিনামূল্যে ভারত ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে খুব খুশি হয়ে ওঠেন। তবে সে ভারতে এসে রাজার আদেশ শুনে চকিত হয়ে যায়। জয়সিংহ আদেশ দিয়েছিলেন, ওই সাতটি গাড়িকে রাজ্যের আবর্জনা সংগ্ৰহের কাজে ব্যবহৃত করা হোক। কর্মচারীটি নিজের ভুল বুঝতে পারে। এটি সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা। লন্ডনের The Telegraph পত্রিকায় এই ঘটনা নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাই সুকুমার রায় লিখেছিলেন, "রাতে কেন ট্যাঁক ঘড়িটা ডুবিয়ে রাখে, ঘিয়ে" বা "কেন রাজার বিছানা পাতে, শিরীষ কাগজ দিয়ে"। সত্য ঘটনার সঙ্গে যে অংশটি মিলে যায়, তা হল – "সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি?"
৫) অন্যান্য :- এই পর্যায়ে দেখা যায়। তার ছড়া গুলো শুধুমাত্র আনন্দ বা হাসির জন্য সৃষ্টি। যেমন - 'ভাল রে ভাল', গল্পবলা, ঠিকানা, প্রভৃতি। আমার মনে হয়, লেখক এই পর্যায়ের সৃষ্টি করেছেন, অন্য পর্যায়গুলিকে ঢেকে রাখার জন্য।
সুকুমার রায় ছিলেন ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি, এই দুটি বিষয়ের স্নাতক। কারণ এই দুটি বিষয়ই তার অনার্সের বিষয় ছিল। তাই হয়ত তিনি কুমড়োর সঙ্গে পটাশ মিশিয়ে কুমড়োপটাশ সৃষ্টি করতে পারেন। বা অনায়াসে হাঁসজারু, বকচ্ছপ জাতীয় মিশ্রিত প্রাণীদের শুধু তাঁর মানসে সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত দেননি। তিনি তাঁদের আঁকার মাধ্যমে তাদের রূপদান ও করেছেন।
তাঁর প্রত্যেকটি দ্ব্যর্থবোধক ছড়াগুলোর সময়কালের থেকে প্রকাশকালের ব্যবধান ছয়মাস থেকে একবছর। একটু ভেবে দেখলে আমরা পাব, সুকুমার রায় অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ছড়াগুলো সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। যাতে তাকে রাজরোষে পড়তে না হয়। বা, সামাজিক পরিস্থিতি তাঁর বিপক্ষে না চলে যায়। ফলে পাঠকের কাছে এগুলো ছোটদের ছড়া হিসেবেই চিহ্নিত রয়ে গেছে। কোনও সন্দেহ নেই, সুকুমার রায় তাঁর উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ সফলতা পেয়েছিলেন। আজও শতবর্ষ পরেও অনেকেই জানেন না বা বুঝতে পারেন না। যে ছোটদের ছড়া নিছক মজার ছড়া নয়, আর এখানেই আবোল তাবোলের সার্থকতা।
(www.theoffnews.com Sukumar Roy Abol Tabol)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours